আপনার মনে হতে পারে হঠাৎ করে ১৫ আগস্ট ২০২১ বিকালে কাবুল দখল নিয়েছে তালেবানরা। কিন্তু বিষয়টা তা নয়। আফগানিস্তানে তালেবানদের পুনরুত্থান পর্ব জানান দিচ্ছিল বেশ ক’বছর আগে থেকেই। আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক তৎপরতা এবং তালেবানদের বাদ দিয়ে দেশ গঠনের প্রক্রিয়া যে ব্যর্থ হচ্ছে– তা মার্কিনিরাও জানতো। মার্কিন প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ বহু দলিলপত্রের বয়ান দিয়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ওয়াশিংটন পোস্ট রিপোর্ট করেছে– তিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ, বারাক ওবামা ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনগুলো দুই দশক ধরে এ সত্যকে লুকিয়ে রেখেছিল।
প্রায় ২০ বছর অবস্থানের পর মার্কিনিরা গত জুলাই মাসের ২ তারিখ কাবুল থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বাগরাম বিমানঘাঁটি ত্যাগ করে। সেদিনই কাবুলের পতন ধ্বনি স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়। মার্কিন সেনারা ওই ঘাঁটি থেকে তালেবান ও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা পরিচালনা করতো। ১৫ জুন ২০২১ বাংলা ট্রিবিউনে সেই আশঙ্কা করেই লিখেছিলাম- মার্কিন সেনা প্রত্যাহার কি তালেবানদের ক্ষমতায় ফেরাবে? পেরেছে এখন সেটা প্রমাণিত হয়েছে।
অবশ্য ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তালেবান ও আমেরিকার মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির আওতায়, বিদেশি বাহিনীর গত মে মাসের মধ্যে আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল। তবে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর গত এপ্রিল মাসে বলেন ১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হামলার ২০তম বার্ষিকীর মধ্যেই এই সেনা প্রত্যাহার শেষ হবে। এখন দেখা যাচ্ছে, সেপ্টেম্বরের আগেই তালেবান রাষ্ট্র ক্ষমতায় চলে এসেছে। ৯/১১- এর ২০ বছরপূর্তিতে কাবুলের কোনও মার্কিন স্থাপনায় হামলা করে তালেবান গোষ্ঠী বর্ষপূর্তি পালন করে কিনা সেটাই এখন আশঙ্কার।
তালেবান-যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি অনুসারে তারা অবশ্য একে অন্যের ওপর হামলা চালাবে না বলে অঙ্গীকার করেছে। চুক্তির শর্তের মধ্যে আরও ছিল, আল-কায়েদা কিংবা অন্য কোনও জঙ্গি সংগঠনকে তালেবান তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় আশ্রয় দেবে না এবং আফগান শান্তি আলোচনা চালিয়ে যাবে। কথামতো তালেবান বিদেশি সৈন্যদের ওপর আক্রমণ বন্ধ করলেও আফগান সরকারি বাহিনী, সরকারি স্থাপনা ও দফতরে হামলা এবং বিভিন্ন লোককে টার্গেট করে হত্যা বন্ধ করেনি।
মার্কিন সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর একের পর এক প্রদেশগুলো সরকারি বাহিনীর কাছ থেকে তালেবান প্রায় শান্তিপূর্ণভাবে দখল করেছে। হেরাত, গজনি, কান্দাহার, মাজার-ই শরীফের পর ১৫ আগস্ট তালেবানদের কাবুল দখল নিয়ে তাই বিস্মিত ছিলাম না মোটেই। বিমানবন্দর দিয়ে পালানোর চেষ্টাতেও আমি বিস্মিত না। আমেরিকান-আফগান যুদ্ধের সময় আমি কান্দাহারে গোয়েন্দা সন্দেহে তালেবান বাহিনীর হাতে বন্দি হয়েছিলাম। আবার তালেবান পতনের পর কাবুলে তাদের বিরোধী নর্দান অ্যালায়েন্সের হাতেও পাকিস্তানি সন্দেহে আটক হয়েছিলাম। দুই গোষ্ঠী একে অপরকে বিরোধী শক্তি নয়, কঠিন শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে- তা সরাসরি দেখেছি। ২০ বছর ধরে চলা ঘটনার রেশ তো কিছু থাকবেই।
পরাজিত শক্তি সব দেশেই কমবেশি নিগ্রহের শিকার হয়। তবে এখন পর্যন্ত জনগণ উদ্বিগ্ন, আতঙ্কগ্রস্ত থাকলেও যে রকম শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তালেবান বাহিনী কাবুলে দেখাতে পেরেছে সেটাতে মনে হচ্ছে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবেও তারা আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে ভূমিকা রাখতে পারবে, যদিও চূড়ান্ত মতামত দেওয়ার জন্য আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।
প্রশ্ন দেখা দিয়েছে নারী শিক্ষা এবং নারীদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। ১৯৯৬-২০০১-এর মতো তারা যদি নারীদের শিক্ষা বঞ্চিত করে, ঘরে আবদ্ধ করে রাখে, পুরুষদের দাড়ি রাখতে বাধ্য করে, খেলাধুলা, সিনেমা-গানসহ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে, তাহলে তারা আফগানদের হৃদয় জয় করতে পারবে না। বিশ্ব জনগোষ্ঠীর কাছেও তারা নিন্দিত হয়ে থাকবে।
গত ২০ বছর আফগানিস্তানে শান্তি নেই। বলতে গেলে কয়েক যুগ ধরে শান্তি নেই। আরও সুস্পষ্ট করে বলতে গেলে নিকট অতীতের ১৯৭৯ সাল থেকেই সেখানে শান্তি বিঘ্নিত হয়ে আসছে। এই সংক্রান্ত বিষয়ে গত ৩ আগস্ট ২০২১ বিস্তারিত লিখেছিলাম- তালেবানের উত্থান-পতন-পুনরুত্থান। একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে আমেরিকানরা আফগানিস্তানে সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকালে সেটা ভেবে দেখেনি বলেই আজ আফগানিস্তানে তাদের এই পরিণতি, যাকে বাইডেনবিরোধী আমেরিকান নেতারা তুলনা করছেন ভিয়েতনামে আমেরিকার পরাজয়ের সমতুল্য বলে।
তালেবানকে বাদ দিয়ে কাবুলে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় বলেই ট্রাম্প প্রশাসন ২০১৬ সাল থেকে কাতারে তালেবানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক শুরু করে, যেখানে ২০১৩ সালে তালেবান অফিস খুলেছিল। তবে অগ্রগতি ভালো ছিল না। মাঝখান দিয়ে গত ২০ বছরের যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৩০০ সৈন্য নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে ২১ হাজার। আর আফগান সরকারের পুলিশ-আর্মিসহ নিরাপত্তা বাহিনীর প্রায় ৬৫ হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছে। আফগান বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে অন্তত ১ লাখ ১১ হাজার। আর আমেরিকার অর্থ ব্যয় হয়েছে দুই ট্রিলিয়ন ডলার। সে কারণেই কাবুলের পতনকে এখন অনেকে দেখতে চাইবেন আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়ের চরম মুহূর্ত হিসেবে।
আমেরিকার কারণে যত লোক আফগানিস্তানে মরেছে তত লোক তালেবান বা অন্য কারও শাসনামলে মারা যায়নি। সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধে ৫৬ হাজার লোক মারা গিয়েছিল, আহত হয়েছিল ১৭ হাজার। আমেরিকানরা যদি ৯/১১ প্রতিশোধ হিসেবে আফগানিস্তান আক্রমণ করতো তাহলে তাদের ১০ বছর আগে ২০১১ সালের ২ মে ইসলামাবাদের অ্যাবোটাবাদ থেকে ওসামা বিন লাদেনকে গ্রেফতারের পর হত্যার ঘটনা শেষে চলে যেতে পারতো। কিন্তু এখন যখন বিদায় নিচ্ছে তখন না এসেছে সেখানে ‘সহীহ গণতন্ত্র’, না পেয়েছে দেশের মানুষ শান্তি। মার্কিন নেতৃত্বে ন্যাটোর আক্রমণে তালেবানও পুরোপুরি খতম হয়নি বরং আগের থেকে শক্তিশালীরূপে আবির্ভূত হয়েছে। ৮৫ হাজার তালেবানের ভয়ে গায়েব হয়ে গেছে বাইডেনের প্রশিক্ষিত ৩ লাখ আফগান বাহিনী।
যাহোক, আমার ধারণা তালেবান নেতৃত্ব হয়তো তাদের অতীতের ভুল হতে শিক্ষা নেবে। যদি তারা ক্ষমতার স্থায়িত্ব চায়, বৈধভাবে কাবুলে সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাহলে তারা আন্তর্জাতিক শক্তিকে উপেক্ষা করতে পারবে না। তালেবান নেতাদের মধ্যে যারা বিচক্ষণ, বিশেষ করে যারা দোহায় শান্তি আলোচনায় অংশ নিয়েছেন, তাদের মধ্যে অনেকে বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন, তারা বিশ্বে একঘরে হয়ে থাকতে চাইবেন না।
আবার তালেবান থেকে আল-কায়েদাকে আলাদা করাও কঠিন হয়ে যাবে। কারণ, এদের মাঝে অনেক অভিন্ন সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সম্পর্ক আছে, যেটি নেতারা চাইলেও পুরোপুরি ছাড়তে পারবেন না। এদের সঙ্গে যোগাযোগ হবে সীমান্তের ওপারের পাকিস্তানি তালেবান গোষ্ঠীর, যাদের ওপর পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণ খুবই কম। তাছাড়া ভৌগোলিক কারণে আফগানিস্তানের মতো একটা বিশাল, বিস্তৃত পাহাড়ি দেশে তালেবান সরকার আল-কায়েদাকে দমিয়ে রাখতে পারবে– এটাও বলা কঠিন। সরকার সতর্ক না থাকলে প্রত্যন্ত উপত্যকা আর গ্রামগুলোতে আল-কায়েদা সহজেই নিজেদের শেকড় গাড়তে পারবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
anisalamgir@gmail.com