ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসার পথে কোথাও করোনা নিয়ে কাউকে চিন্তিত, উদ্বিগ্ন বা সচেতন মনে হলো না। বিয়ে, রাজনৈতিক সভা, ধর্মীয় মাহফিল, তুমুল কেনাকাটা চলছেই। মাস্ক ও অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করতে দেখিনি। চট্টগ্রাম পৌঁছেও তারকা খচিত হোটেল থেকে শুরু করে সাধারণ হোটেল, মার্কেট, কমিউনিটি সেন্টার, সব কিছুই অতি স্বাভাবিক ভাবে চলছে। এই অতি স্বাভাবিক চলাচলে আমরা খুব বেশিদিন টিকে থাকতে পারি না। অদৃশ্য জীবাণুটি আমাদের আঁকড়ে ধরে। আমরা অসহায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হই। হারাই স্বজন, হারাই কাজ, আরও কত কিছুইতো হারালাম করোনাকালে। তবুও আমরা কেন বারবার ভুলে যাই অদৃশ্য জীবাণুর ছোবলের কথা। এত ক্ষণস্থায়ী কেন আমাদের শোক, পীড়নের অনুভূতি?
অদৃশ্য জীবাণু পৃথিবীর উৎপাদন স্থবির করে দিয়েছে। এখনও খাদ্য এবং শিল্প উৎপাদন স্বাভাবিক হয়নি। খাদ্য পণ্যের দাম প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে। ২০২২ সালকে ভাবা হচ্ছে খাদ্য সংকটের বছর। গোলকে ২০১৯ সালে কাজ হারিয়েছিল ১৯৫ মিলিয়ন মানুষ। ২০২২ সালে সেই সংখ্যাটি ২০৫ মিলিয়নে পৌঁছবে। এই কাজ হারানো মানুষগুলো খাদ্য ঘাটতির মধ্যে আরও সংকটে পড়বে। করোনা যেভাবে ফিরে ফিরে আসছে তাতে কাজের নতুন ক্ষেত্র এবং বন্ধ হয়ে যাওয়া কাজ আবার কখন শুরু হবে বলা মুশকিল। বাংলাদেশেও করোনায় নতুন করে দেড় কোটি মানুষ গরিব হয়েছে। এবার যদি আবারও আংশিক বা সম্পূর্ণ লকডাউনে যেতে হয় তবে গরিবের সংখ্যা আরও বাড়বে।
আমাদের এখানে করোনার বিধি নিষেধে প্রতিবারই দেখছি দুর্ভোগে পড়েন শ্রমজীবী মানুষেরা। কাজ বাঁচানোর জন্যে ঝুঁকি নিয়ে ফিরে আসতে হয়। ছুটি বা বন্ধ ঘোষণায় ঘর ফেরাও ঝুঁকির সঙ্গে। বিধিনিষেধ চলাকালে অন্য আর সব কিছু স্বাভাবিক চললেও দিন মজুরদের ওপর চাপটা আসে বেশি। তাদের পক্ষে জীবন বাঁচানো মুশকিল হয়ে যায়। ঋণ ও সুদ চক্রে তাদের জীবন এখন দুর্বিষহ শহর এবং গ্রামে। কাজ হারিয়ে যারা গ্রামে গিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই এখনও গ্রামে কাজ জোটাতে পারেনি।
খুব বিপর্যয়ের মাঝে আছে শিক্ষা ব্যবস্থা। দুই বছর স্বাভাবিক শিক্ষাক্রমের বাইরে শিক্ষার্থীরা। বিদ্যায়তনে না গিয়ে এক শ্রেণি থেকে অন্য শ্রেণি বা পরের ধাপে চলে যাচ্ছে ঘাটতি রেখেই। এই ঘাটতি অপূরণীয়। ডিজিটাল বা অনলাইনের ক্লাস সকল পর্যায়ের শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছেনি। সামাজিক ও অবকাঠামো বিষয় বিবেচনায় এটি স্বীকার করে নিতেই হবে। এবং এর নেতিবাচক প্রভাবটি দীর্ঘদিন সমাজ ও রাষ্ট্রকে পীড়া দিয়ে যাবে। এই পীড়া সহনীয় করতে আমাদের যে সামষ্টিক পরিকল্পনার প্রয়োজন। কিন্তু সেই পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের তাগিদের চেয়ে করোনাকালে দুর্নীতির উৎসব দেখতে পেয়েছি আমরা। যার ফলে এই মন্দাকালেও নতুন কোটিপতি ও বিদেশে টাকা উড়ে যাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। আমরা যদি আয় ব্যয়ের ভারসাম্য, স্বচ্ছলতার সাম্য নিশ্চিত না করতে পারি তবে, আমাদের প্রবৃদ্ধির অংকে শুভঙ্করের ফাঁকি থেকে যাবে। যা স্বাস্থ্যকর অর্থনীতি মনস্ক নয়।
এই বাস্তবতায় বুঝতে পারছি না কোন নিরাময় চাইবো। অদৃশ্য জীবাণু থেকে নিরাময় নাকি আমাদের যে দুর্নীতি, অনিয়মের অসুখ, সেখান থেকে? বাংলাদেশ, পৃথিবী সকলেরই এই দুই অসুখ থেকে নিরাময় প্রয়োজন। কারণ করোনাকে সামনে রেখে আর্থিক, ব্যবসায়িক অসাধুতা চলছে গোলক জুড়েই। অতএব দুর্নীতি ও করোনা নিরাময়মুক্ত হোক পৃথিবী, এই আর্জিটুকু রাখি।
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী