হাসপাতালের মুমূর্ষু বিছানায় চেতন-অচেতনে প্রিয় কোনও মুখ বা স্পর্শের হাহাকার নিয়ে চলে গেলেন, যাচ্ছেন কতজন। অবয়বপত্র এখন বিদায় যাত্রার নোটিশপত্র আর শোক বইতে রূপ নিয়েছে। এইতো সেদিন যার সঙ্গে হেঁটেছি বই মেলায়, টেলিফোনে হুলুস্থুল আড্ডা কিংবা তার কোনও কাজে আপ্লুত হয়েছি, আচমকা সেই মানুষটিই যেন বললেন– এবার যাই। আমরাও জীব, আমরা ভোল পাল্টে ফেলি দ্রুতই, তার চেয়েও দ্রুত সংখ্যায় নিজেকে পাল্টে ফেলছে অদৃশ্য অনুজীব। তার এই সক্ষমতার কাছেই আমাদের পরাজয়।
প্রথমধাপে ইতিবাচকতা কূল পায়নি। ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবেও। ভুল-ত্রুটি পেরিয়ে মনে হচ্ছিল অনুজীবটিকে বাড়ির তেলাপোকার মতোই বাগে আনতে পেরেছি। তাই শুরু হলো হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে যাপন। হলাম স্মৃতিভ্রষ্ট। ২০২০ এ পৃথিবী এবং স্বদেশে মানুষের বিপন্নতা ও হাহাকারের কথা ভুলে গিয়েছিলাম। অদৃশ্য অনুজীব সুযোগটা নিলো। নানা দেশে তার যে রকমারি রূপ প্রকাশ পেয়েছিল, তা নিয়ে আবার হাজির। আমরা তার জন্য আকাশ উন্মুক্ত রেখেছিলাম। হেসে-খেলে তার অবতরন হয়েছে। এবং সকল রূপ নিয়ে অসুর শক্তি নিয়ে এবার হামলে পড়েছে আমাদের ওপর। জীব হিসেবে টিকা টিপ্পনী দিয়েও নিজেদের সক্ষম করতে পারিনি আমরা। আরো অনেক ধাপ বাকি। তবে প্রথম ধাপেই অনেক অবহেলা ছিল। ব্যক্তিগতভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলাম।
প্রতিরোধের ঢালগুলো ফেলে দিয়েছিলাম। দূরত্ব কমিয়ে হয়েছিলাম সামাজিক ঘনিষ্ঠতায় বুঁদ। অনুজীব এই ঘনিষ্ঠতাকে নিজের ঘনিষ্ঠ হওয়ার কাজে লাগালো। আমরা দ্রুত ধরাশায়ী হতে শুরু করি। মৃত্যু সদর রাস্তা থেকে দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে। বহুরূপের এই শক্তি চিকিৎসকদের কাছে অজ্ঞাত। কিছুটা গোপনীয়তাও রক্ষা করা হচ্ছে তার রূপ ও বিস্তারের। বিশ্বের কোথাও একে নিমিষেই হারিয়ে দেওয়ার পরীক্ষিত ফর্মুলা আবিষ্কার হয়নি। ফলে চলছে আনতামারি চিকিৎসা। একেক চিকিৎসক, একেক রকম ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন। কারো কারো ব্যবস্থাপত্রে আতঙ্কে বাঁধানো। স্বাস্থ্য বিভাগের গাইড লাইন বা প্রটোকল ছাড়াই চলছে চিকিৎসা। মানসিকভাবে এজন্য আক্রান্তদের অনেকেই এজন্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন। অবয়বপত্রে চোখ রাখলে নিজেকে আরো বিপন্ন মনে হয়। আতঙ্ক আরো জাপ্টে ধরে। প্রমাণিত বিষয় ছাড়া অনেক ভুল তথ্যও ঘুরে বেড়াচ্ছে অবয়বপত্রে।
অদৃশ্য অনুজীবের রাজত্ব ও তার প্রতাপ অনেকদিন চলবে আমরা জানি। তারপরও হাসপাতালগুলোতে পৃথক বিছানা ও পর্যাপ্ত অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা যায়নি। আছে আইসিইউ সংকটও। সঙ্গ নিরোধ থাকার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাগুলোও নাকি বিনা ঘোষণায় গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে। আমরা নিজেদেরকে নিজেরা ফাঁকি দিয়ে বিপদ অনিবার্য করেছি। তাই লকডাউন, নিষেধাজ্ঞা নানা শব্দের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা ও অর্থ খুঁজছি। জনসংখ্যা বহুল দেশটাকে সাধারণ ছুটি ও লকডাউনের আওতায় আনার ফলাফল আমরা জানি। শুধু দিন মজুর ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাই নন, অনেক বড় ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীরাও কাজ হারিয়েছেন। বিনিয়োগের নানা ক্ষেত্র স্থবির হয়ে আছে। ২০২০ এর পহেলা বৈশাখ, রমজান ও দুই ঈদে ব্যবসা সচল রাখা না যাওয়ার পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে ওঠা যায়নি। তাই নিশ্চিত আয় ও রোজগারের মানুষটি যত সহজে লকডাউনের দাবি তুলতে পারেন, অন্যজনের কাছে তা ততই কঠিন। সরকারকেও তাই নানা দিক বিবেচনায় এজন্য ছাড়ও দিতে হয়। ফলে লকডাউনের বিভিন্ন সংজ্ঞা ও চরিত্র তৈরি হয়। বাজারে কোভিড সচেতনতা ঢেকে যায় অযথা বিতর্কে। তবে সরকার যদি সকল দফতরের সঙ্গে সমন্বয় করে নির্দেশনা বাস্তবায়নে ঠিক সময়ে মাঠে নামতো, তাহলে এখনকার পরিস্থিতির মুখোমুখি আমরা নাও হতে পারতাম। এখনকার বহুরূপী অনুজীবের সঙ্গে শরীরে নেওয়া টিকা কতটা লড়াই করতে পারবে এই তর্ক শুধু দেশ নয়, বিশ্ব জুড়ে।
তারপরও লড়াইয়ের মাঠ থেকে ফিরতে চাই না। নানা রকম ক্ষত রেখে যাওয়া দেহ নিয়েও সুস্থ জীবনে ফিরছেন ৯৯ ভাগ মানুষ। জীবনের ভরসা সেখানেই। ব্যক্তির এই ভরসায়, সমাজ ও রাষ্ট্রকেও চাঙ্গা থাকতে হবে। সামান্য অবহেলার সুযোগ দেওয়া যাবে না চতুর অনুজীবকে। নিজের সুরক্ষাকে রাষ্ট্রের সুরক্ষার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। রাষ্ট্রকে ফুটবল মাঠের বিচক্ষণ স্ট্রাইকারের মতো বা রক্ষণভাগের খেলোয়াড়ের মতো পরিস্থিতি মোকাবিলায় যুত্সই ‘কিক’টি নিতে হবে। না হলে এই যে ব্যক্তি হবে কন্যার চেয়ে যোজন ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছি, পুত্রের ছবি ভাসে ভিডিও কলে, স্ত্রীর সঙ্গে লুকোচুরি দেখা, বাবা- মা চোখের সীমানার বাইরে, এই জীবন এই কষ্ট বুঝি মৃত্যুর চেয়েও যন্ত্রণার। এই যন্ত্রণার কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার সম্মিলিত ইতিবাচক উদ্যোগ ও চেষ্টা জরুরি।
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী