X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

তালেবানের উত্থান-পতন-পুনরুত্থান

আনিস আলমগীর
০৩ আগস্ট ২০২১, ১৪:২৮আপডেট : ০৩ আগস্ট ২০২১, ১৬:৫১

আনিস আলমগীর কয়েক মাস ধরে সারা বিশ্বকে আফগানিস্তানে তাদের মজবুত ভিত্তির জানান দিচ্ছে তালেবান। অন্যদিকে আফগান সরকার তার নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে পুরো দেশের ওপর। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, দেশের সিংহভাগ এলাকা এখন তালেবানের দখলে, সীমান্তের ৯০ শতাংশ তাদের কব্জায়। তারা এখন লড়াই করছে হেরাত, কান্দাহারের মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকা দখলের। তালেবান কারা সবাই জানি কিন্তু তাদের উত্থান-পতন এবং পুনরুত্থানের কাহিনি নতুন করে বলতে চাই আজকের কলামে।

কাহিনি শুরু করতে হলে ১৯৭৯ সালে ফিরে যেতে হবে। ওই সালে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং কমিউনিস্ট নেতা নূর মোহাম্মদ তারাকিকে হত্যা করা হয়েছিল। আর এ ঘটনার মধ্য দিয়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানের ব্যাপারে ব্যাপক নাক গলাতে শুরু করে। তারাকি নিজে কমিউনিস্ট নেতা হলেও তাকে হত্যার নেতৃত্ব দিয়েছেন আরেক কমিউনিস্ট নেতা হাফিজুল্লাহ আমিন। হাফিজুল্লাহ প্রথমে তাকে গ্রেফতার করে। তারপর হত্যা করে তাকে।

আফগানিস্তানের বাম রাজনৈতিক দল- পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (পিডিপিএ) ছিল তখন দুই ভাগে বিভক্ত। তাদের নিজেদের মধ্যে হানাহানি চলছিল প্রচুর। তারাকি নিজেই যে সাধু ছিলেন তা নয়, তিনিও দলে তার প্রতিপক্ষকে মারার চেষ্টা করেছেন, এরমধ্যে হাফিজুল্লাহ আমিন একজন। তখন কমিউনিস্টদের নিজেদের মধ্যে যেমন অভ্যন্তরীণ লড়াই চলছিল তেমনি কমিউনিস্টদের সঙ্গে ইসলামিস্টদের বিরোধ ছিল তুঙ্গে। আবার ঠিক ওই সময়ে আফগানিস্তানের প্রতিবেশী ইরানে ইসলামিক বিপ্লব সংঘটিত হয়। বিশ্ব মানচিত্রে শক্তিশালী একজন ইসলামি নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন আয়াতুল্লাহ খোমেনি। এটাই ছিল ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লব, সেই বিপ্লবীরা এখনও বহাল তবিয়তে ইরানে ক্ষমতায় রয়েছে।

আফগানিস্তানের যে পরিস্থিতি ইরানের পরিস্থিতি তখন তা-ই ছিল। সেখানেও একদিকে ইসলামিস্টরা অন্যদিকে লেফটিস্ট-কমিউনিস্টরা মুখোমুখি ছিল। ইরানের রাজা শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি আধুনিকতা এবং সেক্যুলারিজমে বিশ্বাস করতেন। তিনি সেক্যুলারিজমের পাশাপাশি দেশের জন্য অনেক অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে এসেছিলেন। পশ্চিমাদের সঙ্গে তার ছিল সুসম্পর্ক। কিন্তু তার ক্ষমতায় চিরস্থায়ী হওয়ারও লক্ষ্য ছিল, সেই কারণে প্রতিপক্ষকে খতম করে দেওয়ার ক্ষেত্রে সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি। রেজা পাহলভি তার বিরুদ্ধে গণরোষ ঠেকাতে রাজনৈতিক দলগুলোকে অবৈধ ঘোষণা করেন এবং পার্লামেন্ট বাতিল করে দেন। কিন্তু ইসলামি বিপ্লবীদের প্রতিরোধে তিনি দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। খোমেনি ফ্রান্স থেকে ফিরে আসার দুই সপ্তাহ আগে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। মার্চে, খোমেনি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়নে নেতৃত্ব দেন। ১৯৭৯ সালের গণভোটের পর তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।

ইরানের এই পরিস্থিতি দেখে আফগানিস্তানে ভীত হয়ে পড়েন হাফিজুল্লাহ। তিনি ইসলামিস্টদের ছাড় দেওয়া শুরু করেন। মসজিদ সংস্কার, কোরআন শরিফ বিতরণ এবং কথাবার্তায়, বক্তৃতায় আল্লাহর নাম নেওয়া শুরু করেন। তার এই চেষ্টার উদ্দেশ্য ছিল কমিউনিস্ট হলেও ইসলামিস্টদের পাশে পাওয়া। কিন্তু জনতা তাকে মোটেই পছন্দ করতো না। তিনি উগ্র মার্ক্সবাদী এবং নৃশংস হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

ইসলামিস্টরা ক্ষমতা দখলের আগেই, ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে হস্তক্ষেপ করে এবং হাফিজুল্লাহর জায়গায় বাবরাক কারমালকে প্রেসিডেন্ট পদে বসায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন এটা করার দুটো কারণ ছিল। প্রথম কারণ, হাফিজুল্লাহর কর্মকাণ্ড কমিউনিস্টদের বদনাম হচ্ছিল, যেখানে সোভিয়েত রাশিয়া কমিউনিজমে বিশ্বাসী। দ্বিতীয় কারণ ভূ-রাজনৈতিক। যেহেতু তখন আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠান্ডাযুদ্ধ চলছিল তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে পারলে লাল ঝাণ্ডার আরও একটি দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী বহরে যোগ দিতে পারে।

কারমালের সূচনাটা ভালোই হয়েছিল। তিনি ক্ষমতায় এসে প্রায় ২৭০০ রাজবন্দিকে মুক্তি দেন, টকটকে লাল রঙের কমিউনিস্ট মার্কা আফগান পতাকা পরিবর্তন করে নতুন এক পতাকা দেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে আফগানিস্তানকে একটি নতুন সংবিধান দেওয়া হবে। এছাড়াও অবাধ নির্বাচন, বাকস্বাধীনতা, প্রতিবাদের অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন। মনে হচ্ছিল যেন আফগানিস্তান তখন একটি নতুন মাত্রা পেয়েছে এবং সঠিক রাস্তায় চলা শুরু করেছে কারমালের হাত ধরে। কিন্তু আফগানিস্তানকে এই পরিস্থিতিতে দেখে নিশ্চয়ই আমেরিকার শান্তিতে থাকার কথা নয়। মার্কিনিরা দেখে যে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে তার প্রভাব পূর্ণমাত্রায় প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়াও এরমধ্যে তারা ভিয়েতনাম, ইথিওপিয়ায় আমেরিকাকে বড় ধরনের শিক্ষা দিয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধে তখন আমেরিকারকে কিছুটা পরাস্ত দেখাচ্ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে।

আমেরিকা তখন আফগানিস্তানকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে বদলা নেওয়ার ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করার কথা ভাবে। শুরু হয়ে যায় আফগানিস্তানে আমেরিকা ও রাশিয়ার প্রক্সি ওয়ার। আমেরিকা আশ্রয় নেয় ইসলামিস্টদের কাছে, তারা মুজাহিদীনকে সমর্থন করে তাদের নেপথ্যে সহযোগিতা দিতে থাকে। তারও আগে থেকে পাকিস্তান ও সৌদি আরব মুজাহিদীনকে সাপোর্ট করে আসছিল।

এখানে বলে রাখা দরকার, সেই সময় বাংলাদেশ থেকেও প্রচুর সংখ্যক যুবক মুজাহিদীনের পক্ষে যুদ্ধ করতে আফগানিস্তানে চলে যায়। সিআইএ তার বড় ধরনের অর্থবিত্ত নিয়ে এই গোপন অপারেশন পরিচালনায় নামে, যার নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন সাইক্লোন’। সিআইএ পরিচালক রবার্ট গেটস কীভাবে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ৩ জুলাই ১৯৭৯ সালে পাঁচ লাখ মার্কিন ডলারের একটি সিক্রেট ফান্ড মুজাহিদীনকে বরাদ্দ করেছিলেন সেটি ফাঁস করেন। আমেরিকায় ক্ষমতা বদলের পর জিমি কার্টারের জায়গায় রোনাল্ড রিগ্যান এলেও মুজাহিদীনকে তাদের সমর্থন এবং অর্থ অব্যাহত রাখে। ১৯৮৩ সালে মুজাহিদীন নেতাদের সঙ্গে রিগানের বৈঠকের ছবিও এখন নেটে পাওয়া যায়। সিআইএ’র সঙ্গে পাকিস্তানের আইএসআই, ব্রিটিশ সিক্রেট এজেন্সি এমআইসিক্স এই অপারেশন সফল করতে একযোগে কাজ করতে থাকে। তার বাইরে সৌদি আরবও মুজাহিদীনকে তাদের সমর্থন অব্যাহত রাখে।

কারা ছিল এই মুজাহিদীন? শুরুতে এরা গেরিলা যোদ্ধা ছিল। পাহাড়ে পর্বতে লুকিয়ে অপারেশন চালাতো। তারা শুধু বাইরের সাপোর্ট নয়, তাদের তাদের হাতে শুধু বন্দুক নয়, অ্যান্টি-মিসাইল অস্ত্র চলে আসে। তখনই লড়াইয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বড় ধরনের ধাক্কা লাগে।

১৯৮৮ সালে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট যখন মো. নজিব উল্লাহ, তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে জেনেভা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই শান্তি চুক্তি অনুযায়ী দুই দেশ একে অপরের বিষয়ে নাক গলাবে না। চুক্তির গ্যারান্টার হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিনিরা প্রতিশ্রুতি দেয়, যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান থেকে তার সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয় তাহলে আমেরিকাও মুজাহিদীনকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করবে।

অবশেষে ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে চলে যায়। তার চলে যাওয়ার পেছনে কারণ শুধু এই নয় যে তারা সেখানে বিপদের সম্মুখীন ছিল; বরং তাদের দেশেও তখন শুরু হয়ে যায় ভাঙনের শব্দ। ১৯৮৮ থেকে ৯১ সালের মধ্যে তারা আলাদা আলাদা দেশে রূপান্তরিত হতে থাকে। তার মধ্যে বড় অংশ রাশিয়া এখনও টিকে আছে হালকা পুরনো গরিমা নিয়ে। নজিবুল্লাহ পুরো চেষ্টা করেন দেশে সংঘর্ষ কমিয়ে আনতে। তিনি নিজের ক্ষমতাও কমিয়ে আনেন। নতুন একটি সংবিধান দেওয়া হয় ১৯৮৭ সালে। আফগানিস্তান তখন আর একদলীয় সরকারের দেশ নয়, অন্যান্য রাজনৈতিক দল ইলেকশনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়। ১৯৮৮ সালের নতুন সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে তার দল পিডিপিএ ২৩৪ আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে নজিবুল্লাহ পুনরায় সরকার গঠন করেন।

১৯৯০ সালে আফগানিস্তানকে একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ঘোষণা দেওয়া হয় আর কমিউনিজমের যাবতীয় রেফারেন্স মুছে দেওয়া হয়। নজিবুল্লাহ চেষ্টা করেন যত ইসলামি গ্রুপ আছে তাদের শান্ত করে যাতে দেশে শান্তি আনা যায় এবং বিদেশি সাহায্য পাওয়া যায়। তিনি প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট যাতে বাড়ে সেই চেষ্টাও করেন। কিন্তু এত কিছুর পরেও আমেরিকা মুজাহিদীনকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করেনি। মুজাহিদীনও এক ইঞ্চি পিছু হটেনি। তারা নির্বাচন বয়কট করে এবং গৃহযুদ্ধ অব্যাহত রাখে। সোভিয়েত ইউনিয়ন পেছন থেকে নজিবুল্লাহকে সমর্থন, সাহায্য-সহযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে, কিন্তু তাতে কোনও সুফল আসেনি। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পুরোপুরি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় আর ১৯৯২ সালে মুজাহিদীন এই জনযুদ্ধে জিতে যায়।

মুজাহিদীন একটা ইসলামিক গ্রুপ ছিল এটা সত্য, তবে সেই গ্রুপে নানা মতের লোক ছিল এবং সেখানে ক্ষমতালিপ্সা কারও কম ছিল না। এই গ্রুপের বড় সমস্যা ছিল এক ধর্মের হলেও জাতিগত পার্থক্য ছিল তাদের প্রচুর। এই নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যেই দ্বন্দ্ব লেগে যায় কে ক্ষমতার স্বাদ নেবে। অবশেষে ১৯৯২ সালের জুন মাসে বোরহান উদ্দিন রব্বানী সেই ক্ষমতার অধিকারী হন। তিনি ইসলামিক স্টেট অব আফগানিস্তানের নতুন নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।

কয়েক বছর যেতেই আফগানিস্তানে আবির্ভাব হয় নতুন এক শত্রুর। নাম তার তালেবান। পশতুন ভাষায় তালেব মানে ছাত্র। তালেবান এসেছে ছাত্রের বহুবচন হিসেবে। ১৯৯৬ সালে মুজাহিদীন সরকারকে হটিয়ে এই তালেবান ক্ষমতা দখল করে। শুরুতেই তালেবান গ্রুপের নেতা ছিলেন মোল্লা ওমর। ৫০ জন ছাত্র দিয়েই শুরু হয়েছিল তার অভিযাত্রা। ক্ষমতা দখলের অভিযাত্রা শুরু করতে না করতে পাকিস্তান থেকে আফগান শরণার্থীরা এসে যোগ দেয় তার পেছনে। তারা ছিল মুজাহিদীনের তুলনায় আরও বেশি ধর্মীয় গোঁড়া। এই তালেবান গোষ্ঠী পাকিস্তানের বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকেই গোঁড়ামির প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে আসে।

মুজাহিদীনে যে আলাদা আলাদা জাতিগোষ্ঠী ছিল তাদের মধ্যে পশতুনরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং পুরো আফগানিস্তানেও পশতুনরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। পশতুন জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী বলে তারা হাজারাসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে নিধন শুরু করে। পাকিস্তানে যে পশতুনরা রয়েছে তাদের সঙ্গে আফগান পশতুনদের একটা আত্মিক যোগাযোগ রয়েছে। তারা দুই দেশের মধ্যে মোটামাটি বাধাহীন চলাফেরাও করতো। আফগান যুদ্ধের সময় আমি নিজেও তা স্বচক্ষে দেখেছি।

তালেবান আমেরিকার সৃষ্টি এটা যেমন জোরালোভাবে দাবি করার সুযোগ নেই, তেমনি অস্বীকারও করা যাবে না। আমেরিকা-সৌদি আরব-পাকিস্তান মিলে আফগানিস্তানে মুজাহিদীনকে অস্ত্র সরবরাহ করে তালেবানদের উত্থানে যেমন ভূমিকা রেখেছে তেমনি আফগানিস্তানের গণতন্ত্রকে তছনছ করে দিয়েছে। তাদের দ্বারাই আফগানিস্তানে তালেবান জন্ম নেওয়ার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। কারণ, তারা মিলিয়ন ডলার খরচ করে টেক্সট বুক তৈরি করেছিল ইসলামিস্টদের জন্য, যেখানে জেহাদ, বন্দুক, গুলি, সৈন্য, ভায়োলেন্ট ইমেজ ছিল এবং পরে এ ধরনের এক্সট্রিমিস্ট আইডিওলজির সব বইপত্র তালেবান নিজেরাও স্কুল পাঠ্যক্রমে রেখে দেয়।

১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ তালেবানরা কাবুল দখল করতে সক্ষম হয় এবং ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তান সৃষ্টি করে। অনেক এলাকায় তারা শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। জনসমর্থনও পেয়েছিল।

তবে শুরুতেই যতটা তারা ভালো চেহারা নিয়ে এসেছিল আস্তে আস্তে সে চেহারার আসল রূপ প্রকাশিত হয়ে পড়ে তাদের একের পর এক উদ্ভট নির্দেশনায়। তারা আফগানিস্তানে অনেক কিছু নিষিদ্ধ করে দেয়। তার মধ্যে অনেক বিষয় হাস্যকরও। তাদের নিষিদ্ধের দীর্ঘ তালিকায় ছিল, সিনেমা, টিভি, গান-বাজনা, ভিসিআর, ফুটবল, দাবা, ঘুড়ি ওড়ানো, ছবি আঁকা, ফটোগ্রাফি, কাপড়চোপড়ে এমব্রয়ডারি করা, দাড়ি কাটা। তারা বিদেশিদের আসা নিষিদ্ধ করে, জাতিসংঘের অফিসগুলোকে নিষিদ্ধ করে, এনজিও নিষিদ্ধ করে। এমনকি ইন্টারনেট এবং ১০ বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের শিক্ষা নিষিদ্ধ করে। পুরুষদের দাড়ি টুপি পরা এবং মেয়েদের পুরো শরীর আবৃত করে বোরকা পরতে বাধ্য করে। পুরুষ আত্মীয় ছাড়া মেয়েদের বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করে।

ধর্মীয় কারণ না থাকলেও জাতিগত কারণে পশতুনদের বাইরে হারাজারাসহ অন্যান্য মুসলমান জাতিকে হত্যা করে। পাশাপাশি খ্রিষ্টানদের হত্যা করে, হিন্দুদের তারা আলাদা ব্যাজ দেয় যাতে ভিন্নধর্মী হিসেবে সহজে চিহ্নিত করা যায়। আফগানিস্তানের কালচারাল হিস্ট্রি অনেক সমৃদ্ধ, কিন্তু তালেবান ক্ষমতায় এসে তাদের ঐতিহাসিক বুদ্ধ মূর্তিগুলো ধ্বংস করে। তারা সাবেক প্রেসিডেন্ট নজিবুল্লাহকেও হত্যা করে। সারা দুনিয়া তাদের এসব কার্যক্রম দেখে নিন্দায় মেতে ওঠে এবং তাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে। তবে শুধু তিনটি দেশ তাদের কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়ে রাখে। সেই তিন দেশ হচ্ছে- পাকিস্তান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।

নব্বইয়ের শেষ দিকে কিছু মুজাহিদীন ফোর্স তালেবানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। তাদের বলা হয় নর্দান অ্যালায়েন্স। তাদের প্রধান হয়ে আসেন আহমদ শাহ মাসুদ কিন্তু ২০০১ সালে নর্দান অ্যালায়েন্স তালেবানের সঙ্গে এই লড়াইয়ে হেরে যায় এবং আহমদ শাহ মাসুদকে খুন করা হয়। এই হত্যার মাত্র দুই দিন পরে ১১ সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে আল কায়দা নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ারসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা চালায়, যা আজ পর্যন্ত পুরো বিশ্বকে বদলে রেখেছে।

আল-কায়েদার নেতা ছিলেন এক সৌদি নাগরিক ওসামা বিন লাদেন। তালেবান ওসামা বিন লাদেনকে তাদের দেশে আশ্রয় দিয়েছিল। থাকতো পাহাড়ের গুহায়। লাদেন আমেরিকাকে চিঠি দিয়ে জানায় যে তারা নাইন-ইলেভেন ঘটিয়েছে প্রতিশোধ হিসেবে, আমেরিকা যেটা সোমালিয়া, লিবিয়া ও আফগানিস্তানে করছে। সঙ্গত কারণেই আমেরিকা তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আফগানিস্তানে হাজির হয় তাৎক্ষণিকভাবে। শুরু হয় ‘ওয়ার অন টেরর’। সন্দেহজনক তালেবান আস্তানাগুলোতে আকাশ থেকে বোমা হামলা করতে থাকে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এয়ার স্ট্রাইক করলে সাধারণ মানুষও মরে।

নর্দান অ্যালায়েন্সের সহযোগিতা নিয়ে আমেরিকা তালেবানকে পুরোপুরি হটিয়ে দেয় এবং আহমদ শাহ মাসুদের সমর্থক হামিদ কারজাই আফগানিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হন। তিনি ২০১০ সালের নতুন একটি নির্বাচন দেন, দেশকে নতুন একটি সংবিধান দেন। মোটামুটি গ্রহণযোগ্য ওই নির্বাচনে ৬০ লাখ আফগান ভোট দান করে। হামিদ কারজাই প্রেসিডেন্ট হন। কারজাই ভারতে লেখাপড়া করেছেন। ভারতের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক ছিল এবং আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ক্রমেই মজবুত ভিত্তি পেয়েছে তার আমলে।

আমেরিকানরা আফগানিস্তানের পাশাপাশি তালেবান ধ্বংস করার জন্য পাকিস্তানেও বিমান হামলা চালায়। ২০১১ সালে তারা ওসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তানে হত্যা করে। ২০১৫ সালে আবিষ্কৃত হয় তালেবান নেতা মোল্লা ওমর ২০১৩ সালে শারীরিক অসুস্থতায় পাকিস্তানে মারা গেছেন।

এই পুরো সময়ে আমেরিকা শান্তি বজায় রাখা, সরকারকে সহযোগিতা এবং তালেবান দমনের জন্যে আফগানিস্তানে তার সৈন্যদের রেখে দেয়। এত বছর পরেও দেখা যাচ্ছে তালেবান পুরোপুরি খতম হয়নি বরং আগের থেকে শক্তিশালী রূপে আবির্ভূত হয়েছে। তালেবান আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে তো বটেই এবং মাঝে মধ্যে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতেও বোমা হামলা চালিয়েছে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্ষমতায় এসে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন তালেবানদের সঙ্গে কাতারের সহযোগিতায় আলোচনা শুরু করে।

গত বছর ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে তালেবানের চুক্তি হয়েছিল যে পয়লা মে-র মধ্যে সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে জো বাইডেন ক্ষমতায় এসে সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে ওয়ান-ইলেভেনের ২০ বছর পূর্তিকালে ২০২১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ন্যাটোভুক্ত সব সৈন্যকে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন। বাইডেন বলেছেন, আফগানিস্তানে এখন ৩ লক্ষ প্রশিক্ষিত আধুনিক সেনাবাহিনী রয়েছে, ৭৫ হাজার তালেবান সৈন্যকে প্রতিরোধ করা তাদের পক্ষে সম্ভব।

বাস্তবতা হচ্ছে সরকারি সৈন্যরা লড়ছে আবার ভয়ে পালাচ্ছেও। দোভাষীসহ আমেরিকানদের সহযোগীরা দেশ ছাড়ছে। সবার বুঝতে বাকি নেই লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছে সিংহ আমেরিকা। ওয়ান-ইলেভেনের প্রতিশোধ নেওয়া যদি আমেরিকার প্রধান ইস্যু হতো তাহলে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার পর পরই তারা আফগানিস্তান ছাড়তে পারতো। কিন্তু তালেবান খতম করার মিশন তাদের অসম্পূর্ণ, আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা আসেনি। মাঝখানে তারা আমেরিকার জনগণের ২ ট্রিলিয়ন ডলার বরবাদ করেছে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত। [email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মাদারীপুরে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা
মাদারীপুরে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা
বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিমের প্যানেল ঘোষণা
বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিমের প্যানেল ঘোষণা
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা   
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা  
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ