এখানে সরকার এবং রাজনৈতিক দলকে আলাদাভাবে দেখতে হবে। একাজটি করতেও রাজনৈতিক দলগুলো সফল হয়নি। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো কখনও সরকার থেকে আলাদা হতে পারেনি, কারণ ক্ষমতার মিঠাইয়ের স্বাদ নেওয়ার লিপ্সা থাকে একেবারে তৃণমূলের কর্মীটিরও। তাই দলকে আর সরকারের বলয় থেকে সরানো যায়নি। চেষ্টা হয়নি এমন বলা যাবে না। নীতিনির্ধারকরা এমন আদর্শিক ইশতেহার দিয়েছেন। কিন্তু বরাবরই নেতাকর্মী ও সুযোগ সন্ধানী চক্রের লোভের কাছে হেরে যেতে হয়েছে। এই হেরে যাওয়ার মাশুল বরাবরই গুনে যেতে হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোকে। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষেরা রাজনৈতিক দলগুলোকে ক্ষমতা ও রাজনৈতিক দল আলাদা রাখতে পারার লড়াইয়ে বিজয়ী দেখার অপেক্ষায়। বিরোধী দলে যখন যারা থাকেন, তারা শুধু ক্ষমতা দখল বা ক্ষমতায় ফিরে যাওয়ার জন্যই রাজনীতির স্লোগান কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থেকেছেন। ইশতেহার মসনদ দখলের। জনগণের নিত্য-দুর্ভোগ এবং প্রত্যাশা নিয়ে সরব দেখা যায় না তাদের। নিজেদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব, রুটি-গুড়ের ভাগাভাগি নিয়েই বিরোধী দল ব্যস্ত থাকছে। মোটামুটি সরকারের সমালোচনা ও দোষারোপই এখানে বিরোধী দলের রাজনীতির সংস্কৃতি। বিরোধী দলে এসেও জনবিচ্ছিন্ন থাকে বিরোধী দল।
ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোও আমরা যে জোটবদ্ধ আছি এমন বলা যাবে না। আমরা একত্রে দাঁড়াতে পারছি না। আমাদের মধ্যে কোনও সংলাপ বিনিময় নেই। থাকলেও সহ্য করতে পারছে না একটি পক্ষ। সেই পক্ষটি কে? দুর্বৃত্তরা। এই গোষ্ঠীটি জানে ফুটপাতের মানুষগুলো রাজনীতিমনস্ক। তারা প্রকৃত রাজনীতিবিদ? তা জানেন। অনেক অপ্রাপ্তির পরেও, মানুষ গিয়ে রাজনৈতিক দলের কাছেই আশ্রয় খোঁজে। নানা ক্ষোভে অভিমানের প্রকাশ ঘটায়। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের সামনে রেখেই তারা চলতে চান। দুর্বৃত্তরা তাই ছদ্মবেশে রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছে। তারা প্রকৃত রাজনীতিবিদদের বিলুপ্ত করা তাদের মন বাঞ্ছনা। দৃশ্যমান পরিস্থিতি দেখে বোঝা যায়–সেই বাঞ্ছনা বাস্তবায়নে তারা সক্রিয়। তাদের দাপটে ক্ষমতাসীন বা বিরোধীতে থাকা রাজনীতিবিদদের অনেকে অভিমানে, ক্ষোভে আড়ালে চলে গেছেন। ফলে রাজনীতিতে আদর্শিক উচ্চারণ এখন হ্রস্ব।
সমাজের অন্যান্য ময়দানেও দুর্বৃত্তায়নের এক প্রকার সফল মঞ্চায়ন দেখা যাচ্ছে। কোভিড-১৯ এর মহামারিকালে আমরা দেখতে পেলাম স্বাস্থ্য খাত নিয়ে কী পরিমাণ লুটতরাজ চললো। সেবার বদলে মানুষ নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা, প্রাণনাশের মতো অপরাধ ঘটিয়ে গেলো, যাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। রাজনীতিবিদরা সেখানে অসহায়। তারাও নিজের এবং পরিবারের জীবন নিয়ে বিপন্ন অবস্থায়। একই বিপন্নতার শিকার সামরিক-বেসামরিক দফতরের মানুষগুলোও। কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রাণ গেলো চিকিৎসক, পুলিশ, গণমাধ্যমকর্মী, সামরিক, বেসামরিক প্রশাসনের মানুষের। আর এই কোভিড নিয়েই মশকরা করে গেলো দুর্বৃত্তদের সিন্ডিকেট। সকলে আমরা শুধু দর্শক হয়েই রইলাম।
স্বাস্থ্য খাতের মতো দুর্বৃত্তায়ন ঘটেছে শিক্ষাখাতেও। উচ্চ শিক্ষার ধারণা থেকেও ক্রমশ আমরা দূরে সরে যাচ্ছি। শিক্ষা এখন বাণিজ্যিক সনদ বিক্রির বিষয়। প্রাথমিক থেকে তথাকথিত উচ্চ শিক্ষা নিয়ে বেসাতিতে বেনিয়াদের সঙ্গে শিক্ষকরাও যোগ দিয়েছেন। ক্ষমতার মিঠাইর তরে শিক্ষকদের জিভেও জল। সাংস্কৃতিক আন্দোলন বা সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্তরাও এই বণ্টনে নিজেদের বঞ্চিত রাখতে চান না। বেসরকারি সাহায্য সংস্থা (এনজিও) সহ অন্যান্য বেসরকারি খাতও দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গ ছাড়া হতে চান না। গণমাধ্যম তো সমাজ বিচ্ছিন্ন কোনও ‘দ্বীপ’ নয়। তাই নিশপিশ তাদের হাতও।
সুতরাং আগে যেমন গরম পানি বা লাঠিচার্জ করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করা হতো, এখন আর তার প্রয়োজন হচ্ছে না। দুর্বৃত্তরা লোভের ‘মজা’ দেখিয়েই কাজের কাজটি করে ফেলছে। প্রশ্ন হলো আমরা কি বুঝতে পারছি, আমরা ছত্রভঙ্গ?
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি