করোনার টিকা বিতরণ ও চ্যালেঞ্জ

আসাদুজ্জামান কাজল
যথাসময়ে দেশে করোনার টিকা পৌঁছাবে কিনা তা নিয়ে দেশে যথেষ্ট তর্ক-বিতর্কের জন্ম হয়েছিল। সর্বশেষ, সকল তর্ক-বিতর্কের আবসান ঘটিয়ে; বাংলাদেশের ক্রয়কৃত টিকা দেশে পৌঁছানের পূর্বেই, গত ২১ জানুয়ারি ভারতের উপহারস্বরূপ দেওয়া ২০ লাখ টিকা বাংলাদেশে পৌঁছেছে। মহামারির এই কঠিন সময়ে বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র ভারত আবারও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ইতিবাচক বার্তা বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিলো।

এছাড়াও, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে নিজেই বলেছেন, আগামী ২৫ বা ২৬ জানুয়ারি নাগাদ ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে ক্রয়কৃত টিকার প্রথম চালান বাংলাদেশে পৌঁছবে। আজও ৫০ লাখ টিকা দেশে পৌঁছেছে। এসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই, বাংলাদেশ যথাসময়ে করোনার টিকা পাবে কী পাবে না সে বিতর্কের অবসান ঘটলো। কিন্তু, ইতোমধ্যে নতুন বিতর্কের জন্ম হয়েছে দেশে। যেটি বেশ উদ্বেগের। কোন জনগোষ্ঠী সর্বপ্রথম এই টিকা গ্রহণ করবে সেটি নিয়ে। ভিআইপিগণ নাকি সাধারণ মানুষ? যদি টিকা গ্রহণের ফলে কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, তাহলে আগে কে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং আগে কে সেটি থেকে শিক্ষা নেবে অর্থাৎ এই ঝুঁকিটি আগে কে গ্রহণ করবে সেটিই এখন বিতর্কের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

যোগাযোগ বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে চলাফেরা করে, বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত ও নিরক্ষর মানুষের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলে; এটুকু বুঝতে সক্ষম হয়েছি যে সরকার প্রধানের আন্তরিক প্রচেষ্টায় দেশে যথাসময়ে টিকা এলেও, প্রথম ধাপে এই টিকা গ্রহণে দেশের একটি বড় অংশ জনগোষ্ঠীর অনিচ্ছা রয়েছে। এমনকি, শিক্ষিত জনগোষ্ঠীও এর অন্তর্ভুক্ত। এই অনিচ্ছার পেছনে যে বিষয়টি সব থেকে বেশি কাজ করছে সেটি হচ্ছে ভয়। সাধারণ মানুষ ভয় পাচ্ছে, এই টিকা গ্রহণের ফলে তাদের শরীরে নানা ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। যেহেতু, এই একই টিকা গ্রহণের ফলে ভারতে হাজারের ওপর মানুষের শরীরে নানা ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে এবং কয়েকজন মারাও গেছে, সুতরাং এই টিকা এ দেশের মানুষের শরীরেও নানা ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি করবে বলে সাধারণ মানুষ ধরেই নিচ্ছে।

তাদের এই ভয় আরও বৃদ্ধি করছে সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো নানা গুজব। অনেকেই নানা ধরনের মিথ্যা কন্টেন্ট তৈরি করে প্রকাশ করছে সামাজিক মাধ্যমে, বিশেষ করে ইউটিউবে। সেখানে তারা দেখাচ্ছে, করোনার টিকা গ্রহণের ফলে নানা ধরনের ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে এবং মানুষ মারা যাচ্ছে; যা সাধারণ ও নিরক্ষর মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। কেননা, সাধারণ মানুষ ছাপার অক্ষর, টেলিভিশন বা ইউটিউবে যা দেখে সেগুলোকে সত্য বলেই ধরে নেয়।

সুতরাং, এই করোনার টিকা যে সাধারণ মানুষ প্রথম পর্যায়ে স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করবে না তা কিছুটা হলেও এখনই বিভিন্ন আলোচনা থেকে বোঝাই যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে, কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন, তাঁরা যে বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তিত বা ভয় পাচ্ছে সেগুলোই দূর করতে হবে।

প্রথমত, এই টিকা দেশের সরকার প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সবার আগে গ্রহণ করতে পারে, যেমনটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘটেছে। সেসব দেশের প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি সবার আগে টিকা গ্রহণ করেছেন। পরবর্তীতে, চিকিৎসক, শিক্ষক, সাংবাদিক, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা গ্রহণ করতে পারেন। এর ফলে, সাধারণ মানুষ আশ্বস্ত হবেন যে এই টিকায় সমস্যা থাকলে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সবার শুরুতে গ্রহণ করতো না, যা তাদের বিদ্যমান ভয় কাটিয়ে টিকা গ্রহণে আগ্রহী করবে।

দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রপ্রধান টিকা গ্রহণ করবেন এবং সাধারণ মানুষকে টিকা নিতে আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য দিতে পারেন। এক্ষেত্রে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবথেকে উত্তম হতে পারেন। কেননা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি দেশের মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা অগাধ। এটি অন্য কোনও মন্ত্রী বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি দিয়ে সম্ভব হবে না।

তৃতীয়ত, সাধারণ মানুষ ভয় পাচ্ছে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে। তথ্য না লুকিয়ে সহজ ভাষায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়গুলো বিস্তারিত প্রচার করতে হবে। নানা প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে যেকোনও টিকাতেই শরীরে ছোটখাটো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে, যেমনটি শিশুদের নানা রোগের টিকা দেওয়ার পরও আমরা লক্ষ করি তাদের জ্বর হয় বা শরীর ব্যথা হয়। সুতরাং, এই টিকা গ্রহণে ব্যক্তিভেদে ছোটখাটো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে সেটি মোটেই ভয়ের কিছু নয়।

চতুর্থত, যেহেতু সাধারণ মানুষ ভারতের ঘটনাগুলো নিয়ে বেশি ভয় পাচ্ছে সেহেতু ভারতের ঘটনাগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা ও সেগুলোর প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন, ভারতে যে ব্যক্তিটি মারা গেছে সে সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকা গ্রহণ করেনি। সে মানব শরীরে পরীক্ষাধীন 'কোভ্যাক্সিন' নামের টিকা গ্রহণ করেছিল। পাশাপাশি, যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো দেখা যাচ্ছে, সেগুলো খুব বড় কিছু নয়, অন্যান্য টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মতোই।

পঞ্চমত, এই টিকা বিতরণ করা যেতে পারে হাসপাতাল থেকে, যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি টিকা গ্রহণের পর নির্দিষ্ট কিছু সময় অপেক্ষা করবে ওই হাসপাতালেই। যাতে কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে সাথে সাথে চিকিৎসক সেটার প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। এক্ষেত্রে, জেলার সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নির্ধারণ করা যেতে পারে। চিকিৎসার নিশ্চয়তা পেলে সাধারণ মানুষ টিকা গ্রহণে আগ্রহী হবে।

ষষ্ঠত, যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিয়ে সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে, যদিও দেশে এই টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানো হয়নি তবু এটি এই দেশের মানুষের জন্য কার্যকর হবে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেটি নিশ্চিত করছে। পাশাপাশি তাদের বোঝাতে হবে, বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের হার কম হলেও অতি দ্রুত এই টিকা সকলের গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে, যেকোনও সময় সংক্রমণ বাড়তে পারে।

সর্বশেষ ও সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ, সামাজিক মাধ্যমের গুজব প্রতিহত করতে হবে এবং অধিক ও কার্যকর প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে টিকা গ্রহণে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সবথেকে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে। যারা টিকা গ্রহণ করবে তাদের তথ্য ও ছবি দিয়ে বাস্তব চিত্র প্রকাশ করতে হবে। টিকা গ্রহণ করলে শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে কিনা, যাদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে, সেগুলো কেমন এবং সেটার বিপরীতে কী চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, তা দেখাতে হবে।

এককথায়, সত্য ও সঠিক তথ্য পরিবেশনের মাধ্যমে মানুষকে টিকা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাদের মনের বিদ্যমান ভয় ও সংশয় দূর করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে, করোনা প্রতিরোধে সকলের মাস্ক পরা যেমন জরুরি তেমনি টিকা গ্রহণও জরুরি। যে টিকা গ্রহণ করবে না তার জন্য এটি ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হতে পারে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

md.asaduzzaman90@yahoo.com