আমরা সম্প্রতি যে কয়টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দেখেছি, সেখানে হত্যাকারী অভিযোগে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে যারা, তাদের সিংহভাগই কিশোর বয়সী।
তাদের কেউ কেউ রিমান্ডে বা আদালতের কাছে স্বীকার করে বলেছে হাজার পাঁচেক টাকার বিনিময়ে তারা কারও নির্দেশে খুনটি করেছে। যাকে খুন করেছে সে, তার সঙ্গে কোনও বিরোধ ছিল না তাদের, চিনতোও না। কিশোর বয়সীদের পেশাদার খুনি হয়ে ওঠার কারণ কী?
প্রথমত, দেখতে হবে এই কিশোররা সমাজের কোন শ্রেণি থেকে আসছে। অবশ্যই চৌদ্দ আনা আসছে নিম্নবিত্ত থেকে। তাদের শিক্ষা নেই। এদের একটি অংশ পারিবারিকভাবে অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।
কোনও অংশ পারিবারিক বিচ্ছিন্নতার জন্য অপরাধে জড়ায়। মাদকাসক্তির কারণেও কিশোররা এধরনের অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। নেশার টাকা জোগাড় করতেই তারা ভাড়াটে খুনি হচ্ছে। এই ভাড়াটে খুনিরা যে গ্রেফতার হচ্ছে না, তা নয়। গ্রেফতারের পর তারা বের হয়েও আসছে আইনের ফাঁকে। কিশোর অপরাধীরা ব্যবহার হচ্ছে দখলদার, ক্ষমতাশালীদের দ্বারা।
এই প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে। এখন অপরাধ মানেই কিশোরমুখ। সেটা হত্যা হোক, অপহরণ হোক কিংবা মাদকপাচার। এসব অপরাধের সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে তারা, যাদের সঙ্গে পরিবারের একপ্রকার বিচ্ছিন্নতা আছে। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা যেমন ছেলেবেলা থেকেই পরিবার থেকে আলাদা হয়ে যায়। পরিবার তাদের অন্ন, শিক্ষা এবং অন্যান্যের যোগান না দিতে পারায়, তেমনি উচ্চ মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা অতি স্বচ্ছলতার সুযোগে ভোগে নিমজ্জ্বিত হয়। সেই নিমজ্জ্বন তাদের অন্ধকার পথে নিতে যায়। এখানে উভয় শ্রেণির পরিবারের বন্ধনটা জরুরি।
আমাদের সমাজে নানা টানাপড়েনে সেই বন্ধনগুলো আলগা হতে হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পরিবারের কাছে তার সদস্যদের জবাবদিহিতার জায়গা কমে এসেছে। নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো যেমন জানে না তাদের সন্তানেরা কোথায় আছে, কী কাজ বা গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, তেমনি উচ্চবিত্ত পরিবারের কাছেও এই তথ্য নেই। নিচের দিকে শিক্ষা নেই, উপরে শিক্ষা আছে কিন্তু পারিবারিক সুশাসন নেই। নিচের দিকে শিক্ষার পাশাপাশি কাজেরও সঙ্কট আছে। কেবল যে পুঁথিগত শিক্ষা দিতে হবে তা নয়। দরকার কর্মমুখি কারিগরি শিক্ষা। এই কারিগরি শিক্ষার দিকে রাষ্ট্রের নজর কম। কারিগরি শিক্ষা কিশোর-তরুণদের কর্মমুখি করে তুলবে। তারা আয়ের উৎস খুঁজতে অপরাধের দিকে যাবে না।
কাজ না দিয়ে কোনওভাবেই অপরাধ থেকে কিশোর-তরুণদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ সফল হবে না। কেবল আইন ও পুলিশি ব্যবস্থা সামাজিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার উপকরণ হতে পারে না। শিক্ষা ও কাজ দিয়ে অপরাধ থেকে তাদের সরিয়ে আনতে হবে। এজন্য প্রথাগত শিক্ষার বাইরে কারিগরি শিক্ষার দিকে বাড়াতে হবে নজর। সেইসঙ্গে সমাজের উঁচুতলাতেও পারিবারিক সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
ভেবেছেন কখনও? আপনার আশপাশে যে কিশোররা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের যে কেউ আসলে ওঁত পেতে আছে আপনাকে হত্যা বা অপহরণ করতে। অতএব সতর্ক এবং উদ্যোগী হন এ মুহূর্ত থেকেই।
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি