X
রবিবার, ০৪ মে ২০২৫
২০ বৈশাখ ১৪৩২

জেনারেলের স্বীকারোক্তি ও বিহারি গণহত্যার দায়

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
০২ এপ্রিল ২০২৫, ২০:২৪আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০২৫, ২০:২৪

আজমত আশরাফের লেখা রিফিউজি একটি আত্মজৈবনিক গ্রন্থ। বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান অনুবাদক এই বইটি ‘রিফিউজি: স্থিতিহীন আমি ঘুরে মরি একটি আবাসের তরে আমার অন্তহীন খোঁজ’ নামে অনুবাদ করেছেন। অনুবাদক ও প্রকাশক আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত। তাই অনুবাদের পিছনের কাহিনি অনেকটাই আমার জানা আছে। লেখক অনুবাদকের বন্ধু। বন্ধুর অনুরোধেই বইটি তিনি অনুবাদ করেছেন। কিন্তু বইটির কোথাও অনুবাদক হিসেবে তার নাম নেই। এই না থাকার পিছনে অন্য কোনও কারণ নেই, আছে ‘ভয়’। অনুবাদক ভয় পেয়েছেন যে রিফিউজি বইটি অনুবাদ করায় মূলধারার বাঙালি সমাজ তাকে বাঁকাচোখে দেখতে পারে, তাই তিনি বইয়ে অনুবাদক হিসেবে তার নামটি দেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন।

অনুবাদকের ওই চিন্তা একেবারে অমূলক নয়। কিন্তু তা বাঙালি সমাজের সামগ্রিক চিত্রও নয়। অনেক বাঙালি বিহারিদের পছন্দ করেন না, কেউ কেউ শত্রু মনে করেন, অচ্ছুত মনে করেন বিষয়টি তেমনও নয়। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে এক ধরনের ঠান্ডা মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব আছে এ কথা সত্য। কিন্তু উভয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলাপে তারা পরস্পর পরস্পরকে শত্রুজ্ঞান করেন আমার কাছে তা কখনও মনে হয়নি। তাদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব আছে তা ঠিক দ্বন্দ্ব নয়, বরং দীর্ঘদিন পরস্পর একই ভূমিতে বসবাস করলেও ধর্মের মিল থাকা সত্ত্বেও একপক্ষ অন্যপক্ষের সঙ্গে মিশতে না পারার বেদনা আছে। ওই মিশতে না পারার কারণ যতটা না রাজনৈতিক, তারচেয়ে বেশি সাংস্কৃতিক। মূলধারার বাঙালি মুসলমান সমাজের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগতভাবে বিহারিদের দৃশ্যমান পার্থক্য চোখে পড়ে। আর ওই পার্থক্যই তাদের বাঙালি মুসলমানদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছে।

অবশ্যই একাত্তর সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিহারিদের অধিকাংশের পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করার কারণে এবং রাজাকার, আলবদর, আলশামসের মতো বাঙালি হত্যায় অনেকেরই অংশগ্রহণ করায় স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির পক্ষে কখনোই বিহারিদের মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি।

যদিও বিহারি মানেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি কথাটি সত্য নয়। বরং বিহারিদের অনেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালিদের আশ্রয় দিয়েছেন, সহায়তা করেছেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ওপর লেখালেখি করে খ্যাতি লাভ করা একজন ঐতিহাসিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষককে মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোয় একটি বিহারি পরিবার আশ্রয় দিয়ে জীবন রক্ষা করেছিলেন। যদিও এই বিষয়ে উক্ত ঐতিহাসিক সর্বদা নীরব থেকেছেন। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত অনেক ঘটনায় বিহারিদের কারোর কারোর বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার প্রমাণ ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যাবে।

বিহারিরা ওই অর্থে পাকিস্তানি নয়। এ দেশের অধিকাংশের পূর্বপুরুষ কখনও পাকিস্তান যাননি। কারণ তাদের আদি নিবাস পাকিস্তান নয়, বরং ভারতে। ভারতের বিহার রাজ্য থেকে তারা ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ তথা আজকের বাংলাদেশে এসেছিলেন। বাংলাদেশের মানুষের অধিকাংশ মুসলমান হওয়ায় তারা মনে করেছিলেন তাদের ধর্মভাইয়েরা তাদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় হবে। কিন্তু ভাগ্য তাদের পক্ষে যায়নি। তারা বাংলাদেশের মূল সমাজে কখনোই জায়গা করে নিতে পারেননি।

রিফিউজি বইয়ে আজমত আশরাফ তাদের সেই ভাগ্যহত জীবনের কথা তুলে ধরেছেন। কোথাও স্থিতি হতে না পারার বেদনা তিনি তার বইয়ে বলেছেন। পাশাপাশি তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা যে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন তা তুলে ধরেছেন। তিনি ১৯৭১ সালে বিহারি গণহত্যা হয়েছিল বলে তার বইয়ে দাবি করেছেন। ১৯৭১ সালে বিহারিরা হত্যার স্বীকার হয়েছিলেন সেই বিষয়টি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু সেই হত্যাকাণ্ডের সত্যরূপকে স্বীকার না করে পক্ষপাতমূলক ইতিহাসকে তুলে ধরা দুঃখজনক।

আজমত আশরাফ চোখ বুজে তার বইয়ে একাত্তর সালের বিহারি গণহত্যার নামে ইতিহাসকে ‘হত্যা’ করেছেন। ফলে বাঙালি ও বিহারি দ্বন্দ্বের অবসানের বদলে এই বইটি ঘি ঢালার কাজ করেছে। কিন্তু আজমত আশরাফ সাহসী হয়ে প্রকৃত সত্য তুলে ধরতে পারলে তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক চিত্র ভিন্নরূপে সবার কাছে ধরা পড়তো।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছিল সেই বিষয়টি সত্য। ওই গণহত্যার পক্ষ ছিল স্পষ্ট। স্বাধীনতাকামী মুক্তিকামী মানুষ। ওই মুক্তিকামী মানুষের কণ্ঠস্বরকে রুদ্ধ করতে চাওয়া পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তার সহযোগী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, আলবদর, আলশামস ও রাজাকার। এখানে জালিম ও জুলুমের স্বীকার জনগোষ্ঠী ছাড়া প্রকৃতপক্ষে বিহারি, বাঙালি, পাহাড়ি বলে আলাদা বিভাজন তৈরি করার সুযোগ নেই। কারণ ১৯৭১ সালের গণহত্যায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ হত্যার স্বীকার হয়েছিলেন। অবশ্যই তাদের অধিকাংশ বা প্রায় শতভাগ ছিলেন বাঙালি। কারণ তারাই মুক্তির আন্দোলনের, স্বাধীনতার আন্দোলনের প্রধান সৈনিক ছিলেন। ফলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তাদের সহযোগীদের প্রধান টার্গেটে সাধারণ বাঙালিরা পড়েছিলেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেছিলেন বলেই তাদের সেনাবাহিনীকে গণহত্যায় লেলিয়ে দেন। ফলে অধিকাংশ সাধারণ বাঙালি প্রাণভয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দেশ ত্যাগ করেন। যারা দেশ ত্যাগ করতে পারেননি তারা বাড়িতে পথে ঘাটে হাটে বাজারে খালে বিলে নদীতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় সহযোগীদের হাতে প্রাণ হারান।

পাকিস্তানি সৈন্যরা যে ওইসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তা তাদের সেনাপতি স্বীকার করেছেন। সেনাপতির স্বীকারোক্তির পর অন্য উৎসগুলো আসলে গৌন হয়ে যায়। অভিযুক্ত যখন তার অপরাধ স্বীকার করেন তখন অন্যদের ইনিয়ে বিনিয়ে তাকে নিরপরাধ বলা অর্থহীন। ২০০১ সালে দৈনিক ইন্ডিয়া অ্যাবরোডের সাংবাদিক আমির মীরের কাছে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান নিয়াজী বলেন, তার সৈন্যরা একাত্তর সালে নারী ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এছাড়া জেনারেল নিয়াজীর যুদ্ধকালীন সময়ের তথা ১৯৭১ সালে পত্রালাপ থেকেও বিষয়টি জানা যায়।

জেনারেল নিয়াজীর ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দফতরে প্রেরিত চিঠিতে (টেলিফোন: ২৫১, ৭২১/আর/এ আই, ১৫ এপ্রিল ১৯৭১) বলা হয়েছে: “আমি এসে পৌঁছানোর পর থেকে সৈন্যদের লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার ভূরি ভূরি খবর পাচ্ছি।” সম্প্রতি ধর্ষণের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানিরাও রেহাই পাচ্ছে না। ১২ এপ্রিল দুই জন পশ্চিম পাকিস্তানি মহিলাকে ধর্ষণ করা হয় এবং আরও দুই জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়।” জেনারেল নিয়াজী যেখানে স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন যে তার সৈন্যরা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সেখানে অন্যদের ভিন্ন বয়ান তৈরি করা গোয়বলীয় প্রপাগান্ডা ছাড়া অন্যকিছু নয়।

বাঙালিদের মতো বিহারি জনগোষ্ঠীর প্রতিও তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ইতিবাচক ছিল না তা যুদ্ধোত্তর সময়ে দেখা যায়। আজ বিহারি জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে রিফিউজি হিসেবে পড়ে থাকাই তার বড় প্রমাণ। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ধর্মের জুজু তুলে বিহারি জনগোষ্ঠীকে একাত্তরে তাদের হীনস্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করেছেন। ধর্মপ্রাণ সাধারণ বিহারি সম্প্রদায়ের অধিকাংশ বুঝে না বুঝে সেই সময়ে ব্যবহৃত হয়েছেন। তবে যুদ্ধোত্তরকালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চোখে তারা মূল্যহীন হয়ে যান। কারণ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যদি বিহারি জনগোষ্ঠীকে আপন মনে করতেন তাহলে যেকোনও কিছুর বিনিময়ে হলেও তারা তাদের বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করার কথা। আপনজনকে কেউ কখনও এভাবে ভিনদেশে দুর্বিষহ জীবনে ফেলে রাখে কি?

তাই আজমত আশরাফরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিতর্কিত করার বয়ান তৈরি না করে প্রকৃত সত্যের অনুসন্ধান করলেই বরং তার স্বগোষ্ঠী বিহারি সম্প্রদায় প্রকৃত মুক্তির স্বাদ ও সন্ধান পাবে।

লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, নেপাল নিউজ; সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পল্টনে ভবনে আগুন: প্রায় ৪ ঘণ্টার চেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে
পল্টনে ভবনে আগুন: প্রায় ৪ ঘণ্টার চেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে
তেজগাঁওয়ে পুলিশের অভিযানে গ্রেফতার ৭৪
তেজগাঁওয়ে পুলিশের অভিযানে গ্রেফতার ৭৪
আর্সেনালের মাঠে জিতে বোর্নমাউথের ইতিহাস
আর্সেনালের মাঠে জিতে বোর্নমাউথের ইতিহাস
আর্সেনাল ম্যাচের ১০ জনকে বেঞ্চে রেখে লিগে টানা হার পিএসজির
আর্সেনাল ম্যাচের ১০ জনকে বেঞ্চে রেখে লিগে টানা হার পিএসজির
সর্বশেষসর্বাধিক