ক্ষমতার সাপলুডু খেলায় তারপর তার সামনে শুধু সিঁড়ি আর সিঁড়ি। নতুন সরকারের অধীনে প্রধানমন্ত্রীর সচিব হলেন। তখন বলা হচ্ছিল যে কোনো মন্ত্রীর চেয়ে তার ক্ষমতা নাকি বেশি। আমলাগিরিতে পোষাচ্ছিল না বলে চাকরি ছেড়ে প্রতিমন্ত্রী হলেন। আধুলি মন্ত্রী হওয়াতে নাকি যথেষ্টই মনক্ষুণ্ন হয়েছিলেন তিনি। সবই চলছিল ভালোই। ওয়ান-ইলাভেন এসে সব ওলটপালট করে দিল। ক্ষমতার সাপলুডু খেলায় যে শুধু ওপরে সিঁড়ি নয়, সাপও গিলে খায় মাঝে মাঝে। আহারে বেচারাকে বুড়ো বয়সে জেলও খাটতে হলো। বেরিয়ে তার সেকি ফোঁস ফাঁস। সংসদীয় কমিটিতে বসে অমুককে ডেকে পাঠায় তো পারলে তমুককে ধরে আনে। তর্জন গর্জন সার। ততদিনে তিনি বুঝে গেছেন, বাঘের ওপরও টাগ থাকে।
ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হয়েছেন। দেখে আর সবার মতো আমিও অবাক হয়েছি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যদের প্রত্যেকের পেছনে পঞ্চাশ বছরের গৌরবের ইতিহাস। কিন্তু মহিউদ্দিন খান আলমগীরের ইতিহাস আমলগিরির, এমনকি একাত্তরেও। সব মানুষের জীবনে একটা অর্জন থাকে। ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর শেষ জীবনে এসে গত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তার আমলে ধসে পড়েছিল সাভারের রানা প্লাজা। তিনি বলেছিলেন, বিএনপি জামায়াতের কর্মীরা অবরোধের কারণে পিলার ধরে নাড়াচাড়া করেছে বলেই রানা প্লাজা ধসে পড়েছে। তার এই নাড়াচাড়া তত্ত্ব ইতিহাসে তাকে অমর করবে রাখবে। খাল কাটার পর নাড়াচাড়া তত্ত্বের জন্য তাকে আরেকটি ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়া যেতে পারে।
চাঁদপুরের কচুয়ায় ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির আ ন ম এহসানুল হক মিলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে আমেরিকা চলে গিয়েছিলেন। সেখানে নাকি ট্যাক্সি চালাতেন। চালাতেই পারেন। উন্নত বিশ্বে কোনও কাজই অসম্মানের নয়। দেশে ফিরে যখন রাজনীতিতে যোগ দিলেন, আমরা তার মধ্যে একটা স্বতস্ফূর্ত তারুণ্যের উচ্ছলতা, দেশের জন্য কিছু করার আগ্রহ দেখেছি। মানতে দ্বিধা নেই বাংলাদেশে পাবলিক পরীক্ষা থেকে নকল দূর করার একক কৃতিত্ব এহছানুল হক মিলনের। কিন্তু একজন ট্যাক্সিচালক কিভাবে একজন ডাকসাইটে আমলাকে হারিয়ে দেয়, এটা কিছুতেই মানতে পারছিলেন না ড. আলমগীর। একবার এহছানুল হক মিলন সংসদে দাড়িয়ে দুঃখ করে বলেছিলেন, মাননীয় স্পিকার ঢাকায় থাকতে পারি না মশার জ্বালায়, এলাকায় থাকতে পারি না মখার জ্বালায়। এখন কই যাব? এবার আক্ষরিক অর্থেই তাই হয়েছে। ‘কই’ও যেতে পারবেন না মিলন। শুনলাম মিলনের বিরুদ্ধে কয়টি মামলা সেটা নাকি বাদী বিবাদী কেউই গুনে শেষ করতে পারবেন না। টিন চুরি, মুরগি চুরি, প্লেট চুরি, মোবাইল চুরি- পুলিশের কোনও ধারা বাকি নেই। কচুয়ায় নাকি এখন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। একনায়কতন্ত্রের সর্বোচ্চ অপপ্রয়োগ হচ্ছে। বিএনপির নেতাকর্মীরা কেউ ঘরে থাকে না। রাস্তাঘাটের অবস্থা নাকি যা-তা। পৌরসভা নির্বাচন কাভার করতে ঢাকা থেকে অনেকেই কচুয়া গিয়েছিলেন। তাদের কাছেই শুনলাম অন্ধকার কচুয়ার গল্প। বললাম, তাহলে নির্বাচন বাদ দিয়ে মানুষের দুরাবস্থা নিয়ে রিপোর্ট করেন। রিপোর্টার হাসতে হাসতে বললো, যে লোক ভাঙা রাস্তায় দাঁড়িয়ে চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে, তার সামনে মাইক ধরলে সেই রাস্তায় দাঁড়িয়েই তিনি বলেন, আমাদের এমপি সাহেব খুব ভালো, উন্নয়নের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে।
আপনারা নিশ্চয়ই বিরক্ত হচ্ছেন, হঠাৎ আমি ড. মহিউদ্দিন আলমগীরকে নিয়ে পড়লাম কেন? সারাজীবন আরাম আয়েশে চাকরি করেছেন, চাকরি ছেড়ে এমপি হয়েছেন, প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হয়েছেন। শুধু সম্মানেই সন্তুষ্ট নন তিনি। নিয়েছেন একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি প্রাইভেট ব্যাংক। সারাজীবন সরকারি চাকরি করা একজন মানুষ কোত্থেকে প্রাইভেট ব্যাংক করার মতো টাকা সে প্রশ্ন নিশ্চয়ই বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর বা দুদক করেছে বা করবে। আমার প্রশ্ন ফারমার্স ব্যাংক কেমন চলছে? বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র উদ্ধৃত করে পত্রিকায় দেখলাম, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুসন্ধানে ফারমার্স বেশ কিছু ঋণ অনিয়মের ঘটনা উদঘাটিত হয়েছে। নামে বেনামে অস্তিত্বহীন কোম্পানির বিপরীতেও বড় অঙ্কের ঋণ অনুমোদন করা হয়। এ ছাড়া ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও বেশ কিছু দুর্বলতা পাওয়া গেছে। নানা অনিয়মের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন নির্দেশনা দিলেও ব্যাংকটি তা যথাযথভাবে পরিপালন করেনি। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক গত ১৩ জ্নুয়ারি ফারমার্স ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়।
এর চারদিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক কর্মকাণ্ডের নিরীক্ষা প্রতিবেদন চেয়েছে সরকারি হিসাব-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। কমিটি মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের নিরীক্ষা বিভাগকে ব্যাংকটির ওপর বিশেষ নিরীক্ষা পরিচালনা করে তার ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন দিতে বলেছে।
এখন মজাটা হলো ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান আর সরকারি হিসাব-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি অভিন্ন ব্যক্তি- ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর। মাত্র তিনবছরেই নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়া ফারমার্স ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করার প্রতিশোধ নিতে মাত্র চারদিন সময় নিলেন তিনি।
সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিতে বলা আছে, কোনও কমিটিতে সাংসদের ব্যক্তিগত স্বার্থ বিবেচিত হওয়ার সুযোগ থাকলে সেই সাংসদ ওই কমিটির সদস্য বা সভাপতি হতে পারবেন না। এটাই কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বা স্বার্থের সংঘাত। এর আগেও এর ব্যত্যয় হয়েছে। রিহ্যাবের সভাপতি পূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটির সভাপতি ছিলেন।
সরকারি হিসাব-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদন চাইতে পারবে না, এমন কোনও কথা নেই। তবে তার আগে অবশ্যই সভাপতির পদ ত্যাগ করতে হবে ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরকে।
ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর একজন গুণী মানুষ। অনেক পড়াশোনা তার। যেভাবে একটিও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার না করে অনর্গল বাংলায় বলতে পারেন, আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। মন্ত্রী-এমপি হিসেবে তিনি অনেকবার অনুরাগ বিরাগের বশবর্তী না হয়ে আচরণ করার শপথ নিয়েছেন। কিন্তু বারবার তিনি তা ভঙ্গ করেছেন।
সব দেখেশুনে আমার খালি প্রশ্ন জাগে এত প্রতিহিংসা অন্তরে নিয়ে একজন লোক ঘুমান কী করে?
লেখক: অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।
ইমেল: probhash2000@gmail.com
২০ জানুয়ারি, ২০১৬