অবশ্যই দুই দশক আগের নারায়ণগঞ্জ নেই এখন। শহরে যানজট বেড়েছে। পরিচ্ছন্ন শহর বলা যাবে না। এখন এটি বিপণি বিতানে ঠাসা শহর। ঘনত্ব বেড়েছে জনবসতির। তবুও আমার কাছে মনে হয়, এটি এখনও পর্যটন শহর হিসেবে গড়ে ওঠার দাবি রাখে।
বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে দুর্বার হয়ে উঠেছিল নারায়ণগঞ্জ। ভাষা কন্যা মমতাজ বেগমের সেই মরগান স্কুল এখনও আছে। ১৯২৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি এখানে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নারায়ণগঞ্জ হাইস্কুলে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। ব্রিটিশ ভারতে কলকাতার সঙ্গে সমগ্র পূর্ববঙ্গের যোগাযোগ নারায়ণগঞ্জের মাধ্যমে হওয়ার কারণে দেশবরেণ্য নেতাদের পূর্ববঙ্গে আসতে হলে প্রথমে শিয়ালদা থেকে ট্রেনে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ আসতে হতো। এরপর গোয়ালন্দ ঘাট থেকে স্টিমারে (১০০ মাইল) নারায়ণগঞ্জ এসে নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্রেনে ঢাকা বা দেশের অন্যান্য স্থানে যেতে হতো।
স্টিমার সার্ভিসের সুবাদে নারায়ণগঞ্জে আগমন ঘটেছিল উপমহাদেশের বরেণ্য ব্যক্তিত্বদের। এ তালিকায় উল্লেখযোগ্য– মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, স্বামী বিবেকানন্দ, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, শরৎ বোস, উদয় শংকর, পি সি যোশী, কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ। আর রণদা প্রসাদ সাহার কুমুদিনী তো আছেই।
‘প্রাচ্যের ড্যান্ডি’ খ্যাত নারায়ণগঞ্জের পাট ব্যবসার ঐতিহ্য ছিল। ড্যান্ডি ছিল বিশ্বের প্রথম শিল্পোন্নত জুটপোলিস। সেই ঐতিহ্য ডিঙিয়ে এখন শীতলক্ষ্যার দুই তীরে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। এ কারণে নদীদূষণ বেড়েছে। শীতলক্ষ্যার পানি এখন প্রাণ বেঁচে থাকার মতো নয়। অথচ এই নদীকে ঘিরেই দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো পর্যটন কেন্দ্র তৈরি করা যেত।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, নারায়ণগঞ্জকে পর্যটন নগর হিসেবে গড়ে তোলার ‘ব্র্যান্ডিং’ করতে পারেনি প্রশাসন এবং সিটি করপোরেশন। ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু পার্ক, আবাসিক হোটেল হলেও সেগুলোর মান কিংবা রুচিতে ঘাটতি আছে। নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে অবলম্বন না করলে কোনও পর্যটন উদ্যোগই সফল হবে না।
ভোট চলে এলো। রবিবার ভোট। প্রচারণা শেষ। কিন্তু কোনও প্রার্থীর দিক থেকেই নারায়ণগঞ্জ ‘ব্র্যান্ডিং’-এর ইশতেহার বা ধারণাটি এলো না। স্থানীয় ভোটারদের চাহিদাতেও তা নেই। বেশিরভাগ ভোটার এখনও ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ ছাড়িয়ে সামষ্টিকভাবে দেখতে শেখেনি। তারা বাড়ির দুয়ারের সামনের ডাস্টবিন, নর্দমা এবং রাস্তার চাহিদার বাইরে খুব কমই ভাবেন। এসবের সঙ্গে যদি তাদের দাবি হতো– নারায়ণগঞ্জকে দেখতে চাই পর্যটন নগর হিসেবে, তাহলে হয়তো পরিশোধিত হতো শীতলক্ষ্যার জল। কল-কারখানার দূষণও নিয়ন্ত্রণ করা হতো। পরিচ্ছন্ন হতো নগর। নর্দমা-রাস্তার যত্ন বাড়তো। সার্বিকভাবে নগরের প্রতি নগর কর্তারা যত্নশীল হতেন। একইসঙ্গে সিটি করপোরেশনেরও আয়ের উৎস তৈরি হতো।
একেবারে আশা ছেড়ে দিয়ে বসে থাকতে চাই না। ভোট হোক। নারায়ণগঞ্জকে পর্যটন ব্র্যান্ডিং করার দাবি নতুন মেয়রের কাছে শুরুতেই তোলা যেতে পারে। কাউন্সিলরদের সঙ্গে নিয়ে মেয়র নিজেও নতুনভাবে এই শহরকে সাজিয়ে তুলতে পারেন। ভোটে যিনিই জয়ী হয়ে আসবেন, তার কাছে একজন পর্যটক হিসেবে আমার দাবি থাকবে– রোদ বা বৃষ্টির আলোয় লাবণ্য নেমে আসা দুর্গন্ধমুক্ত শীতলক্ষ্যার পাড়ে বসে এক কাপ চা খেতে চাই।
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী