স্বপ্নের ইস্তফাপত্র

তুষার আবদুল্লাহসদ্য প্রয়াত সাংবাদিক, গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের একটি ইস্তফাপত্র অবয়বপত্রে ভেসে বেড়াচ্ছে। আমার নজরে আসেনি। বেশ পুরনো এক সহকর্মী জানতে চাইলেন, ওই ইস্তফাপত্রটি আমার নজরে এসেছে কিনা? যদি এসে থাকে তবে তিনি বা আমরা কেন এমন ইস্তফাপত্র লিখতে পারি না। আমি প্রশ্নটির কোনও উত্তর দেইনি। নিরবতা পালন করি। এমন নয় যে উত্তরটা আমার অজানা। কিংবা যিনি প্রশ্ন করেছেন, তাঁরও অজানা। আমার দিক থেকে কিছু একটা শুনতে চাওয়াই মূলত তাঁর উদ্দেশ্য। আমি চুপচাপ ছিলাম। কিন্তু ক্রমশ দেখছি দেশ-বিদেশের অনেক সহকর্মী ইস্তফাপত্রটি অন্দরবাক্সতে পাঠাতে শুরু করেছেন। কেউ কেউ বিভিন্ন মন্তব্য জুড়ে দিচ্ছেন। গণমাধ্যমের বাইরের দু’একজনও পাঠিয়েছেন। আসলে সৈয়দ আবুল মকসুদের ইস্তফাপত্রের যে প্রতিপাদ্য তা শুধু গণমাধ্যমে বিরাজমান নয়। বাংলাদেশের সদ্য বিস্ফোরিত শিল্পগোষ্ঠী থেকে শুরু করে ছোট খাটো প্রতিষ্ঠানেরও চিত্র এটি। বাংলাদেশে যারা আশি বা নব্বই দশকে মানবাধিকারের পবিত্র বানী ছড়িয়েছে, বিদেশি অনুদানপুষ্ট সেই এনজিওগুলোতেও দেখেছি একনায়কতন্ত্রের নিষ্পেষণ। এনজিও কর্তারা নিজেরা একনায়কের ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে সরকার বা সরকারি দফতরের একনায়োচিত পরিস্থিতির সমালোচনায় তুখোড় ছিলেন। সেই সব প্রতিষ্ঠানে ‘ভৃত্যগিরী’ করা অসংখ্য বন্ধু ও অগ্রজদের দেখেছি বুক পকেটে এমন ইস্তফাপত্র নিয়ে ঘুরতে। কম্পিউটার আসার পর অনেকেই একাধিক ইস্কফাপত্র ডেক্সটপে ছ্দ্মনামে রেখে দিয়েছেন। নিষ্পেষণ, পীড়ন বাড়লে একবার ক্লিক করে দেখে নেন, এই দেখে নেওয়াটাই এক ধরনের প্রশান্তি। শেষ পর্যন্ত এমন ইস্তফাপত্র হয়তো দেওয়া হয় না। শেষ পর্যন্ত লিখতে হয় ব্যক্তিগত কারণে চাকরি ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রকৃত কারণ লিখতে না পারার কারণ– আরেকটি চাকরি। সকলের পারিবারিকভাবে আয়ের ভিন্ন উৎস থাকে না। তাই আরেকটি চাকরির লোভে সত্য কথা বুক পকেটেই রয়ে যায়। এক নায়করা প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে জোটবদ্ধ, একজন চটলে, চাকরির বাজারে সকলেই চটে যেতে পারে। এবং চাকরি দিতে অস্বস্তিবোধ করতে পারে। তাই কী দরকার, ভৃত্যের বিপ্লবী হওয়ার, এই মন্দা বাজারে।

আমারও চাকরির বয়স কম হয়নি। প্রায় এক কুড়ি প্রতিষ্ঠানের স্বাদ নেওয়া হয়েছে। বিচিত্র সেই অভিজ্ঞতা। ভৃত্যদের সঙ্গে একনায়কোচিত আচরণ করেননি এমন মালিক পেয়েছি জনা চারেক। বাকিরা সকলেই শুধু ওই প্রতিষ্ঠানের নন, যেন এই দো-জাহানেরই মালিক। কোথাও কোথাও মালিক সত্যিই নিরাকার ছিলেন। দৃশ্যমান হননি। কিন্তু ভৃত্যদের মধ্যে কেউ কেউ রাজ ভৃত্য হয়ে ওঠেন। মালিকের দোহাই দিয়ে তারাই অন্য ভৃত্যদের ওপর অমানবিক ও পেশাদার আচরণ করতে থাকেন। মালিকারা এসব ঘটনা জেনেও নিরব ছিলেন। প্রতিষ্ঠান ভেঙেও পড়েছে কোনও কোনোটা, সেজন্য দায়ী মালিকেরা নন। ভৃত্যদের ‘কাইজ্জা’ই দায়ী। এসব জায়গায় কাজ করতে গিয়ে আমি নিজেও যে ইস্তফাপত্র অগ্রীম লিখে রাখিনি তা নয়। ক্ষোভের প্রকাশ ঘটাতে লিখেছি। কোনোটি ছিঁড়ে ফেলেছি, ডিলিট করেছি। দু’একটি রয়েও যেতে পারে। কোনও ইস্তফাপত্রই দেওয়া হয়নি। শুধু যে আরেকটি চাকরির লোভেই আমরা মূল কারণ দেখিয়ে ইস্তফাপত্র লিখি না তা নয়, অনেক সময় প্রতিষ্ঠানের জলবায়ু ঠিক রাখতেও লেখা হয় না। অনেক আলোচিত সরকারি, বেসরকারি কর্তার কথা জানি, তাঁরা প্রতিষ্ঠান ও কাঠামোর স্বার্থে যা লেখার কথা ছিল তা লিখতে পারেননি।

আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো এক প্রজন্ম কোনোভাবে টিকে থাকে। তারপর বেশিরভাগই ঝুর ঝুর করে ভাঙে। প্রতিষ্ঠান যিনি গড়েন, তিনি তো প্রভু হয়ে উঠেন। আমার আমার বলে চিৎকার করতে থাকেন। ভৃত্যরা একমুখি প্রভুত্ব মেনে নেয়। কিন্তু যখন সেই ‘প্রভু’র উত্তরাধিকাররা আসেন, একাধিক উত্তরাধিকার বা একক তারাও আমার আমার বলে বিলাপ করতে থাকে। ভৃত্যরা তখন মুশকিলে পড়ে যায়। কার হাত ধরবে, কার ‘প্রভুত্ব’ গ্রহণ করবে? ব্যস! এনিয়ে হট্টগোল। আইল ভাগাভাগি। আবার কোথাও কোথাও ভৃত্যও মনিব সাজার সুযোগ পায়। তখন তার আর ভৃত্যকালের কথা মনে থাকে না। আমিত্বের সিংহাসনে বসে, অন্ধ রাজার পরিণত হন। মেতে উঠেন প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের খেলায়। আশির দশক থেকে এঅবধি বেশ কয়েকটি সম্ভাবনাময় উদ্যোগের এমন অপচয় দেখেছি।

গণমাধ্যমের বন্ধুরা ভাবেন, তারাই হয়তো এমন অস্থিরতার মাঝে আছেন। আসলে তা নয়। অন্যান্য পেশারও একই হাল। কবে যেন একটি ইস্তফাপত্র লিখেছিলাম কবিতার মতো আদরে- আমি বলছি আমাদের, তুমি বলো আমার। এমন যোজন দূরত্বে যৌথ খামার গড়া হয় না। অতএব...

যৌথ খামার আমাদের দেশে একেবারেই গড়া হয়নি বা নেই এমন বলে হতাশায় ডোবাবো না। ছোট-বৃহৎ কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠী ও উদ্যোগের কথা জানি, যেখানে আমি, আমার বলে কোন বজ্রপাত নেই। আছে ‘ আমাদের’ দখিনা হাওয়া । যেখানে মালিক ভৃত্য সকলেই সুখে আছেন । আমাদের দেশ এমন যৌথ খামারে ভরে যাক। তখনও হয়তো ইস্তফাপত্র লিখবো, কবিতার মতোই লিখবো- এক ভালোবাসা থেকে অন্য এক ভালোবাসায় যেতে মন টানছে বেশ, যাবো?

লেখক: গণমাধ্যম কর্মী