আমি বরাবরই বলি আম মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা নেই। তারা একে-অপরের কাঁধে কাঁধ রেখে চলে। এক উঠোনে বসবাস। বাস্তবতা যেমন এমন। তেমনই এর উল্টো দিকটাও আছে। সকল ধর্মের মধ্যে যে পারস্পরিক উদারতা ও সৌহার্দ্যের কথা বলা হয়েছে সেটা ধীরে ধীরে সংকীর্ণ হয়ে আসছে। আমরা স্বাধীনতার মাস অতিবাহিত করছি। উদযাপন করছি স্বাধীনতার ৫০ বছর। আমরা যদি একাত্তরের জনযুদ্ধের কথা বলি, সেখানে মুসলমানকে ঠাঁই দিয়েছে হিন্দু পরিবার। হিন্দুকে ঠাঁই দিয়েছে মুসলমান ঘর। আমাদের শিক্ষাজীবনে দেখেছি হিন্দু, খ্রিষ্টান, মুসলমান বন্ধু ও শিক্ষকদের মধ্যকার সম্প্রীতি। সেই সম্প্রীতির বন্ধন এখনও অটুট।
কিন্তু ভেতরে ভেতরে ক্ষয় রোগ শুরু হয়েছে। উভয় দিক থেকেই। শহরে শহরে বইমেলা করতে গিয়ে শিশু-কিশোরদের সঙ্গে কথা বলা হয়, আড্ডা হয়। ওদের কাছ থেকেই জানা– পরিবার থেকে বলা হয় হিন্দু বন্ধুর সঙ্গে মেলামেশা না করতে। হিন্দু পরিবার থেকেও এমন বলা হয় বলে শুনি। একাজটি অভিভাবকরাই করছেন। তারা সন্তানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে দিচ্ছে। ঢাকা শহর কিংবা অন্য শহর ঘুরতে গিয়ে দেখেছি, আমরা সকলেই জানি অন্য ধর্মের পরিবারকে ভাড়া দেওয়ার বেলাতেও বিধি-নিষেধ বাড়ছে। আমরা সকল ধর্মের মানুষেরাই ভুলে বসে আছি, এই সমাজে আমরা সকল ধর্মের মানুষেরা বাস করি। দেশটি মুসলমান প্রধান বলেই, অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সামাজিক ভাবে যদি বলি সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে অহেতুক কট্টর মনোভাব বাড়ছে। কারণটা হলো নিজ ধর্মকে কম জানা। আমরা সকলে যদি ধর্মের প্রকৃত অনুসরণ করি, তাহলে একে-অপরের বিরুদ্ধে কোনোভাবেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবো না। আমাদের মধ্যে ভালোবাসা ফিরে আসবে আগের মতো। আমাদের মনে রাখতে হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ যে, তার দায়িত্বশীলতা এবং সমাজের প্রতি দায় বেশি। সুতরাং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে আমাদের সেই পরিচয়ের প্রকাশ প্রয়োজন। ১৯৪৭ থেকে এ পর্যন্ত যত দাঙ্গা বা হত্যা, সেখানে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে লোভ চরিতার্থ করতে। আসলে লোভই সকল সর্বনাশের কারণ। এই সর্বনাশ থেকে স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে আমাদের মুক্তি ঘটুক।
এই মুক্তির নেতৃত্ব দিতে হবে একদিকে যেমন রাজনৈতিক দলগুলোকে, তেমনই সাংস্কৃতিক কর্মীদেরও। ভোটের লোভে রাজনৈতিক দলগুলোর ধর্ম নিয়ে দাবা খেলা বন্ধ করতে হবে। দলের আর্দশের বাইরে গিয়ে ভণিতা করার প্রয়োজন নেই। দলের আদর্শ যদি অটল, মজবুত ও উদারপন্থী হয় তবে ভোট নিয়ে দুঃশ্চিন্তা বা ছলের দাবা খেলার প্রয়োজন পড়বে না। আমরা দেখছি সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও দলীয় লেজুড়বৃত্তি করতে গিয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে বিসর্জন দিয়ে বসে আছে। ফলে সর্বোপরি সমাজ এক সংকীর্ণ গলিতে প্রবেশ করেছে। সেই গলিপথ থেকে আবার চিন্তার মহাসড়কে না ফেরা পর্যন্ত, আলোর দেখা মিলবে না।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী