ওজনের দ্বারা যে জিনিসের পরিমাণ করা যায় সেই জিনিসের কর্য হতে পারে। যেমন ধান-চাল, গম-আটা ইত্যাদি। এমনকি গণনার দ্বারা যেসব জিনিস ফেরত প্রদান করা সম্ভব, তারও কর্য হতে পারে। বেহশতি জওর গ্রন্থের মতে, যেসব জিনিস পরস্পর একটা অন্যটার চেয়ে কম-বেশি হয় না, প্রায় সমান সমাই হয়, সেসব জিনিসের কর্য গুনার দ্বারা পরিশোধ হবে। যেমন—ডিম, সুপারি, নারিকেল ইত্যাদি। এক্ষেত্রে যেসব জিনিস যেমনটি নেওয়া যায়, তেমনি পরিশোধ করা যায় না—এমন জিনিসের কর্য না নেওয়াই ভালো। যেমন—আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, বকরি, গরু ইত্যাদি। তবে টাকার ক্ষেত্রেও ধার দেওয়া যেতে পারে; যা আমরা ব্যক্তিপর্যায়ে চর্চা করি। কিন্তু সামষ্টিকভাবে এর চর্চা হয় না। সেখানে ঋণ প্রদানের বিষয়টি চলে আসে। যদিও ইসলাম ধর্ম মতে, ঋণ নয় টাকা ধার বা কর্য প্রদানই উত্তম। মুসলিমরা ইসলাম ধর্মের ওই বিধান মতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে টাকা ধার বা কর্য দেওয়ার রীতি চালু করতে পারে।
কর্যের অন্য অর্থও ঋণ। তবে বর্তমানে প্রচলিত সুদযুক্ত ঋণ ব্যবস্থা আর ইসলাম ধর্মের ঋণের অর্থগত পার্থক্য রয়েছে। ইসলাম ধর্মের এই ঋণ ব্যবস্থাকে বলা হয় করজে হাসানা। করজে অর্থ ঋণ বা ধার। আর হাসানা অর্থ উত্তম। অর্থাৎ করজে হাসানা অর্থ উত্তম ঋণ। আল কোরআনের সুরা আল হাদিদের ১৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় দানশীল নর-নারী যারা আল্লাহকে উত্তমরূপে ধার দেয়, তাদের দেওয়া হবে বহুগুণ। তাদের জন্য রয়েছে সম্মানজনক পুরস্কার।’
সচ্ছল ব্যক্তিরা গরিব অভাবগ্রস্ত মানুষকে ধার প্রদান করলে তা মূলত আল্লাহকে ধার প্রদান করা হয়। তবে এই ধার প্রদানের ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে, ধার গ্রহণকারী ব্যক্তির সচ্ছলতা না আসা পর্যন্ত ধার ফেরত নেওয়ার ক্ষেত্রে অপেক্ষা করা। এক্ষেত্রে আল কোরআনের সুরা বাকারার ২৮০ নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে, ‘যদি খাতক অভাবগ্রস্ত হয়, তবে তার সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত সময় দেওয়া উচিত। আর যদি ক্ষমা করে দাও, তবে তা খুবই উত্তম। যদি তোমরা উপলব্ধি কর।’
অবশ্যই ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) একান্ত কারণ ব্যতীত কর্য গ্রহণ করাকে নিরুৎসাহিত করেছেন। অত্যন্ত জরুরি না হলে এবং অন্য কোনও উপায় না থাকলেই শুধু ধার বা কর্য গ্রহণ করা যেতে পারে। আর মুসলিমদের দায়িত্ব হচ্ছে তার হাতে অতিরিক্ত সম্পদ থাকলে তা অন্য মানুষের প্রয়োজনের সময় ধার বা কর্য দেওয়া যাতে ওই ব্যক্তির ওই সময়ের জন্য অর্থ কষ্ট থেকে পরিত্রাণ পেতে পারে। অর্থের জন্য সাময়িক বিপদে পড়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। কোনও বিনিময়ের আশা না করে মুসলিমদের এমন ধার বা কর্য প্রদান করার অনেক ফজিলত রয়েছে। এর মাধ্যমে একজন মানুষের উপকার করার মাধ্যমে তার সঙ্গে যেমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে তেমনি দুনিয়া পরবর্তী জীবনের জন্যও অনেক সওয়াব লাভ করা যাবে। এই বিষয়ে হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, অভাবগ্রস্তকে কর্য বা ধার দিয়ে সাহায্য করলে ১৮ গুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যায়।
তবে যিনি ধার নিচ্ছেন তারও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। এর মধ্যে ধার পরিশোধে টালবাহানা না করে যথাসময়ে তা পরিশাধ করা অন্যতম। ধার নেওয়ার সময় ফেরত দেওয়ার নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করা এবং উক্ত সময়ের মধ্যে ধার ফেরত দেওয়া হলে যিনি ধার প্রদান করছেন ভবিষ্যতে তিনি আবারও অন্য ব্যক্তিকে ধার বা কর্য প্রদানে উৎসাহিত হবেন, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। এজন্যই হজরত মুহাম্মদ (সা.) অন্য এক হাদিসে এ বিষয়ে তাগিদ দিয়ে বলেছেন, যখনই কর্য বা ধার পরিশোধ করতে সক্ষম হবে; তখনই মুসলমানদের উচিত ধার পরিশোধ করা। ধার পরিশোধে টালবাহানা বা অজুহাত তৈরি করা ইসলাম ধর্মে গ্রহণযোগ্য নয়।
ক্রয়-বিক্রয়ের মতো ধার বা কর্যের ক্ষেত্রে উভয়পক্ষের মধ্যে চুক্তি হতে পারে। ধার প্রদানকারী ও ধার গ্রহণকারী উভয়ই একটি চুক্তিপত্রের মাধ্যমে ধারের পরিমাণ, ধার নেওয়ার সময় ও স্থান এবং ধার ফেরত প্রদানের নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করতে পারেন, যাতে ভবিষ্যতে ধার প্রদানের ফলে কোনও ধরনের বিবাদের সৃষ্টি না হয়। ধারের অর্থের পরিমাণ বেশি হলে সাক্ষীর উপস্থিতি ও চুক্তিপত্রে সাক্ষীর স্বাক্ষরও থাকতে পারে। তাহলে যিনি ধার নিচ্ছেন তিনি ধার নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করলে উপরোক্ত সাক্ষী ও চুক্তিপত্র থাকায় ধার প্রদানকারী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ধারের টাকা আদায় করতে পারেন। ইসলাম ধর্মে যেকোনও ধরনের লেনদেনের ক্ষেত্রে চুক্তি গ্রহণ করাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। ধার বা কর্যের ক্ষেত্রেও মুসলিমরা সেই বিধান অনুসরণ করতে পারেন।
পরিশেষে, কর্য বা ধার প্রদানের মাধ্যমে সমাজকে আমরা দারিদ্র্য মুক্ত করতে পারি। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে ঋণ মুক্ত করতে পারি। বিপদে অপর মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারি। ব্যক্তি পর্যায়ে ধারের যে প্রথা চালু আছে, তা যদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চালু করা যায় তবে সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সেই সুবিধা ভোগ করতে পারবে। অনেক মানুষের কাছে গচ্ছিত যে অলস টাকা পড়ে রয়েছে তা বিপদগ্রস্ত মানুষের প্রয়োজনে উপকারে লাগবে। বেকার ও অভাবগ্রস্ত মানুষ অনেক সময় ঋণ পরিশোধ করার ক্ষেত্রে বিপদে পড়ার আশঙ্কায় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করতে চায় না। কিন্তু তাদের যদি টাকা ধার প্রদান করা হয় তাহলে তারা ওই ধারের বা কর্যের টাকায় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবেন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ধার বা কর্যের প্রচলন করা গেলে ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ সুদ বা কুসিদ প্রথার অভিশাপ থেকে জাতি বা রাষ্ট্র রক্ষা পাবে। তাই নিজের কাছে গচ্ছিত টাকা অলস ফেলে না রেখে অন্য মানুষের যদি কোনও উপকারে আসে; তবে তাতেই প্রভূত কল্যাণ রয়েছে। তাই আসুন, ঋণ প্রদানের পরিবর্তে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে টাকা ধার বা কর্য প্রদান করাকে উৎসাহিত করি।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
salah.sakender@outlook.com