ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে টেকসই করার কৌশল কী হতে পারে?

সাইফুল হোসেনকরোনাসৃষ্ট অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে আমাদের দেশের অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যাবে, অনেক প্রতিষ্ঠান চিরতরে হারিয়ে যাবে, অনেক প্রতিষ্ঠান কোনোভাবে টিকে থাকবে, আবার অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ তো হবেই না, বরং আন্তর্জাতিক মানের হয়ে উঠবে।
আপনার প্রতিষ্ঠান কি যেনতেনভাবে টিকে থাকবে, চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে, নাকি অনেক ভালো করবে? গভীর পর্যবেক্ষণের বিষয় বৈকি।
দেখুন একজন উদ্যোক্তার কাজ হচ্ছে অন্যের সমস্যার সমাধান করা, অন্যের কাজকে সহজ করা, অন্যের যন্ত্রণা শিল্পসম্মতভাবে কমানো। উদ্যোক্তা সেজন্য সবাই হতে পারে না। উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য যে উদ্ভাবনী ক্ষমতার দরকার হয় তা অনেকের মধ্যেই থাকে না। তাই যদিও অনেকে উদ্যোক্তা হতে চায়, চাকরি করা সময়েও বারবার চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছা মনে পোষণ করেন, মাঝে মধ্যে চেষ্টাও করেন, কিন্তু সফল হতে পারেন খুব কম লোকে। কারণ উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য যে সর্বোচ্চ চাপ সহ্য করার ক্ষমতা দরকার হয় সেই সহ্য-ক্ষমতা খুব অল্প লোকে ধারণ করেন।

বাংলাদেশের মতো জায়গায় এই চাপ আরও বেশি এবং ভিন্ন। বাংলাদেশ ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে যদিও এগিয়েছে, তবুও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ঋণ প্রাপ্তিতে জটিলতা, অবকাঠামোগত সমস্যা, গ্যাস সংযোগ সংক্রান্ত জটিলতা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স প্রদানের দীর্ঘসূত্রতা, সুদ-ঘুষের নৈরাজ্য-এসব বিবিধ কারণে এখানে ব্যবসা করা কঠিন, যারা ব্যবসা করেন, তাদের তাই অনেক ধৈর্যশক্তি ও গভীর অধ্যবসায় লাগে। তারপর ব্যবসা চালু করতে গেলে সবচেয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ আপনার লাগে, সেটা হচ্ছে মানবসম্পদ। সংখ্যায় মানুষ আছে অসংখ্য, কিন্তু সম্পদে রূপান্তর ঘটেছে বা ঘটে খুব অল্প। প্রতিবছর এদেশে এত মেধাবী ছেলেমেয়ে কর্মক্ষেত্রে যোগ দিচ্ছে, তারপরও ভালো, দক্ষ কর্মী না পাওয়ার অভিযোগ সর্বত্র, বিদেশ থেকে লোক এনে তাই অনেককে প্রতিষ্ঠান চালাতে হচ্ছে।

যাহোক বলছিলাম একজন উদ্যোক্তার প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে সমস্যার সমাধান করা। আপনার গ্রাহক বা কাস্টমার যদি আপনাকে কাজ দিয়ে কাজটি সুন্দর ও সাবলীলভাবে সম্পন্ন হবে এই ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে রাতে ভালোভাবে ঘুমুতে পারেন, তাহলে আপনি ভালো উদ্যোক্তা। আপনি যত বেশি কাস্টমারকে সেবা দিতে পারবেন, তাদের সমস্যার সমাধান করে দিতে পারবেন, আপনি তত ভালো উদ্যোক্তা হয়ে উঠবেন ধীরে ধীরে।

একজন সফল উদ্যোক্তার অনেক গুণের মধ্যে অন্যতম গুণ হচ্ছে উদ্যোক্তা অনেক প্রেসার নিতে পারেন যেটা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, খুব বেশি প্রেসারে কাঁদেন না, লোকসান করলে বা হেরে গেলে পিছিয়ে যান না, নিজেকে সরিয়ে নেন না। একজন উদ্যোক্তা বিপদে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না হয়ে চিন্তা করেন নতুন আইডিয়া নিয়ে, নতুন পথের সন্ধান করেন, নতুন করে বাঁচতে চান, অন্যকে বাঁচাতে চান।

একজন উদ্যোক্তা নতুন পরিকল্পনা করেন সংকট উত্তরণের জন্য, পরিকল্পনাকে নতুন নতুন আঙ্গিকে সাজানো যেটা একজন চাকরিজীবীকে সহসা করতে হয় না। আমাদের সমাজে চাকরি কথাটার মধ্যে একটা নিশ্চয়তার গন্ধ আছে, যেজন্য ব্যবসার চেয়ে চাকরিকে প্রাধান্য দেন অনেকেই, এমনকি পাত্রীপক্ষ। আর ব্যবসা কথাটার মধ্যে জড়িয়ে আছে ঝুঁকি, অনিশ্চয়তা, কিন্তু এখন এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে অধিক সাহসী উদ্যোক্তার দরকার যারা ঝুঁকি নিতে পারবে, যারা জানবে তারা কী করতে যাচ্ছে, যারা তাদের করণীয় সম্পর্কে আদ্যোপান্ত জানবে, জেনে ঝুঁকি নেবে। এখন নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা দরকার, কারণ উদ্যোক্তারা যে নতুন পথ খুঁজে পান, নতুন নতুন বিষয় উদ্ভাবন করতে পারেন, সন্ধান করতে পারেন, চাকরিজীবীরা সেটা পারেন না, কারণ চাকরি সেই সুযোগের অভাব আছে।  

করোনা বৈশ্বিক ব্যবসায়ের ধরন অনেক বদলে দেবে, তাতে কারও কোনও সন্দেহ নেই। তবে কীভাবে বদলাবে, কতটা বদলাবে সেটা এখনই বলা মুশকিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের অধিকাংশ উদ্যোক্তার টিকে থাকার সক্ষমতা কতটুকু, সেটা বলা কঠিন। ধরা যাক ব্যবসায়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে বেশি হবে, বেশি পরিমাণ প্রযুক্তি নির্ভরতা বাড়বে এবং সেক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে থাকবো, কারণ আমাদের সেই প্রস্তুতি নেই। আমরা অনেকেই প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার ও কমিউনিকেশনে খুব পিছিয়ে। যখন আপনি গ্লোবাল বিজনেসে নিজেকে বেশি করে সংযুক্ত করবেন, তখন অন্যান্য হাজারও গুণের সঙ্গে আপনার এই দুটি ক্ষেত্রে বিশেষ জ্ঞান আবশ্যক। ব্যবসার সমৃদ্ধি ও টিকে থাকার জন্য আমাদের প্রযুক্তিবান্ধব যেমন হওয়া দরকার, তেমনি দরকার সর্বক্ষেত্রে দক্ষতা বাড়ানো, পণ্য ও সেবার গুণগত মান বাড়ানো।

উদ্যোক্তারা ভবিষ্যৎ দেখতে পান অথবা অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয় সেই হচ্ছে ভালো উদ্যোক্তা যিনি ভবিষ্যৎ দেখতে পান এবং সেইভাবে যথাযথ ও সময়োপযোগী কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এখন আপনি টিকে থাকার জন্য কী করবেন সেই সিদ্ধান্ত আপনাকে নিতে হবে সময় ও ভবিষ্যৎ ব্যবসায়ের ধরন বিশ্লেষণ করে, বৈশ্বিক অর্থনীতির গতি প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে।

আপনি উদ্যোক্তা। করোনা আপনার ব্যবসাকে তছনছ করে দিয়েছে। তবু আপনাকে সব প্রতিকূলতা থেকে বের হয়ে টিকে থাকতে হবে। আপনার প্রতিষ্ঠানকে—সেটা ছোট হোক বা বড় হোক টিকিয়ে রাখতে হবে, তাই সে যেভাবে হোক কারণ যদি টিকতে না পারেন তাহলে আপনি হবেন ‘ভুলে যাওয়া হিরো’ যা’কে কেউ মনে করবে না, মনে রাখবে না। এবার টিকে থাকার জন্য প্রথমত আপনার খরচ কমাতে হবে, কারণ ব্যবসা এখন বাড়ানোর সুযোগ কম, ব্যবসাকে দক্ষ করতে হবে। তাছাড়া যেসব জায়গায় অপচয় হচ্ছে সেসব জায়গা নির্ণয় করে সেখানে অপচয় কমাতে হবে।

যেসব প্রতিষ্ঠানে ব্যবসার জন্য ক্ষতিকর কর্মী আছেন তাদের বাদ দিতে হবে। প্রয়োজনে সবার বেতনে কিছু কাটছাঁট করে হলেও ব্যবসায় টিকে থাকতে হবে। প্রয়োজনে অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারেন লোকজন ছাঁটাই না করে। কিছু কাজ আপনি আউটসোর্সিং করতে পারেন, তাতে খরচ কমে যাবে।

তাছাড়া ভালোভাবে টিকে থাকার জন্য, ব্যবসায়ের প্রবৃদ্ধির জন্য, বাজারে অন্য প্রতিযোগীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নিজের অবস্থানকে শক্ত করার জন্য আপনি নিচের বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে পারেন, যা আপনার চিন্তাকে বিকশিত করতে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে সহায়তা করবে।

টিকে থাকার তিনটি কৌশল আছে মূলত। (এখানে আপনার নিজের ব্যবসাকে শক্তিশালী করার জন্য এই কথাগুলো বলা হচ্ছে। তাছাড়া বিষয়গুলো আপনি আপনার মতো করে ব্যবহার করতে পারেন)

১) অন্যকে পরাজিত করে

আপনার অফিসের সার্বিক উন্নতির জন্য আপনার একজন কর্মী অন্য একজনকে বিভিন্ন পন্থায় নিচে নামাতে পারে, পরাজিত করতে পারে। এক্ষেত্রে একজন অন্যজনকে সহায়তা না করে বরং শত্রুভাবাপন্ন হয়ে কাজ করে। তাতে হয়তো একজন অন্যজনের চেয়ে ভালো করতে পারে, কিন্তু সার্বিক বিচারে প্রতিষ্ঠানের লাভ তেমন হয় না। কোম্পানি তার প্রতিযোগীদের চেয়ে পিছিয়ে যায়, কারণ নিজেদের মধ্যে দেখা দেয় সমন্বয়হীনতা, ফলে প্রোডাক্টিভিটি আশানুরূপ হয় না। জেতার এই কৌশলটি তাই গ্রহণযোগ্য মনে হয় না।  

২) আপনার সর্বোত্তম সক্ষমতা দিয়ে

আপনার প্রত্যেক কর্মী পারে তাদের নিজের সক্ষমতা বাড়াতে এবং সেভাবে পারে নিজের সর্বোচ্চ প্রোডাক্টিভিটি নিশ্চিত করতে, কিন্তু সেটাও খণ্ডিত এবং আপনার প্রতিযোগীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সর্বোত্তমভাবে টিকে থাকা কষ্টকর। তবে এই কৌশল মধ্যমানের। অনেকে এভাবে টিকে থাকতে পারে, কিন্তু সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছানো সম্ভব নয়।

৩) সবাই মিলে একটা টিম গঠন করে এবং পারস্পরিক সহযোগিতাকে ত্বরান্বিত করে

প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে অফিসের সব কর্মীর সামগ্রিক শক্তিকে একই উদ্দেশ্যে একটি পথে ধাবিত করতে পারা। সবাই মিলে একটা টিম, সবার কাজ কোম্পানির উন্নয়ন, একে অপরের প্রতিযোগী নয় বরং একে অপরের সহযোগী। একজন টিম লিডারের নেতৃত্বে একেকটি টিম সমন্বিতভাবে কাজ করবে, সবাই সবার সামর্থ্যের সর্বোত্তমটা দেবে, পুরা হৃদয় দিয়ে কাজ করবে কোম্পানির ওনারশিপ মনে ধারণ করবে। এক্ষেত্রে লিডারশিপ খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যোগ্য, সৎ ও ডেডিকেটেড নেতৃত্ব ছাড়া এটা সম্ভব নয়।

করোনা পরবর্তী সংকট মোকাবিলা করে সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্য আপনার প্রয়োজন হবে দক্ষ ও ডেডিকেটেড টিম। সবার আগে আপনাকে অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের মালিক, এমডি বা সিইও যিনি নেতৃত্বে থাকবেন তাকে তৈরি হতে হবে। কারণ আপনি যদি তৈরি না হন, আপনার প্রতিষ্ঠানকে সাস্টেইনেবল করা কঠিন হয়ে পড়বে। আর একটা বিষয়, সবাইকে প্রতিদিন একটু একটু করে নিজেকে উন্নত করতে হবে, নিজেকে ধনাত্মকভাবে বদলাতে হবে, প্রচুর পড়তে হবে, প্রশিক্ষণ নিতে হবে। তাহলে সংকটে টিকে থাকা সহজ হবে।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও কলাম লেখক। ফাউন্ডার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল 

ইমেইল: hossain.shaiful@gmail.com