বাংলাদেশবিরোধী মানুষ বাংলাদেশের জন্মের সময় থেকেই ছিল, বলা ভালো তার আগে থেকেই ছিল। ৭০’র নির্বাচন ছিল বাংলাদেশের পক্ষে ম্যান্ডেট। সেই নির্বাচনে যারা আওয়ামী লীগের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে তারা চায়নি বাংলাদেশ স্বাধীন হোক। এই অংশটি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের পাশে থেকে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করেছে।
স্বাধীনতার পর কিছু দিন তারা ঘাপটি মেরে ছিল। কিন্তু ৭৫’র ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর স্বাধীনতাবিরোধী অংশটি আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে তারা নিজেদের সংগঠিত করে, চলে আসে ক্ষমতার কাছাকাছি। জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ার বদান্যতায় স্বাধীনতাবিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে ওঠে জাতীয় পতাকা। যদিও তারা কখনোই তাদের অবস্থান বদলায়নি, বাংলাদেশের অস্তিত্বকে মেনে নেয়নি। স্বাধীনতাবিরোধীদের উত্তরসূরিরাও তাদের পূর্বসূরিদের আদর্শকেই ধারণ করেছে এবং ঝারে-বংশে তারা অনেকে বেড়েছে। বিজয়ের ৫০ বছর পরও একটি দেশে স্বাধীন দেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের অস্তিত্ব থাকাটাই লজ্জার-বেদনার। বিশ্বের কোনও দেশেই স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতি করার সুযোগ থাকে না। আমাদের দেশে তারা শুধু সুযোগই পায়নি, বড় গলায় কথাও বলছে। যত দিন যাচ্ছে, তাদের গলাও তত চওড়া হচ্ছে যেন। ক’দিন আগে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচেও স্বাধীনতাবিরোধীরা পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে খেলা দেখতে গেছে, বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিস্তানের জয়ে উল্লাস প্রকাশ করেছে। তাদের কেউ কেউ এমনও বলেছে, বাংলাদেশ না হয়ে পাকিস্তান থাকলেই ভালো ছিল। এতদিন আমরা জানতাম স্বাধীনতাহীনতায় কেউ বাঁচতে চায় না। কিন্তু ভয়ংকর বেদনার সঙ্গে আমরা দেখছি, নতুন প্রজন্মের কারও কারও কাছেও স্বাধীনতা ভালো লাগছে না।
বাংলাদেশের বিজয় দেশে-বিদেশে অনেকের জন্যই ছিল পরাজয়। তারা সেই পরাজয় মেনে নিতে পারেনি। এমনকি বিজয়ের ৫০ বছর পরও তাদের সেই পরাজয়ের বেদনা কমেনি। স্বাধীনতার পরপর অনেকেই বাংলাদেশের টিকে থাকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। তখনকার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। যদি কিসিঞ্জারদের আশঙ্কা সত্যিও হতো, তাও তো বাংলাদেশ আমাদের দেশ; ধনী হোক, গরিব হোক; বাংলাদেশ আমার মা। মাকে তো আর ফেলে দেওয়া যায় না। তারপরও যদি তাদের আশঙ্কা সত্যি হতো, বাংলাদেশ যদি সত্যি তলাবিহীন ঝুড়ি হতো, বাংলাদেশ যদি পাকিস্তান থেকে পিছিয়ে থাকতো; তাহলেও স্বাধীনতাবিরোধীদের ‘স্বাধীন না হলেই ভালো হতো’ এই মনোভাবের একটা যুক্তি পাওয়া যেতো। কিন্তু সবার সব আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময়, উন্নয়নের রোল মডেল। সব সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। কোনও কোনও সূচকে ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে।
পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ, বঞ্চনা আর বৈষম্য থেকেই রোপিত হয়েছে স্বাধীনতার বীজ। আমি খালি ভাবি আর শঙ্কিত হই, সত্যি সত্যি যদি একাত্তর সালে বাংলাদেশ স্বাধীন না হতো, তাহলে আজ আমাদের কী হতো। মূল পাকিস্তানই আজ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। আর বঞ্চনার ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে, এ অঞ্চলের মানুষকে এখন না খেয়ে মরতে হতো। আর পাকিস্তানের সঙ্গে থাকলে সঙ্গ দোষে পাকিস্তানের পূর্ব অংশও ব্যর্থই হতো। পাকিস্তানের সুশীল সমাজ যখন তাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে ‘হামকো বাংলাদেশ বানা দো’ বলে আকুতি জানায়; তখন বাংলাদেশের কিছু মানুষ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের পক্ষে উল্লাস করে; এ বড় লজ্জার, গ্লানির, বেদনার।
রাজনৈতিক মতবিরোধ থাকবে, হানাহানি থাকবে। কিন্তু তবু বর্তমান বাংলাদেশ নিয়ে, বাংলাদেশের অর্জন নিয়ে সবার গর্ব করা উচিত। এরপরও যারা বাংলাদেশের অর্জন নিয়ে গর্ব করতে পারে না, মনে করে স্বাধীন না হলেই ভালো হতো; তাদের জন্য আমার সব ঘৃণা।
কবি শামসুর রাহমান স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের কঠিন বিচার চেয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন-
‘ফায়ারিং স্কোয়াডে ওদের সারিবদ্ধ দাঁড় করিয়ে নিমেষে ঝাঁ ঝাঁ বুলেটের বৃষ্টি/ঝরালেই সব চুকে বুকে যাবে তা আমি মানি না।/হত্যাকে উৎসব ভেবে যারা পার্কে মাঠে ক্যাম্পাসে বাজারে/বিষাক্ত গ্যাসের মতো মৃত্যুর বীভৎস গন্ধ দিয়েছে ছড়িয়ে,/আমি তো তাদের জন্য অমন সহজ মৃত্যু করি না কামনা।–
অভিশাপ দিচ্ছি ওদের তৃষ্ণায় পানপাত্র প্রতিবার/কানায় কানায় রক্তে উঠবে ভরে, যে রক্ত বাংলায়/বইয়ে দিয়েছে ওরা হিংস্র জোয়ারের মতো।/অভিশাপ দিচ্ছি আকণ্ঠ বিষ্ঠায় ডুবে ওরা অধীর চাইবে ত্রাণ/অথচ ওদের দিকে কেউ দেবে না কখনো ছুঁড়ে একখণ্ড দড়ি।’
শামসুর রাহমান যখন এই কবিতা লিখেছিলেন, তখন কেউ ভাবেনি, এই বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। তবে তার অভিশাপ পুরোটা না হলেও অনেকটাই সত্যি হয়েছে। চার দশক পর হলেও বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে।
এখন আমি অভিশাপ দিচ্ছি, সেই যুদ্ধাপরাধী এবং বুকে পাকিস্তান ধারণ করা তাদের উত্তরসূরিদের। আমি অভিশাপ দিচ্ছি, সেই দজ্জালদের। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী কারও রাজনীতি করার, কথা বলার অধিকার, পছন্দের দলকে সমর্থন করার, বাংলাদেশের বিরোধিতা করার অধিকার থাকতে পারে না। ঝারে-বংশে নির্বংশ করতে হবে স্বাধীনতাবিরোধীদের। ৩০ লাখ মানুষের রক্তে অর্জিত এই দেশ আমাদের সবার, যারা অন্তরে বাংলাদেশকে লালন করে।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ