যেখানে আছি এখনও। ধীরে ধীরে দেখতে পেলাম জলের আফাল থেমে গেলো। স্থির জল ছেয়ে গেল কচুরিপানায়। ভেবেছিলাম কচুরি সরালে আবার পেয়ে যাবো মেঘরঙ জল। কিন্তু না এক সময় কচুরি সরে গেল, দেখতে পেলাম বিল ভরাট হয়ে গেছে। বুঝলাম ভরাট করা হয়েছে। বর্ষায় জল পাশের তিন নদী থেকে জল আসার প্রবাহ গেলো কমে। আমাদের দ্বীপ ঘিরে বালির ধূ-ধূ প্রান্তর তৈরি হলো। হারালো জল,হারালো সবুজ। চোখের যে সীমানায় ছিল মেঘ, জল আর সবুজ সেখানে বড় বড় দালান উঠে গেলো। এখন জানালায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে পাই না। আষাঢ়ে বা ফাগুনী পূর্ণিমায় চাঁদ খুঁজেও পাই না। গ্রামের লঞ্চঘাটে, লঞ্চ আছে যাত্রী নেই। খালের শরীর শুকিয়ে গেছে। নৌকা বয়ে যাওয়ার মতো জলধারা নেই। বাড়িতে মোটর ঢুকে পড়ছে সোজা, কিন্তু বিল পেরিয়ে,সরিষা-মটর ক্ষেত পেরিয়ে আর ঘরে ফেরা হয় না। শহর আর গ্রামে দেয়ালের পর দেয়াল উঠেছে। তৈরি হয়েছে মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা। একদিন হঠাৎ জানলাম লালমাটির টিলার দেশে লটারি ঘুরিয়ে বরাতে একখণ্ড মাটি জুটেছে। মন খারাপ হয়ে গেলো। বুঝলাম সেখানে নগর ডাইনোসারের থাবা বসবে। খবর নেইনি বহুদিন সেই মাটির। এক এমন বরষার দিনে গিয়ে দেখি টিলার পর টিলা কেটে সমতল ভূমি বানানো হয়েছে। তেপান্তরের মাঠে দেয়ালের ঘের উঠছে ‘সমাধি’র মতো। শুরু হলো নিয়মিত যাওয়া। অনুনয় বিনয়,যতটুকু সবুজ আছে থাকুক। যে কয়টা টিলা আছে বাঁচুক। পাখিদের আসার মতো কিছু থাকুক। না। কথা শুনছে না কেউ। প্রাকৃতিক জলাশয় হলো কৃত্রিম। জৌলুসের আলো ঢেকে দিল সহজ সুন্দরকে। দালান তুলছি আমিও। নতুন আবাসন। এখানে অন্তত প্রকৃতির সঙ্গে আত্মীয়তা করে বসত তৈরি করা যেত। না। হচ্ছে না। বরং নগর ডাইনোসারের হুংকার বাড়ছে। অপরাধী আমিও,নগর ডাইনোসারের পিছুতো আমিও নিলাম। তড়িঘড়ি করছি। সবুজ ফুরিয়ে যাওয়া আগে,জল কালো হওয়ার আগে যে কয়েকটা দিন যদি নিঃশ্বাস নিতে পারি। আমাদের ব্যক্তিগত ভালো থাকায় সহজ জীবন নেই। সরল প্রকৃতি নেই। আছে ভোগের বাজনা। সেই বাজনাতে সুন্দর প্রজাপতি,পাখি বিরক্ত হয়ে ছেড়ে চলে যাচ্ছে আমাদের। ভোগের সীমা আছে,সীমা পেরোলেই ভোগ মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জল,মাটি,বৃক্ষ হত্যা করে আমরা আজ সেই মৃত্যুরই মুখোমুখি।
অদৃশ্য অনুজীবের তাড়া, প্রকৃতির বিদ্রোহও আমাদের ভোগের উল্লাস থেকে সরাতে পারছে না। ভারসাম্যহীন মানুষ কী করে,প্রকৃতির ভারসাম্যের আবদার করে?
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী