নিবন্ধিত কোম্পানির জন্য স্বতন্ত্র পরিচালক প্যানেল এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ

সাইফুল হোসেন২০১৮ সালের ‘করপোরেট গভর্নেন্স কোড (সিজিসি)’ অনুযায়ী পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর জন্য ‘স্বতন্ত্র পরিচালক প্যানেল’ গঠন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এই প্যানেল গঠনের উদ্দেশ্য হচ্ছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত ও প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। পুঁজিবাজারকে আস্থাশীল করে তোলার জন্য উদ্যোগকে সাধুবাদ জানানো উচিত, কিন্তু আমাদের অনেকদিন অপেক্ষা করতে হবে যে আসলেই এটা কেমন হবে, ফলপ্রসূ হবে নাকি ব্যর্থ হবে। আইন আছে কিন্তু শুধু প্রয়োগের সীমাবদ্ধতার কারণে, সততা ও জবাবদিহিতার অভাবে আইন আমাদের যথাযথ সুফল দিতে পারে না। এটা আইনের ব্যর্থতা নয় বরং যারা আইনটা প্রয়োগের দায়িত্বে থাকেন তাদের ব্যর্থতা।
বিএসইসি’র এমন উদ্যোগ নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে এবং সেটাই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হচ্ছে কেন এই উদ্যোগ।
আমরা স্বাধীনতার চল্লিশ বছর অতিক্রম করেছি, উন্নয়নের রোল মডেল হয়েছি, বিশ্বে আমাদের সুনাম হয়েছে কিন্তু একটি শক্তিশালী পুঁজিবাজার আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। করপোরেট গভর্নেন্স শুধুমাত্র কিতাবি শব্দ হয়ে আছে বাস্তবে এটার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এটা ব্যক্তিখাতে যেমন, সরকারি খাতেও তার ব্যতিক্রম চোখে পড়ে না। একটি নিবন্ধিত কোম্পানিতে স্বতন্ত্র বা স্বাধীন পরিচালক থাকবে, তার নিয়োগ হবে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক। তার কাজ হবে কোম্পানির স্বার্থকে বড় করে দেখা, ক্ষুদ্র পরিচালকদের স্বার্থের বিঘ্ন ঘটছে কিনা সেটা দেখা, কোম্পানির বোর্ড নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থে কিছু করছে কিনা, কোম্পানির সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে কিনা সেটা দেখা, কোম্পানির সম্পদ  বোর্ডের পরিচালকদের ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা সেটা দেখা এবং কোম্পানি কোনোভাবে পুঁজিবাজার ও দেশের প্রচলিত আইনকানুনবিরোধী কোনও কাজে লিপ্ত কিনা সেটা দেখা। বাস্তবে কী ঘটছে? নিবন্ধিত কোম্পানি শুধুমাত্র ফর্মালিটি মানার জন্য নিজেদের আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব বা পরিচিতজনের মধ্য থেকে এক বা একাধিক জনকে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ করছেন (যদিও স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেন কোম্পানির পরিচালকরা এবং যার  অনুমোদন সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা বার্ষিক সাধারণ সভায় দেন।) যিনি শুধু নামকাওয়াস্তে বোর্ডে বসছেন বোর্ড পরিচালকদের একান্ত বাধ্যগত ও অনুগত এবং কণ্ঠস্বর স্তিমিত রাখছেন কারণ তিনি তাদের অনুগত এবং নিজের কোনও মতামত তার বা তাদের নেই, বোর্ড পরিচালকদের কণ্ঠস্বরই তার বা তাদের কণ্ঠস্বর। এবং সবচেয়ে বড় কথা তিনি বা তারা প্রয়োজনে কোম্পানি থেকে সুযোগ-সুবিধা নেন। যেমন নিজের একজন আত্মীয়ের চাকরির ব্যবস্থা ও অন্যান্য সুবিধা ইত্যাদি। যিনি নিবন্ধিত ওই কোম্পানির আশীর্বাদপুষ্ট, তিনি কোন শক্তিতে ও নৈতিক ভিত্তিতে তাদের অন্যায় বা অনিয়মতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নিজের কণ্ঠস্বর উচ্চকিত করবেন? সম্ভব কী!       

এই বাস্তবতায় বিএসইসি’র যে উদ্যোগ তা প্রশংসার দাবি রাখে। বর্তমানে করপোরেট গভর্নেন্স কোডের শর্ত অনুযায়ী তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হবেন সর্বনিম্ন ৫ জন ও সর্বোচ্চ ২০ জন। তাদের মধ্যে প্রতি ৫ জনের মধ্যে ১ জন স্বতন্ত্র পরিচালক থাকতে হবে। একটা বিশেষ নিয়মকানুন মেনে একটা যোগ্য ও আপাত সৎ প্যানেল তৈরি হবে যারা পরবর্তীতে বিভিন্ন কোম্পানিতে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। কিন্তু এখানেও কেন প্রশ্ন আসছে। প্রশ্ন আসছে কারণ আমাদের অভিজ্ঞতা অসুন্দর। সরকারি ব্যাংকে অনেক স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োজিত হন রাজনৈতিক বিবেচনায়, ব্যাংকিং বিষয়ে জ্ঞান থাকুক আর না থাকুক। ব্যাংকের বা সাধারণ বিনিয়োগকারী ও আমানতকারীর স্বার্থ তাদের কাছে বড় বিষয় না হয়ে নানা ধরনের ঋণ তদবিরের কাজে তারা নিজেদের নিয়োজিত করেন, নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে নিয়োগ ও ট্রান্সফারে অবদান রাখতে চান, বিতর্কে জড়ান। তাই মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে এই প্যানেল রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকবে কিনা। এখন স্বতন্ত্র পরিচালক হন শেয়ারহোল্ডার বা পরিচালকদের কাছের মানুষেরা। নতুন সিদ্ধান্তের ফলে স্বতন্ত্র পরিচালক হবেন রাজনৈতিক প্রভাবসম্পন্ন ব্যক্তিরা। তাতে কোম্পানিগুলোতে সুশাসন আসবে বলে মনে হয় না। তবে বিনিয়োগকারীদের ধারণা প্যানেল গঠনের পর স্বতন্ত্র পরিচালকরা যথাযথ ভূমিকা পালন করলে কোম্পানিগুলোতে দুর্নীতির পরিমাণ কমে যাবে, কোম্পানির টাকা যথেচ্ছভাবে ব্যবহৃত হবে না, পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরেয়ে আনা সম্ভব হবে।

এখন একটু দেখা দরকার যে আইনগতভাবে এটা কি ঠিক আছে নাকি প্রচলিত আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে কারণ ব্যাংক-কোম্পানি আইন অনুসারে ব্যাংকগুলোকে পরিচালক নিয়োগ দিতে হলে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও অনুমোদন নিতে হয়। অর্থাৎ পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত ব্যাংকের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন লাগার কথা এবং সেটা অবশ্যম্ভাবী। তাহলে প্যানেল তৈরির সময় কি বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মতি লাগবে না বিশেষ করে ব্যাংকের ক্ষেত্রে? যদি লাগে তাহলে নিতে হবে, না নিলে স্বতন্ত্র পরিচালকদের প্যানেল কার্যকর হবার কথা নয়।

যাহোক নিয়মকানুন মেনে এমন একটা উদ্যোগ নিলে এবং যথাযথভাবে পরিপালন সম্ভব হলে ধনাত্মক প্রভাব বয়ে আনবে পুঁজিবাজারের জন্য এই আশাবাদ রাখা যায়। তাছাড়া উদ্যোগটি যেহেতু মন্দ নয়, এটা হতে পারে একটা পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ। ভালো হবে যদি নিয়ম মানা সংস্কৃতি চালু করা যায়। এখানে দরকার হবে সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির বর্তমান নেতৃত্বের সতর্ক ও সাবধান পদক্ষেপ।

এই প্রসঙ্গে অন্য একটি প্রসঙ্গ আলোচনায় আনতে চাই। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন বেশ বড়। ৬০টি ব্যাংক ও প্রায় ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান সেবা দিচ্ছে সারাদেশে। আমরা জানি আর্থিক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক এবং বড় বড় প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি আছে যাদের অনেকেই ঋণ খেলাপি। ওইসব কোম্পানির বেশিরভাগই পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত নয়। ওই কোম্পানিগুলোর আর্থিক চরিত্র যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে পরিচালকদের স্বেচ্ছাচারিতা যেহেতু তাদের নিজের কোম্পানি, অসচ্ছতা, অদক্ষ আর্থিক ও কোম্পানি ব্যবস্থাপনা ও ব্যবসা সংক্রান্ত অদক্ষতা ও অপরিণামদর্শী ব্যবসা ডাইভারসিফিকেশন তাদের ব্যবসায়ে খারাপ করার ও পরবর্তীতে ঋণ খেলাপি হবার অন্যতম কারণ।

ব্যাংকগুলো ঋণ প্রদানকালীন সময়ে অথবা ঋণ যখন একটু খারাপ দিকে টার্ন নিতে থাকে সেরকম একটা সময়ে  ৪০ কোটি বা বেশি দায় আছে এমন কোম্পানির ক্ষেত্রে ব্যাংকের পছন্দ অনুযায়ী যোগ্য এক বা একাধিক স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ করার কথা ভাবতে পারে না? দেখা যায় কোম্পানির আর্থিক বিষয়ের ওপর যেহেতু ব্যাংক বা ঋণ দানকারী প্রতিষ্ঠানের কোনও ধরনের নিয়ন্ত্রণ থাকে না, প্রতিষ্ঠানটির ভিতরে কী হচ্ছে, কীভাবে আর্থিক বিষয়টি তারা ব্যবস্থাপনা করছেন, ঋণের টাকা ব্যবসার বাইরে যাচ্ছে কিনা, বিদেশে পাচার হচ্ছে কিনা ব্যাংক কিছুই জানতে পারে না। এক্ষেত্রে ব্যাংকের মনোনীত স্বতন্ত্র পরিচালক থাকলে ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান খুব সতর্ক থাকবে এবং ইচ্ছেমতো ফান্ড ব্যবহার করা থেকে সতর্ক থাকবে। তাছাড়া একজন যোগ্য স্বতন্ত্র পরিচালক তাদের অনেক ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিতে পারবে, তাদের অনেক ভালো পরামর্শ দিতে পারবে। এক্ষেত্রে হয়তো বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি লাগবে। সরকারি এবং বেসরকারি সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পে ও অন্যান্য ভারি শিল্পের সঙ্গে জড়িত ঋণগ্রহীতাদের জন্য এটা খুব দরকারি।

যাহোক, ভালো উদ্যোগের সঙ্গে সবার থাকা উচিত। এবং এখন অপেক্ষা করা দরকার যে এই উদ্যোগটি আদতেই কতটা কার্যকরভাবে কতটা নিয়মতান্ত্রিকভাবে বাস্তবায়িত হয়। সুন্দর ও শক্তিশালী পুঁজিবাজার, আন্তর্জাতিক মানের পুঁজিবাজার আমাদের অনেকদিনের আশা। সেই আশা ধীরে ধীরে পূরণ হবে এই প্রত্যাশা করতে চাই।    

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক। ফাউন্ডার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল

ইমেইলঃ hossain.shaiful@gmail.com