শেষ পর্যন্ত সন্ত্রাসীদের শান্ত করতে গ্রেফতার করা হয় নিরীহ ঝুমন দাসকে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এমন গ্রেফতারের ঘটনা এর আগে আমরা আরও দেখেছিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেখানেও ভিক্টিমাইজ করা হয়েছিল রসরাজ নামের একজন হিন্দুকেই, যিনি পেশায় জেলে। যার ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ সেই লোকের ফেসবুকের করা এক পোস্টকে কেন্দ্র করে তাণ্ডব চালানো হয়েছিল গোটা এলাকার হিন্দুদের ওপর। জেলেও নেওয়া হয়েছিল তাকে। পরে প্রমাণিত হয়েছিল সেই ব্যক্তির কোনও ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই, তিনি পুরোপুরি নির্দোষ এবং তাকে ফাঁসানো হয়েছিল।
গত মার্চ মাসে ঝুমন দাসকে গ্রেফতার করা হয়। এরমধ্যে মামুনুল হকও গ্রেফতার হয়ে জেলে আছে। মামুনুল হক একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও সন্ত্রাসের উসকানিদাতা। তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে ফেসবুকে আমরা অনেকেই লেখালেখি করেছি। মামুনুল হক সেই ব্যক্তি যে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। মামুনুল হক সেই ব্যক্তি যে কথায় কথায় ইসলামের দোহাই দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার করে যাচ্ছিল। দুদিন পর পর ধর্মীয় উসকানি দিয়ে দেশের মধ্যে উগ্রবাদকে হাওয়া দিচ্ছিল। অথচ ঝুমন দাস শাস্তি পাচ্ছে সেই সন্ত্রাসীর সমালোচনা করায়। গরিব বলে তার মায়ের আর্তিও পৌঁছাচ্ছে না কারও দুয়ারে। শক্ত কোনও আইনজীবী নিয়োগ করতে পারছেন না তারা। হিন্দুদের ওপর হামলায় যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল তাদের সবাই এখন জামিনে মুক্ত কিন্তু সাতবারেও জামিন হয়নি ঝুমনের।
কেন গ্রেফতার ঝুমন? ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে; অথচ সে ফেসবুকে মামুনুল হকের বিরুদ্ধে স্ট্যাটাস দিয়েছিল। ঝুমন দাসের স্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন, মামুনুল হকের বিরুদ্ধে স্ট্যাটাস দিলে তা কেমন করে ধর্মের অবমাননা হয়? মামুনুল হক কি ধর্মের কান্ডারি? অত্যন্ত যৌক্তিক এই প্রশ্ন।
তাহলে তো আমরা যারাই মামুনুল হকের বিরুদ্ধে লিখেছি তাদের গ্রেফতার করা উচিত। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইন সবার জন্য সমান হবে এটাই নির্ধারিত। সংবিধান আমাদের সেই সমানাধিকার দিয়েছে। আইনি সহায়তা পাওয়ার অধিকার একজন মানুষের জন্মগত অধিকার। রাষ্ট্রের দায়িত্ব প্রতিটি নাগরিককে সেই অধিকার নিশ্চিত করা। রাষ্ট্র কখনও নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে না।
এটা পরিষ্কার যে ঝুমন দাস কোনোভাবেই ধর্মকে অবমাননা করেনি। মামুনুল হক একজন ব্যক্তি এবং তার বিরুদ্ধে অসংখ্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আছে, এমনকি রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধেও তার অনেক বক্তব্য আছে। একজন রাষ্ট্রবিরোধীর বিরুদ্ধে লিখলে সেটা ধর্মের অবমাননা কেন হবে? এমন অযৌক্তিক প্রশ্নে যদি একজন নাগরিককে দিনের পর দিন জেলে রাখা হয় তাহলে আমি বলবো সেটা নাগরিক অধিকারের অবমাননা। ঝুমন দাস তার ন্যূনতম মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সাত মাসেও এই একটি মামলার তদন্ত কেন শেষ হচ্ছে না? এর পেছনে কার অবহেলা বা কাদের স্বার্থ জড়িত? ঝুমন দাস কেবল হিন্দু বলেই যদি তাকে আটকে রাখা জায়েজ হয়ে যায়, তাহলে সেখানে ন্যায়বিচার রক্ষা হয় না। অবিচার মাথা তুলে দাঁড়ায়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দরকার আছে কিন্তু এই আইনের সহায়তায় যেভাবে নিরপরাধীদের হেনস্তা করা হচ্ছে সেটি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। আমরা এই আইনের সংশোধন চেয়ে আসছি অনেক দিন ধরেই। একবার সংশোধন করা হলেও যে ধারাটিকে আশ্রয় করে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে সেটির বাস্তবে কোনও সংশোধন আসেনি। ‘অনুভূতি’ কথাটি সম্পূর্ণ একটি বায়বীয় কথা। এর কোনও নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। এ ধরনের বায়বীয় বিষয় নিয়ে আইনের কোনও ধারা কি নির্ধারণ করা যায়?
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মধ্যে এমন অনেক ফাঁকফোকর আছে, যার সুযোগ নিয়ে ঝুমন দাসের মতো নিরীহদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।
রাষ্ট্রকে মানবিক হতে হবে। এমন কোনও আইন রাখা যাবে না যাকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। ঝুমন দাসের বিরুদ্ধে প্রমাণযোগ্য কোনও অভিযোগ থাকলে সেটিকে সামনে এনেই বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। ঝুমন দাসের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ সেটি কেবল একটি ‘অনুমাননির্ভর অপরাধ’ অথচ যারা এই অনুমানকে কেন্দ্র করে মানুষের বাড়িতে হামলা চালালো, লুটপাট করলো, সেটি তো দৃশ্যমান অপরাধ। সেই অপরাধের অপরাধীরা যদি সহজেই জামিন পেয়ে যেতে পারে তাহলে ঝুমন দাসকে আটকে রাখার পেছনে যুক্তি কী?
একদম সোজাসাপ্টা কথা, রাষ্ট্রের কাছে সব নাগরিক সমান। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষ সবাইকে ন্যায়বিচার দিতে হবে। মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করতে হবে যৌক্তিকভাবেই।
প্রতিদিন ইউটিউব, ফেসবুকে বিভিন্ন মৌলবাদী গোষ্ঠী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জেহাদি ডাক দিয়ে বাণী প্রচার করছে অথচ সেগুলো নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নাই।
ঝুমন দাস অপরাধী হলে তা পরিষ্কার করা হোক। শুধু একটি স্ট্যাটাসের জন্য কোনও নাগরিককে দিনের পর দিন জেলে আটকে রাখাটা চরম অন্যায়।
লেখক: কলামিস্ট