ক’বছর আগে শিশু রাজনকে হত্যা করা হয় সিলেটে। সেই খবরও মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকের পাতায়। উত্তাল হয়ে ওঠে সারাদেশ। প্রতিবাদে প্রকম্পিত হয় দেশের প্রতিটি প্রান্ত। বিচারের আওতায় আসে রাজন হত্যা মামলার আসামি। খানিকটা তৃপ্ত হয় বাঙালি। ২০১৭ সালে রংপুরের ঠাকুরপাড়ায় হিন্দু পল্লিতে হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। পুড়ে ছাই হয় পুরো গ্রাম। আকাশে বাতাসে তখন বেদনার ধ্বনি। এই ঘটনার পরও সারাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রয়োজনে আন্দোলন দানা বাঁধে। বিষয়টি এখন বিচারাধীন।
উদাহরণগুলো উগ্রবাদের নয়, তবে প্রতিবাদের। এসব প্রতিবাদই বিপৎগামী বাংলাদেশে অসংখ্যবার পথ চিনিয়েছে।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১–বাংলাদেশের জন্ম ও এর জন্মের ইতিহাস বলছে এই ভূখণ্ড সারা পৃথিবীতে এক অসাধারণ সম্প্রীতির নজির স্থাপন করেছে। ধর্মের ভিত্তিতে এই দেশ স্বাধীন হয়নি, হয়েছিল জাতীয়তার ভিত্তিতে। হয়েছিল সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে। বৈষম্য ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করেই মূলত আজকের বাংলাদেশের জন্ম। তারই ধারাবাহিকতায় আজও বাংলাদেশের যেকোনও প্রান্তের যেকোনও অসঙ্গতি,বৈষম্য,অন্যায় ও অবিচার পুরো বাংলাদেশকে জাগ্রত করে। আজ লালন মেলায় হামলা হলে আমরা জেগে উঠি। বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা হলে আমরা জেগে উঠি। সাঁওতাল পল্লিতে হামলা হলে জেগে উঠি। যুদ্ধাপরাধীর বিচারে অসঙ্গতি ধরা দিলে আমরা জেগে উঠি। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আমরা জেগে উঠি। সুবর্ণচর থেকে সুনামগঞ্জ, যেখানেই অন্যায় ধরা পড়ুক আমরা এক সুর ও স্বরে জেগে উঠি। শুধু দেশে কেন, ফিলিস্তিনে গণমানুষের অধিকারের জন্য, মিয়ানমারের অসহায় মানুষ হত্যার প্রতিবাদেও আমরা প্রতিবাদ জানাই, সমবেদনা জানাই।
চেতনায় জাগ্রত হওয়া আমাদের স্বভাবে মিশে আছে। আমরা একবার ভাষার জন্য জেগেছিলাম। একবার গণঅভ্যুত্থানে জেগেছিলাম। একবার ৭ মার্চে গর্জে উঠেছিলাম। আমরা ৭১’-এ যুদ্ধ করেছিলাম। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম। আমরা আসলে জাগ্রত জাতি। কখনও কখনও আমাদের পা হয়তো পিছলে গেছে কিন্তু আমরা কখনোই স্থায়ীভাবে পথ হারাইনি।
‘কী আছে আমাদের’-যা আমাদের সাহস দেয়? শক্তি দেয়? সীমাহীন শূন্যতায়ও স্বপ্ন দেখায়? আজ যখন স্লোগান শুনি ‘আমরা সবাই আফগান, বাংলা হবে তালেবান’ তখন আমরা হো হো করে হেসে উঠি। আমরা জানি, এটা অসম্ভব। বাংলা কখনোই আফগান হবে না। বাঙালি কখনোই তালেবান হবে না। কিন্তু কেন? কোথা থেকে আসে আমাদের এত সাহস? কোথা থেকে আসে আমাদের এত আত্মবিশ্বাস? কী আমাদের প্রকৃত নেপথ্য? কী আছে আমাদের? অথবা কী নেই?
বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। তারা ধার্মিক, কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। এ দেশের সিংহভাগ মানুষ ধর্মীয় সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী। এ দেশের সিংহভাগ মানুষ অন্যের মত ও পথের প্রতি সম্মান জানাতে জানে। আমাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠার মূল শক্তি ও নেপথ্যই হলো অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তা। এই শক্তিতেই আমরা ঐক্যবদ্ধ ও বলীয়ান। এই শক্তিই আমাদের পথ দেখায়, সাহসী করে তোলে, অহংকারী ও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।
একটি দেশের সংস্কৃতি তার নিজস্ব পরিচয় বহন করে। কতটা সভ্য কিংবা অসভ্য সে পরিচয় বহন করে। সে জাতি কতটা সহিংস হবে, কিংবা অহিংস হবে তার পরিচয় বহন করে। আমার এমন একটি জাতি, যাদের একটি পহেলা বৈশাখ আছে। যেখানে আমরা নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করি। আমাদের একটা নবান্ন উৎসব আছে। আমাদের চৈত্র সংক্রান্তি আছে। আমাদের ফাল্গুন আছে। আমাদের একজন নজরুল আছেন। একজন রবীন্দ্রনাথ আছেন। একজন লালন আছেন। একজন কামরুল আছেন। আমাদের পাহাড় আছে, নদী আছে, সমুদ্র আছে। আমাদের সমতল আছে। আমাদের একটি রমনার বটমূল আছে। আমাদের প্রভাত ফেরি আছে। আমাদের ২১ আছে। আমাদের ১৬ আছে। আমাদের ২৬ আছে। নিশ্চিতভাবে আমাদের কিছু গ্লানি আছে, ভুলও আছে। যে গ্লানি ও ভুল সঠিক পথচর্চা করতে আমাদের সাহায্য করে।
অতএব, বিশ্বের যেকোনও প্রান্তে উগ্রবাদ দানা বাঁধলেও আমাদের ভয়ের কিছু নেই। কারণ, আমাদের জন্মে উগ্রবাদের বীজ নেই, কীটনাশক আছে। আমাদের চলন ও চাহনিতে কোনও সাম্প্রদায়িকতা নেই, সুগন্ধি আছে। আমাদের চরিত্রে কোনও ধর্মান্ধতা নেই, বিনয় আছে, উদারতা আছে। যেসব দেশে উগ্রবাদ মাথা চাড়া দিচ্ছে তাদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য অনেক। তাদের এমন অনেক নেতিবাচক দিক আছে যা আমাদের নেই, আবার আমাদের এমন অনেক ইতিবাচক দিক আছে যা ওদের নেই। ফলে যেকোনও উগ্রবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তির চেয়ে আমাদের গঠন ও চলন ভিন্নতর। আজকের বাংলাদেশ কোনও হঠাৎ বাংলাদেশ নয়। এর ইতিহাস, এর ঐতিহ্যই অনন্ত সময় একে পথ দেখাবে।
একটি দেশের আলো বাতাস সে দেশের প্রজন্মকে শিক্ষা দেয়। প্রজন্মের হাত ধরে বেড়ে ওঠে আরেকটি প্রজন্ম। আমাদের শিক্ষা,আমাদের প্রজন্ম কখনোই সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার শিক্ষা দেয় না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী একাধিক প্রজন্ম ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে, যাদের অনেকেই চিন্তাশীল ও অন্যের মতের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। অতএব, এই ভূখণ্ড যেমন শান্তির ধর্ম পালনকারীদের জন্য উর্বর, তেমনি ধর্মান্ধদের জন্য বিষাক্ত। আমাদের মূলশক্তি তারুণ্য। আর এ জন্যই আমাদের দেশপ্রেম, গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী বাংলাদেশ কখনোই পথ হারাবে না। তবে মনে রাখতে হবে, বিশ্বের যেকোনও প্রান্তের আলোর ছোঁয়া যেমন আমাদের গায়ে লাগতে পারে, তেমনি আগুনের আঁচও লাগতে পারে। তাই প্রস্তুত থাকতে হবে সমাজ ও রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্রকে নির্মাণ করতে হবে শক্ত অবকাঠামো, আর সমাজকে বিনির্মাণ করতে হবে শক্ত সভ্যতা।
১৯৬৪ সালের ১৪ জানুয়ারি একটি গুজবকে কেন্দ্র করে এই উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিমে দাঙ্গা বাধে। প্রায় ৭ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় সে দাঙ্গায়। সেই দাঙ্গা থামাতে বঙ্গবন্ধু রুখে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। আজও এ দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে ও উগ্রবাদ রুখতে, রুখে দাঁড়ানোর কোনও বিকল্প নেই। এ কথা সত্য, আজকের বাংলাদেশ কেমন আছে তা যেমন একেবারেই প্রশ্নাতীত নয়, তেমনি অবিসংবাদিত সত্য আগামীর বাংলাদেশ হবে সুন্দর ও স্বপ্নময়। আগামীর বাংলাদেশ হবে শান্তিপ্রিয় মানুষের ভূখণ্ড, কোনও উগ্রবাদের স্থান এখানে কখনোই হবে না।
লেখক: শিক্ষক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
faruque1712@gmail.com