পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যালের গোডাউন কেন সরে না?

আমীন আল রশীদনিমতলী, চুড়িহাট্টা হয়ে এবার আরমানিটোলা। পুরান ঢাকার সবশেষ ট্র্যাজেডি। এবারও খলনায়কের নাম কেমিক্যালের গোডাউন। আবাসিক ভবনের নিচে কেমিক্যালের গোডাউন নাকি কেমিক্যালের গোডাউনের উপরে আবাসিক ভবন; মানুষ কেন কেমিক্যালের গোডাউন থাকার পরও সেসব ভবনে বাসা ভাড়া নেয়; তারা কি জেনে-বুঝেই এসব ভবনে বাসা ভাড়া নেয় নাকি এসব ভবনের নিচে যে গোডাউন রয়েছে, সেই তথ্য তারা জানেন না—এসব তর্ক পাশে রেখে যে প্রশ্নটি বারবারই সামনে আসে তা হলো, এত এত প্রাণহানি এবং সরকারের নানাবিধ উদ্যোগের পরেও পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যালের গোডাউন কেন সরছে না? আবাসিক ভবনে কীভাবে এরকম গোডাউন তৈরি করা হয়? কেমিক্যালের ব্যবস্থাপনায় যে ধরনের প্রশিক্ষিত জনবল, বিশেষ করে কেমিস্ট থাকার কথা, তা কি পুরান ঢাকার এসব ভবনে রয়েছে?

২৩ এপ্রিল ভোর রাত। পুরান ঢাকার আরমানিটোলার মানুষের ঘুম ভাঙে আগুনের লেলিহান শিখা আর মানুষের চিৎকারে। গণমাধ্যমের খবর বলছে, ভোর রাত সোয়া তিনটার দিকে হাজী মুসা ম্যানশন নামে ছয়তলা ওই ভবনে আগুন লাগে। এতে অন্তত চার জন নিহত হন। আহত হন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীসহ অন্তত ১৮ জন। ভবনের নিচে রাসায়নিকের গুদাম ছিল। তবে শুধু এই ভবনটি নয়, আশপাশের আরও অনেক ভবনেই এরকম গুদাম রয়েছে।

বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, পুরান ঢাকায় ২৫ হাজারেরও বেশি কেমিক্যালের গোডাউন রয়েছে। এরমধ্যে অনুমোদিত মাত্র আড়াই হাজার। ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে ঘটে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনা। এতে প্রাণ হারান ১২৪ জন মানুষ। এর ৯ বছর পর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ঘটে আরেক মর্মান্তিক ঘটনা। যাতে প্রাণ হারান ৮০ জনের বেশি। এই সবগুলো ঘটনার জন্য দায়ী কেমিক্যাল বা রাসায়নিকের গুদাম।

প্রতিটি দুর্ঘটনার পরেও পুরান ঢাকাকে কেমিক্যালের গোডাউনমুক্ত করার আশ্বাস দেওয়া হয়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও এই সুপারিশ থাকে। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি হয়েই পুরান ঢাকার বাতাসে ওড়ে। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১১ সালের ২০ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে ঢাকা মহানগরের আবাসিক এলাকা থেকে অবৈধ রাসায়নিক কারখানা ও গুদামগুলো কামরাঙ্গীরচর ও কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এজন্য বিসিকের চেয়ারম্যানকে প্রধান করে একটি এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবকে প্রধান করে আরেকটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ২০১৪ সালের ৩ জুন শিল্প সচিব বলেছিলেন, কেমিক্যাল পল্লিতে সাততলা ১৭টি ভবন তৈরি করে গুদাম সরানো হবে। পরের বছর ২ ফেব্রুয়ারি কেরানীগঞ্জে ২০ একর জায়গায় পল্লি স্থাপন করার কথাও বলেন তিনি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখনও পুরান ঢাকায় হাজার হাজার কেমিক্যালের গোডাউন রয়েছে এবং এর অধিকাংশই অবৈধ।

২০১৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকন বেশ জোর দিয়েই বলেছিলেন, পুরান ঢাকায় কোনও কেমিক্যালের গোডাউন থাকবে না। তিনি বলেন, এসব দাহ্য পদার্থের গোডাউন উচ্ছেদের জন্য কঠোর থেকে কঠোরতর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এবার আরমানিটোলায় আগুনের পর ঢাকা দক্ষিণের বর্তমান মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসও পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যালের গোডাউন না সরায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কেমিক্যাল গোডাউনের লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করেও সরকারের অন্য দফতরের নিষ্ক্রিয়তায় এগুলো সরানো যাচ্ছে না। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের থেকে বাণিজ্য অনুমতি ছাড়াই তারা কীভাবে রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি করে, কীভাবে গুদামজাত করে এবং কীভাবে তারা ব্যবসা পরিচালনা করে চলেছে, তা খুবই অবাক কাণ্ড। দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ যতক্ষণ না এটাকে একটি সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব হিসেবে সময়লব্ধ অনুযায়ী কাজ না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত এটা সমস্যা।

মেয়রের কথায় ক্ষোভ ও হতাশা স্পষ্ট। বাস্তবতা প্রশ্ন হলো, পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী ও কেমিক্যাল গোডাউনের মালিকরা আর্থিকভাবে শক্তিশালী। তারা রাজনৈতিকভাবেও ক্ষমতাবান। তারা ঐক্যবদ্ধ। ফলে সরকার চাইলেও তাদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিতে পারে না বা সরকারি সিদ্ধান্ত তারা না মানলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনও ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মানুষের জীবনের বিনিময়ে কোনও ব্যবসা হয় না। ব্যবসায়ীদেরও মনে রাখতে হবে, তারা রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি শক্তিশালী নন। রাষ্ট্রের চেয়ে কেউই যে বেশি শক্তিশালী নয়, সম্প্রতি কট্টরপন্থী ধর্মীয় সংগঠন হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ তার প্রমাণ। সুতরাং, পুরান ঢাকার মানুষের জীবনের নিরাপত্তায় সেখান থেকে অবৈধ কেমিক্যালের গোডাউন সরাতেও সরকারের কঠোর হওয়ার কোনও বিকল্প নেই। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। আরও স্পষ্ট করে বললে সরকারপ্রধানের সিদ্ধান্ত।

প্রতিটি দুর্ঘটনার পরেই মামলা হয়। কিন্তু বিচার শেষ হয় না। আরমানিটোলার ঘটনায়ও ভবনের মালিকসহ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে মামলা হয়েছে। অবহেলা জনিত মৃত্যু ও অবৈধভাবে রাসায়নিক দ্রব্য রাখার দায়ে ভবনের মালিক মোস্তাক আহমেদসহ ৭ থেকে ৮ জনের নাম উল্লেখ করে এবং আরও ১৫ থেকে ২০ জন অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলাটি দায়ের করেছে বংশাল থানা পুলিশ।

কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলে, এই মামলায় খুব বেশি কিছু হবে না। কারণ এর আগে একইভাবে চুড়িহাট্টায় ৮০ জন এবং নিমতলীতে ১২৪ জনের প্রাণহানি হলেও সেসব ঘটনায় বিচার শেষ হয়নি। চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তও এগোচ্ছে না। তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য দফায় দফায় তারিখ দিয়ে যাচ্ছেন আদালত। তদন্তের এই গতিতে হতাশ মামলার বাদী মো. আসিফ গণমাধ্যমকে বলেছেন, মামলার তদন্তের অগ্রগতির কোনও খবর তার কাছে নেই। তার সঙ্গে তদন্ত কর্তৃপক্ষ যোগাযোগও করছে না। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, নিমতলীর ঘটনায় কোনও মামলা হয়নি। বরং বংশাল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছিল। সেটিরও তদন্ত হয়নি। এত বড় একটি ঘটনা, যেখানে ১২৪ জন মানুষের প্রাণহানি হলো, সেই ঘটনায় কেন হত্যা মামলা হলো না– সেটিরই বরং বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া দরকার।

এসব ঘটনায় বহু মানুষের প্রাণহানি হলেও দায়ীদের বিরুদ্ধে সরাসরি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়নি। অথচ কেমিক্যালের অবৈধ গুদামে বিস্ফোরণের কারণে যেসব মানুষের প্রাণহানি হলো, এগুলো স্পষ্টই হত্যাকাণ্ড। সুতরাং এসব ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের এবং দ্রুত বিচার করা না গেলে পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যালের গোডাউন সরবে না।

প্রতিটি দুর্ঘটনার পরই সরকার বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের তরফে কিছু ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দেওয়া হয়। প্রশ্ন হলো, মৃত্যুর কি ক্ষতিপূরণ হয়? নিমতলী, চুড়িহাট্টায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তারাই বা কী ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন? সবচেয়ে বড় কথা কেমিক্যালের উৎপাদন, বিপণন, বিক্রি ও গুদামজাত করার বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। আবাসিক ভবনে কোনোভাবেই কেমিক্যালের গোডাউন থাকতে পারে না। কেমিস্ট এবং প্রশিক্ষিত জনবল ছাড়া এসব গোডাউন পরিচালনা ও ব্যবসা চলতে পারে না।

নিমতলী ট্র্যাজেডির পরে যে তদন্ত কমিটি হয়েছিল, তাদের সুপারিশগুলো যে বাস্তবায়িত হয়নি, তার প্রমাণ চকবাজারে একই কায়দায় আগুন। নিমতলীর আগুনের ঘটনায় তদন্ত রিপোর্টে আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যালের গোডাউন সরিয়ে ফেলার সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে ৯ বছরের মাথায় গিয়ে এরকম আরেকটি ট্র্যাজেডি এবং দুই বছর পরে আরমানিটোলায় একই কারণে প্রাণহানি হতো না।

লেখক: সাংবাদিক