ওই প্রকারের মানুষ নব্বই দশকের শেষ অবধি সমাজে গুটি কয়েক ছিলেন। আমরা সবাই তাদের চিনতাম। রাজনীতিতে ওই ব্যক্তিরা হাস্যরস বা বিনোদনের জোগান দিতেন। এখন সব মৌসুমে সরকারি দলে এমন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে জনবিস্ফোরণের মতোই। তাদের প্রবৃদ্ধি এতটাই হয়েছে যে, প্রকৃত রাজনৈতিক নেতাকর্মী খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এখন সকলেই সরকারি দলের। তারা দৃশ্যমান। প্রকৃতরা চলে গেছেন ‘দৃশ্যমান’ কর্মী-নেতাদের আড়ালে। এই দৃশ্যমান বা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের ভাষায় ‘কাউয়া’দের মুখোশ খসে পড়ছে প্রায় প্রতিদিন। ‘পরনে মুজিব কোট, বুকে নৌকার ছবি’–ওই প্রজাতিটি শুধু নিজেদের অপরাধ ঢাকতে বা প্রভাব বিস্তার করতেই ব্যবহার করে আসছে।
অতীতে বিএনপি’র সময়েও এমন প্রজাতির হাঁকডাক ছিল। বলা যায় ২০০১ সালের পর থেকে এমন ‘কাউয়া’ প্রজাতির প্রজনন বাড়তে থাকে। এ নিয়ে উভয় দলের অভ্যন্তরে কথা হচ্ছে। তারা বিব্রতও বটে।
‘কাউয়া’ কি কেবল রাজনীতিতেই আছে? সাংবাদিকতায়ও তারা আছেন প্রবলভাবে। সংবাদপত্রের যুগে ছিল। অনেক নাম না জানা সাপ্তাহিক, দৈনিক, মাসিকের সম্পাদক, রিপোর্টার, ফটোগ্রাফাররা সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে বেড়াতেন। সচিবালয়ে ব্রিফকেস সম্পাদক দেখা যেতো। যাদের পত্রিকার সকল অস্তিত্ব ওই ব্রিফকেসের মাঝে ছিল। ফকিরাপুল, দৈনিক বাংলা মোড়ের সেলোফিন ভিত্তিক পত্রিকার কথাও জানা ছিল। সেলোফিন পেপার কিনে ওপরে শুধু পত্রিকার মাস্ট হেড বদলে ফেলা হতো। ছিল শত শত অপরাধ ভিত্তিক পত্রিকার সাংবাদিকদের দৌরাত্ম্য। বেসরকারি টেলিভিশন বিস্ফোরণ ঘটার পরেও নানা রূপের সাংবাদিকরা আত্মপ্রকাশ করতে থাকেন।
গ্রামে-গঞ্জে শহরে এমনকি রাজধানীতেও নানা দফতরে এদের প্রতাপ। এই প্রজাতির সাংবাদিকরা ‘সাংঘাতিক’ বলে চিহ্নিত। অনলাইন ওয়েব পোর্টাল আসার পর এখন বাংলার ঘরে ঘরে অনলাইন পত্রিকা এবং সাংবাদিক। শুধু ওয়েব পোর্টালই নয়, অনলাইন টিভিরও অভাব নেই। কোনও কোনও উপজেলায় ৪/৫টি অনলাইন টেলিভিশন তৈরি হয়েছে। মাইক্রোফোন হাতে তাদের কর্মীরা ছুটে চলছেন। খবরের খোঁজে ছুটছেন কমই, অধিকাংশই সরকারি দফতরের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও সাধারণ মানুষকে হয়রানি, তাদের ভয় দেখানো ও প্রতারণার লক্ষ্য নিয়ে ছুটছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায়ই এমন অনেক সাংবাদিক পরিচয়দানকারীদের দেখা মেলে, যারা এক হালি থেকে শুরু করে এক ডজন গণমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু তাদের পেশা ভিন্ন। সাংবাদিকতার নাম সঙ্গে রাখা, প্রতিপত্তির মাত্রা বাড়ানোর জন্য।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে শিশু চুরি করে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে যে নারী গ্রেফতার হলেন, তিনি শুধু সরকারি দলেরই নয়, গণমাধ্যমের সঙ্গেও জড়িত। তাকে আটক করার পরে তিনি নাকি সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার দাবি করেছেন। উচ্চারণ করেছেন কারও কারও নাম। রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদ গ্রেফতার হবার পরেও আমরা এমন নিদর্শন দেখেছি।
সাংবাদিকতায় ‘সাংঘাতিক’দের অনুপ্রবেশের পেছনে সাংবাদিক সংগঠনগুলোর ভোট নির্ভরতাকে দায়ী করেন অনেকে। ভোট ব্যাংক সমৃদ্ধ করতে অফিস সহকারী থেকে মুদি দোকানিকে সাংবাদিক সংগঠনের সদস্যপদ দেওয়ার অভিযোগও প্রমাণিত। তবে অনিয়ন্ত্রিত অনলাইন পোর্টাল, টিভির কারণে ‘সাংঘাতিক’দের দৌরাত্ম্য এখন ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। এদের জন্য মুশকিল হয়ে উঠেছে পেশাদার সাংবাদিকদেরও কাজ করা। জেলা উপজেলায় পেশাদারদের চেয়ে ‘সাংঘাতিক’দেরই রাজত্ব। রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কমকর্তা এবং সাধারণ মানুষ এই ‘সাংঘাতিক’দের কাছে জিম্মি। পরিচিত বা মূলধারার পত্রিকা, অনলাইন পোর্টাল বা টেলিভিশনের সাংবাদিকরা তুলসি পাতা, এমন দাবি করার সামর্থ্য নেই। কারণ মাঠ পর্যায় থেকে শুরু করে বার্তা কক্ষে এমন কেউ কেউতো আছেনই। এরাও তৈরি হন শিল্পগোষ্ঠীর স্বার্থ হাসিল করার প্রক্রিয়ায়। সকল পেশার মতো এই পেশাতেই নৈতিক স্খলন ঘটে এমন মানুষ নেই, সে কথাও বলা যাবে না। তারা আছেন, হয়তো থাকবেনও। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের নজর রাখতে হবে, তাদের কর্মীরা যেন সাংবাদিকতার চৌকাঠ ডিঙিয়ে সাংঘাতিক না হয়ে উঠেন। একইভাবে অপরাধ জগতের মানুষের সঙ্গেও সখ্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও সকল স্তরের পেশাজীবী সাংবাদিকদের সতর্ক থাকা দরকার। একইভাবে পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে ভোট ব্যাংক বাড়াতে ‘সাংঘাতিক’দের প্রশ্রয় দেওয়া থেকে দূরে থাকতে হবে। তাহলে অন্তত ‘সাংঘাতিক’ অনুপ্রবেশে ভাটা আনা যাবে।
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি