আমারও চাকরির বয়স কম হয়নি। প্রায় এক কুড়ি প্রতিষ্ঠানের স্বাদ নেওয়া হয়েছে। বিচিত্র সেই অভিজ্ঞতা। ভৃত্যদের সঙ্গে একনায়কোচিত আচরণ করেননি এমন মালিক পেয়েছি জনা চারেক। বাকিরা সকলেই শুধু ওই প্রতিষ্ঠানের নন, যেন এই দো-জাহানেরই মালিক। কোথাও কোথাও মালিক সত্যিই নিরাকার ছিলেন। দৃশ্যমান হননি। কিন্তু ভৃত্যদের মধ্যে কেউ কেউ রাজ ভৃত্য হয়ে ওঠেন। মালিকের দোহাই দিয়ে তারাই অন্য ভৃত্যদের ওপর অমানবিক ও পেশাদার আচরণ করতে থাকেন। মালিকারা এসব ঘটনা জেনেও নিরব ছিলেন। প্রতিষ্ঠান ভেঙেও পড়েছে কোনও কোনোটা, সেজন্য দায়ী মালিকেরা নন। ভৃত্যদের ‘কাইজ্জা’ই দায়ী। এসব জায়গায় কাজ করতে গিয়ে আমি নিজেও যে ইস্তফাপত্র অগ্রীম লিখে রাখিনি তা নয়। ক্ষোভের প্রকাশ ঘটাতে লিখেছি। কোনোটি ছিঁড়ে ফেলেছি, ডিলিট করেছি। দু’একটি রয়েও যেতে পারে। কোনও ইস্তফাপত্রই দেওয়া হয়নি। শুধু যে আরেকটি চাকরির লোভেই আমরা মূল কারণ দেখিয়ে ইস্তফাপত্র লিখি না তা নয়, অনেক সময় প্রতিষ্ঠানের জলবায়ু ঠিক রাখতেও লেখা হয় না। অনেক আলোচিত সরকারি, বেসরকারি কর্তার কথা জানি, তাঁরা প্রতিষ্ঠান ও কাঠামোর স্বার্থে যা লেখার কথা ছিল তা লিখতে পারেননি।
আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো এক প্রজন্ম কোনোভাবে টিকে থাকে। তারপর বেশিরভাগই ঝুর ঝুর করে ভাঙে। প্রতিষ্ঠান যিনি গড়েন, তিনি তো প্রভু হয়ে উঠেন। আমার আমার বলে চিৎকার করতে থাকেন। ভৃত্যরা একমুখি প্রভুত্ব মেনে নেয়। কিন্তু যখন সেই ‘প্রভু’র উত্তরাধিকাররা আসেন, একাধিক উত্তরাধিকার বা একক তারাও আমার আমার বলে বিলাপ করতে থাকে। ভৃত্যরা তখন মুশকিলে পড়ে যায়। কার হাত ধরবে, কার ‘প্রভুত্ব’ গ্রহণ করবে? ব্যস! এনিয়ে হট্টগোল। আইল ভাগাভাগি। আবার কোথাও কোথাও ভৃত্যও মনিব সাজার সুযোগ পায়। তখন তার আর ভৃত্যকালের কথা মনে থাকে না। আমিত্বের সিংহাসনে বসে, অন্ধ রাজার পরিণত হন। মেতে উঠেন প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের খেলায়। আশির দশক থেকে এঅবধি বেশ কয়েকটি সম্ভাবনাময় উদ্যোগের এমন অপচয় দেখেছি।
গণমাধ্যমের বন্ধুরা ভাবেন, তারাই হয়তো এমন অস্থিরতার মাঝে আছেন। আসলে তা নয়। অন্যান্য পেশারও একই হাল। কবে যেন একটি ইস্তফাপত্র লিখেছিলাম কবিতার মতো আদরে- আমি বলছি আমাদের, তুমি বলো আমার। এমন যোজন দূরত্বে যৌথ খামার গড়া হয় না। অতএব...
যৌথ খামার আমাদের দেশে একেবারেই গড়া হয়নি বা নেই এমন বলে হতাশায় ডোবাবো না। ছোট-বৃহৎ কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠী ও উদ্যোগের কথা জানি, যেখানে আমি, আমার বলে কোন বজ্রপাত নেই। আছে ‘ আমাদের’ দখিনা হাওয়া । যেখানে মালিক ভৃত্য সকলেই সুখে আছেন । আমাদের দেশ এমন যৌথ খামারে ভরে যাক। তখনও হয়তো ইস্তফাপত্র লিখবো, কবিতার মতোই লিখবো- এক ভালোবাসা থেকে অন্য এক ভালোবাসায় যেতে মন টানছে বেশ, যাবো?
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী