X
বুধবার, ০১ মে ২০২৪
১৮ বৈশাখ ১৪৩১

আমরা কি মানুষের ওপর থেকে বিশ্বাস তুলে নেবো?

উমর ফারুক
১৩ নভেম্বর ২০২৩, ২১:০৩আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২৩, ২১:০৩

ওয়াহিদ মোল্লা বর্তমান সময়ের পরিচিত একটি নাম। আলোচিত একটি চরিত্র। আমাদের অনেকেই তাকে চেনেন। বাড়ি পাবনায়। তারা সাত ভাই, দুই বোন। ওয়াহিদের স্ত্রী দুজন। দুজনই তাকে ছেড়ে চলে গেছে। প্রথম স্ত্রীর একটি সন্তান। ছেলে। কোনও কন্যাসন্তান নেই। ১৮ বছর আগে বাড়ি ছেড়েছে ওয়াহিদ। তারপর নিরুদ্দেশ। শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করতে সাত বছর আগে একবার বাড়ি ফিরেছিল ওয়াহিদ। ওটাই শেষ। তারপর এলাকার লোকজন তাকে আর দেখেনি।

ওয়াহিদ এখন এই পাড়া-ওই পাড়া, এই শহর-ওই শহরে প্রতারণা করে বেড়ায়। মেয়ের বিয়ে, গুরুতর অসুস্থতা, এই বিপদ, সেই বিপদ, নানান কথা বলে সে টাকা হাতিয়ে নেয়। হাতিয়ে নেওয়া টাকায় নেশা করে। গেলো ক’দিন আগে ওয়াহিদের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ডুকরে ওঠে কোটি হৃদয়। তার ভিডিও দেখে হাজার-হাজার মানুষ চোখ মোছে। পাশে দাঁড়ানোর জন্য হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। খুঁজতে খুঁজতে বেরিয়ে আসে ভয়াল প্রতারণার এক গল্প। মেয়ের বিয়ে তো দূরের কথা, ওয়াহিদের নাকি কোনও মেয়েই নেই! কী নির্মমতা! কী বীভৎস-ভয়াবহ প্রতারণা! দিনের পর দিন ওয়াহিদ মেয়ের বিয়ের গল্প বানিয়ে, নিখুঁত অভিনয় করে, এভাবেই হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার টাকা। আর সে টাকায় নিচ্ছে মাদক।

ওয়াহিদ কিংবা ওয়াহিদের মতো প্রতারকের গল্প এখন আমাদের চারপাশে। সেই সব গল্প থেকে সত্য-মিথ্যা, ঠিক-ভুল আলাদা করা কঠিন। আর এভাবেই সরল মনের মানুষ প্রতিদিন পা দিচ্ছে প্রতারণার ফাঁদে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতারকদের দিকে। সত্যটা জেনে কখনও কখনও দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো, সাধারণ মানুষ এভাবে প্রতারিত হতে হতে কি একদিন অন্যকে উপকার করার মানসিকতা হারিয়ে ফেলবে? এই দুষ্ট চক্রে, সমাজের ওপর থেকে মানুষ কি তার সবটুকু বিশ্বাস তুলে নেবে? এভাবে অসহায় মানুষের নামে অভিনয় বাড়লে তো চূড়ান্ত সংকটে পড়বে প্রকৃত সাহায্যপ্রার্থীরা। কী হবে তখন? নাকি এসব নিখুঁত প্রতারণার ভিড়েও টিকে থাকবে আমাদের মানবিক সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা? টিকে থাকবে আমাদের সাহায্যের হাতগুলো।

আজকের পৃথিবীতে সুখ-দুঃখের অনুভূতি অনেকটা বৈশ্বিক। পৃথিবীর যেকোনও প্রান্তের সুখ-দুঃখের অনুভূতি মুহূর্তেই পৌঁছে যায় বিশ্বগ্রামের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। কেঁদে ওঠে বিবেকবান মানুষের হৃদয়। ফলে প্রতারণার সুযোগ যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে সাহায্যের সুযোগও। বেড়েছে সংকট, বেড়েছে সমাধান।

আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা। আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে নবকুমারের কথা। নবকুমার সমুদ্র দেখবে বলে তীর্থযাত্রীদের নৌকায় গঙ্গাসাগরে এসেছিল। পথে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে এক দ্বীপে নৌকা ভিড়িয়ে রান্নাবান্নার আয়োজন করতে গিয়ে দেখা গেলো জ্বালানি কাঠের সংকট। সবার অনুরোধে নবকুমার কাঠ কাটতে যায়। এদিকে জোয়ার এসে পড়ে। নবকুমারের ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে তাকে রেখেই রওনা হয়ে যায় নৌকা। অন্যের উপকার করতে গিয়ে দ্বীপে আটকা পড়ে নবকুমার।

বঙ্কিমচন্দ্র তার লেখায় বলছেন, ‘ইহা শুনিয়া যদি কেহ প্রতিজ্ঞা করেন, কখনও পরের উপবাস নিবারণার্থ কাষ্ঠাহরণে যাইবেন না, তবে তিনি উপহাস্পদ। আত্মোপকারীকে বনবাসে বিসর্জন করা যাহাদিগের প্রকৃতি, তাহারা চিরকাল আত্মোপকারীকে বনবাস দিবে, কিন্তু যতবার বনবাসিত করুক না কেন, পরের কাষ্ঠাহরণ করা যাহার স্বভাব, সে পুনর্বার পরের কাষ্ঠাহরণে যাইবে। তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম না হইব কেন?’ অতএব, খুব দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলা যায়, মানুষ খুব সহজে বিশ্বাস হারায় না। প্রতারিত হলেও মানুষ বিশ্বাস হারায় না। বিশ্বাস করাই মানুষের স্বভাব। বিশ্বাসই মানুষের অস্তিত্ব, বিশ্বাসেই মানুষের আস্থা।

প্রাত্যহিক নানাবিধ দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান প্রতারণা দেখে আমরা কখনও কখনও হতাশ হয়ে পড়ি। মনে করি, মানুষের ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে গেছে। সামান্য একটু মন খারাপ হলে, কেউ কথা না রাখলে, কেউ একটু কষ্ট দিলে, সামান্য অবিশ্বাসের কাজ করলেই আমরা হতাশ হয়ে পড়ি। হাল ছেড়ে দেই। ফলাও করে হাটে-মাঠে-ঘাটে বলে বেড়াই, ‘আমি কাউকে বিশ্বাস করি না। পৃথিবীর কাউকেই বিশ্বাস করি না। সব বেইমান।’ কিন্তু তার কিছুক্ষণ পর আমরা রিকশায় উঠি। যেখানে রাস্তায় আমরা নিজেরা চলতেই ভয় পাই, সেখানে একজন রিকশাওয়ালার পরিচালন দক্ষতার ওপর আমরা অনায়াসে বিশ্বাস করি। জীবনের নিরাপত্তার দায়িত্বটা তার হাতে তুলে দেই। একবারও ভাবি না তিনি চাইলেই আমাকে একটি চলন্ত ট্রাকের সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন। তার কিছুক্ষণ পর, রাত গভীর হলে, আমরা দূরপাল্লার গাড়িতে চড়ে যাত্রা শুরু করি। যাত্রা শুরু করি দূরে কোথাও। নিশ্চিন্তে ঘুমোই। চালক সামান্য চোখ বন্ধ করলেই আমাদের জীবনের শেষ বাঁশি বেজে যেতে পারে। তবু আমরা বিশ্বাস করি, তিনি ঘুমোবেন না; এবং আমরাই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ি।

যদিও প্রতিদিন তছরুপ হচ্ছে ব্যাংক। তবু রাত পেরুলেই আমরা ব্যাংকের দিকে হাঁটি। জমানো সবটুকু সঞ্চয় তুলে দেই তাদের হাতে। আকাশে যখন পাখির মতো উড়ে বেড়াই, তখনও পাইলটের ওপর ভরসা করি, যন্ত্রের ওপর ভরসা করি। বাসার সাহায্যকারী মেয়েটার রন্ধনশিল্পের ওপর ভরসা করি। প্রযুক্তির ওপর ভরসা করি। দূর্বাঘাস ও বেলিফুলের ওপর ভরসা করি। শত অনিশ্চয়তার পরও হোটেলের খাবার, চাপকলের পানি ও বাজারের আতরের ওপর ভরসা করি। মেঠোফুলের রঙ ও গন্ধের ওপর ভরসা করি। অনলাইন কেনাকাটার ওপর ভরসা করি। গল্পের নায়িকার পরিণতির জন্য লেখকের ওপর ভরসা করি। ভ্যানগগের ছবির ওপর ভরসা করি। রবীন্দ্রনাথের গানের ওপর ভরসা করি। শিশুর সরলতার ওপর ভরসা করি। পুরুষের ব্যক্তিত্বের ওপর ভরসা করি। নারীর ভালোবাসার ওপর ভরসা করি। আর প্রতিবার ভরসা ভঙ্গের পর আমরা আবার বলি, ‘পৃথিবীর মানুষগুলো সব বেইমান। আমি কাউকেই ভরসা করি না, বিশ্বাস করি না।’

প্রকৃতপক্ষে জীবন্ত প্রতিটি মানুষই অন্যের ওপর ভরসা করে। বিশ্বাস করে। বিশ্বাসই আমাদের জীবন। যখনই আমরা বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি তখনই আমাদের মৃত্যু হয়। বস্তুত তখনও আমাদের বিশ্বাসটা টিকে থাকে। তখনও আমরা অন্যের কাঁধের ওপর ভরসা করে শেষযাত্রার পথে এগিয়ে যাই।

শেষ কথাটা হলো, ওয়াহিদ মোল্লাদের মতো কেউ কেউ সারা জীবন আমাদের আবেগের সাথে প্রতারণা করেছে, করেও। আমাদের সারল্যকে পুঁজি করে ঠকিয়েছে, ঠকায়ও। আমরা বিশ্বাস করি, সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষের একটি বৃহত্তর অংশ সরল, শান্তিপ্রিয় ও সৎ। খুব ক্ষুদ্র একটি অংশ প্রতারক। কিন্তু তাতে প্রকৃত মানুষ কখনও সমাজের বৃহত্তম কল্যাণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় না। মানুষ যতবার প্রতারিত হয়; এবং ততবার অন্যকে বিশ্বাস করে। এটাই মানুষের ধর্ম। ফলে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, ওয়াহিদ মোল্লাদের প্রতারণার জন্য সত্যিকারের মানুষ কখনও মানব কল্যাণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না। বিশ্বাস করাই মানুষের ধর্ম, মানুষের স্বভাব। এটি চিরায়ত ও অনিবার্য। অর্থাৎ, পরের কল্যাণার্থে নিজের বিপদ নিশ্চিত জেনেও মানুষ কাষ্ঠাহরণে যাবে, বারবার যাবে; কারণ এটি মানুষের স্বভাব।

লেখক: শিক্ষক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মে দিবসে রাজপথে স্লোগানমুখর শ্রমজীবীরা
মে দিবসে রাজপথে স্লোগানমুখর শ্রমজীবীরা
একাধিক রুশ অঞ্চলে ইউক্রেনের ড্রোন হামলা
একাধিক রুশ অঞ্চলে ইউক্রেনের ড্রোন হামলা
সিয়াম-পরীর গানের ভিউ ১০০ মিলিয়ন!
সিয়াম-পরীর গানের ভিউ ১০০ মিলিয়ন!
আফগানদের বিশ্বকাপ দলে ৬ অলরাউন্ডার 
আফগানদের বিশ্বকাপ দলে ৬ অলরাউন্ডার 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ