মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা: অবহেলা বনাম সফলতা

কাবিল সাদিগত প্রায় এক দশকে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদে জঙ্গি তৎপরতা ও দেশীয় রাজনীতি এবং সরকারের বিভিন্ন নীতিতে প্রভাব বিস্তারকারী কাওমি মাদ্রাসাভিত্তিক ধর্মীয় সংগঠন হিসেবে হেফাজতে ইসলামের উত্থানকে কেন্দ্র করে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে নানা আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় ওঠে। সেই সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষার মান নিয়েও অনেক বুদ্ধিজীবী এই শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারেরও প্রশ্ন তোলেন। এমনকি কোনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয় নানা শর্তের বেড়াজালে কিছু কিছু বিভাগে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ভর্তির পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রবণতাও দেখা যায়। তবে যেসব ক্ষেত্রে তাদের ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ রয়েছে সেখানেই তারা তাদের মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন বারবার, এমনকি শিক্ষা সমাপ্তির পর একইভাবে সরকারি চাকরির সর্বোচ্চ স্থান বিসিএস ক্যাডারসহ অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি চাকরিতেই তাদের প্রবেশ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। আর তাদের সেই সফলতার পরিধিও যেন বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন। অথচ বিপরীত দিকে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে রয়েছে নানা অবহেলা।

গত বছরের শেষের দিকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষায় তাদের সফলতা ঈর্ষণীয় স্থান দখল করে নেয়।

দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২০২১ স্নাতক শিক্ষাবর্ষের  ভর্তি পরীক্ষায় ‘খ’ ইউনিটে প্রথম  হয়েছেন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী  সাখাওয়াত জাকারিয়া এবং এই প্রথম দেশব্যাপী ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষে ‘খ’ ইউনিট গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ঘ’ ইউনিটে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিক বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন যে শিক্ষার্থী সেই রাফিদ সাফওয়ানও মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের জন্য এই ‘খ’ ইউনিটই প্রধান এবং এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শীর্ষস্থানীয়।

এছাড়াও বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স) ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষের  ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকারী সাদ ইবনে আহমাদ, একই শিক্ষাবর্ষের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সরকারি সাত কলেজ ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকারী  হাসিবুর রহমান এবং জাতীয় অর্থোপেডিক্স হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র (নিটোর)-এ প্রথম হওয়া মো. নাজমুল আলমও মাদ্রাসা শিক্ষার্থী হওয়ায় এই আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।

এই সফলতার অধিকাংশ শিক্ষার্থীই  ঢাকার ডেমরার দারুন্নাজাত সিদ্দিকীয়া কামিল মাদ্রাসা ও তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার। তারা দেশের নামিদামি কলেজগুলোকে পেছনে ফেলে অর্জন করেছে এই ঈর্ষণীয় সাফল্য।

তাই শিক্ষাঙ্গনে এই গুরুত্বপূর্ণ ও তুমুল প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরীক্ষায় মাদ্রাসা ছাত্রদের মেধার আধিপত্য  আলোচনার পরিধি আরও বাড়িয়েছে; বিশেষ করে যাদের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা অনেকটাই অবহেলিত এবং অনেক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে মাদ্রাসা শিক্ষা পদ্ধতি এখনও প্রাচীন এবং কোনোভাবেই মানসম্মত নয়; বিশেষ করে তাদের বাংলা ও ইংরেজিতে প্রচুর দুর্বলতা আছে।

এমনকি খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের একজন অধ্যাপক এক টকশোতে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের এই ইংরেজির দক্ষতাকে কটাক্ষ করে সাধারণ শিক্ষার তথা স্কুলের তৃতীয়- চতুর্থ শ্রেণির ইংরেজি বলে সমালোচনা করেছিলেন কিন্তু সম্প্রতি মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক সফলতার আলোচনা তাদের এই কটাক্ষ বা  সমালোচনাকেই  বরং সমালোচিত করেছে এবং ট্রল করা হচ্ছে  নানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে। তবে মজার বিষয় হলো, ইতোপূর্বে এভাবে আলোচনায় না এলেও মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা শিক্ষার্থীদের মূলধারার সাধারণ শিক্ষায় প্রবেশের  সফলতার নজির এবারই প্রথম নয়; বরং দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের, বিশেষ করে মানবিক  শাখার স্নাতক ভর্তি পরীক্ষায় টপটেন মেধা তালিকায় মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সুযোগ পাওয়া একটি ধারাবাহিক রেকর্ড।

এটাও বলা প্রয়োজন যে মাদ্রাসাগুলোতে বাণিজ্য শাখা না থাকায় এবং হাতে গোনা কিছু মাদ্রাসা ছাড়া বিজ্ঞান বিভাগ না থাকায় বা থাকলেও পর্যাপ্ত শিক্ষা সরঞ্জামাদির অপ্রতুলতার কারণে এসব ইউনিটে তাদের ভালো করার কোনও রেকর্ড তেমন একটা নজরে আসে না। ইতিহাস বিভাগের ওই অধ্যাপকের মতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক শাখার প্রায় ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থীই মাদ্রাসা থেকে আসা এবং তিনি একটি হাস্যকর যুক্তিও দেখিয়েছেন এর পেছনে নাকি ৮০ নম্বরের অ্যাকাডেমিক পরীক্ষার জিপিএ স্কোর, যা মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই পেয়ে যান; এমনকি তিনি মনে করেন সেখানে অ্যাকাডেমিক নম্বর দেওয়া শুরুই হয় ৯০ শতাংশ থেকে, যা রীতিমত হাস্যকর। কেননা, ওনার এই যুক্তিতে মাদ্রাসায় শতভাগ জিপিএ, গোল্ডেন এ প্লাস বা এ প্লাস পাওয়ার কথা এবং সেই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবিক শাখায় ৮০-৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীই মাদ্রাসা থেকে আসার কথা অথচ বাস্তবতা হলো, এসব বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নে যতটা এসএসসি বা এইচএসসি তথা সাধারণ শিক্ষার সিলেবাস থেকে প্রশ্ন করা হয় সেই অনুপাতে আরবি বা ইসলামি তো দূরে থাক, বরং মাদ্রাসার দাখিল বা আলিম সিলেবাস থেকেও সেই অনুপাতে প্রশ্ন করা হয় না। সুতরাং এমন উদ্ভট, অযৌক্তিক এবং হাস্যকর মন্তব্য একজন দায়িত্বশীল শিক্ষিত ব্যক্তি থেকে আশা করা যায় না।

আরও মজার বিষয় হলো, এবার  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই অ্যাকাডেমিক স্কোর ৮০ থেকে ২০-এ নামিয়ে আনার পরও সেই একইভাবে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা তাদের ধারাবাহিক সফলতা বজায় রেখেছেন। শুধু তা-ই নয়, এই অধ্যাপক আশঙ্কা প্রকাশ করছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এভাবে মাদ্রাসা ছাত্রদের ভর্তির সুযোগ ঘটলে অচিরেই এটি উচ্চতর মাদ্রাসায় পরিণত হবে। অথচ তিনি ভুলেই গেলেন তারেক মাসুদের মতো জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতারা মাদ্রাসা থেকে পড়ে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনন্য মর্যাদা এনে দিয়েছিলেন এবং ফুটিয়ে তুলেছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে ধর্মান্ধ মানুষের প্রকৃত সত্য।


যাহোক, এসব অবান্তর ঠুনকো প্রশ্নের থেকেও এখন বড়  প্রশ্ন হলো মূলধারার সাধারণ শিক্ষা পদ্ধতির বাইরে ও তুলনামূলক কম সুবিধা পাওয়া কথিত প্রাচীন শিক্ষা পদ্ধতির নানাভাবে অবহেলিত  প্রতিষ্ঠান থেকে কীভাবে প্রতিযোগিতার পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং আনুপাতিক হারে দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়। এই প্রশ্নগুলোর একটি সাধারণ উত্তর হলো, মাদ্রাসা শিক্ষা ও তার ইতিহাস নিয়ে আমাদের অধিকাংশ ধারণাই ভুল। উপমহাদেশে উচ্চশিক্ষার শুরুটা কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষার মধ্য দিয়েই, যা আমরা অনেকেই হয়তো জানিই না।

ভারতবর্ষে মাদ্রাসা শিক্ষার সূচনা হয় ৭১১ সালে, মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের পরপরই। সিন্ধু বিজয়ের হাত ধরে ভারতে মাদ্রাসা শিক্ষা বা ইসলামি শিক্ষার যাত্রা শুরু হলেও প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয় এরও বেশ কিছুকাল পর।

তৎকালীন ১৮০০ সালের ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার আগেই ১৭৮০ সালে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের (১৭৩২-১৮১৮ সালে) অনুমোদনক্রমে ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক শিক্ষার সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা। ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজি শিক্ষার নতুন ধারা ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৫৪ সালের পরবর্তীকালে। আর উপমহাদেশের প্রথম কওমি মাদ্রাসা দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬৬ সালে।

এতে প্রতীয়মান হয় উপমহাদেশে সাধারণ শিক্ষা ও বেসরকারি পর্যায়ে ইসলামি শিক্ষা, তথা কওমি ধারার শিক্ষাব্যবস্থা চালু হওয়ার আগেই আলিয়া নেসাবের শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। তাই গোটা ভারতবর্ষে আলিয়া মাদ্রাসা নেসাবের শিক্ষাব্যবস্থাটিই এই অঞ্চলের প্রাতিষ্ঠানিক ও উচ্চতর ধারার সর্বপ্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা। সময়ের ব্যবধানে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা ভারত ভাগের পর ১৯৪৭ সালে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়।

লক্ষণীয়, সে সময়ে যারা বড় বড় রাজনীতিবিদ বা সমাজ সংস্কারক ছিলেন তাদের অনেকেই মাদ্রাসা পড়ুয়া। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ বীর মীর নিসার আলী তিতুমীর, সৈয়দ আমীর আলী এবং ভাষা শিক্ষার নিমিত্তে রাজা রামমোহন রায়ও পাটনা মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছিলেন (তথ্যসূত্র: বঙ্গদর্শন)। তাদের সমাজ সংস্কার ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অবদান স্বর্ণাক্ষরে আজও ইতিহাসে লেখা। আমাদের বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই হয়তো জানেন না, আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক গুরু এবং অবিভক্ত বাংলার শেষ মুখ্যমন্ত্রী সেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার আরবি বিভাগের ছাত্র ছিলেন। এছাড়াও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীও মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, তাজউদ্দীন আহমদও তাঁর বাবার সরাসরি তত্ত্বাবধানে পবিত্র কোরআনে হাফেজ হয়েছিলেন।

এছাড়াও মাওলানা আকরম খাঁ, আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশদের মতো ইতিহাস অলংকৃত বাঘা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও ছিলেন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। কালের ধারাবাহিকতায় এ দেশে যেভাবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সাধারণ শিক্ষার প্রসার ঘটেছে সেই তুলনায় মাদ্রাসা শিক্ষায় প্রসার ঘটেনি। ফলে, মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিন দিন কমেছে বই বাড়েনি।

বর্তমান সরকারের আমলে কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি, দারুল আরকাম ইবতেদায়ি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও আলিয়া মাদ্রাসাগুলোর ভবন নির্মাণের জন্য বিশাল অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সরকারের এসব উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য কিন্তু দুঃখজনক হলো, গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিকে আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা অবহেলার শিকার হওয়ায় এ ধারায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমেই কমছে।

শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের আমলে ঈর্ষণীয় সাফল্যের একটি হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ। তিন শতাধিক মাধ্যমিক বিদ্যালয় সরকারি করা হয়েছে। ৩০০ কলেজ সরকারি করা হয়েছে। ২৬ হাজার ১৯৩টি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি করা হয়েছে, কিন্তু একটি স্বতন্ত্র বা সংযুক্ত ইবতেদায়ি মাদরাসাও সরকারি করা হয়নি। তিন শতাধিক মাধ্যমিক বিদ্যালয় সরকারি করা হলেও একটি দাখিল মাদরাসাও সরকারি করা হয়নি। ৩০০ কলেজ সরকারি করা হলেও একটি আলিম বা ফাজিল অথবা কামিল মাদরাসাও সরকারি করা হয়নি। অথচ মাদরাসার শিক্ষার্থীরা মেধা ও প্রতিভার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে বারবার।

অন্যদিকে দীর্ঘদিন অপেক্ষার পরেও বেতন ভাতার অভাবে এবং জাতীয়করণ না করায় অধিকাংশ ইবতেদায়ি মাদ্রাসা উঠে গেছে। ফলে মাদ্রাসাগুলোর উপরের শ্রেণিতে ছাত্র সংকট গাণিতিক হারে বেড়েই চলেছে।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে একটি মহল মাদ্রাসা শিক্ষাকে নানাভাবে অপরাধী চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত করবার চেষ্টা করেছেন; এমনকি বর্তমান সময়ে নানা কারণেই জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে ঢালাওভাবে আঙুল তোলার চেষ্টা করা হয়। যদিও সাম্প্রতিক অনেক জঙ্গি হামলার ঘটনায় আমরা দেখেছি ইংরেজি মাধ্যম পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও সম্পৃক্ত। তাই ঢালাওভাবে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমকে অভিযুক্ত করাও সঠিক নয়। সমাজে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অভাব থাকলে যেকোনও মাধ্যমের তরুণরাই বিপদগামী হয়ে যেতে পারে।

আর এজন্যই ২০১৮ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন আয়োজিত আলিয়া মাদরাসা শিক্ষকদের মহাসমাবেশ উদ্বোধন শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু, ধর্মান্ধ নয়। আমি বিশ্বাস করি, যারা কোরআনকে ধারণ করে তারা কখনও জঙ্গি হতে পারে না। প্রথমে বলা হতো মাদ্রাসার ছেলেরা জঙ্গি। কিন্তু আমিই প্রথম উচ্চ গলায় বলেছিলাম, মাদ্রাসার সঙ্গে জঙ্গিবাদের কোনও সম্পৃক্ততা নেই। মাদ্রাসার ছাত্ররা জঙ্গি নয়। জঙ্গি হতে পারে না।’ (সূত্র: ২৭ জানুয়ারি, ২০১৮, দৈনিক যুগান্তর)

যাহোক, আমাদের বুদ্ধিজীবী, পলিসি মেকার এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের মাদ্রাসা শিক্ষার সমালোচনা বা বিতর্ক ছড়ানো বিষয়ে আরও বেশি সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে এবং সরকারকে সাধারণ শিক্ষা প্রসারের পাশাপাশি ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা প্রসারে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও বেশি আধুনিকায়নের আওতায় এনে মেধাবীদের দেশের উন্নয়নের কাজে লাগাতে হবে। প্রকৃত ধর্মীয় জ্ঞানের মাধ্যমে যেমন সামাজিক মূল্যবোধ বাড়ানোর পাশাপাশি প্রকৃত ধর্মচর্চা ও  উদ্ভূত সাম্প্রতিক  জঙ্গি ও সন্ত্রাসী তৎপরতার হ্রাস করা সম্ভব, অন্যদিকে বিদেশি ভাষা হিসেবে আরবি ভাষার দক্ষতা অর্জন করতে পারলে আমাদের রেমিট্যান্স প্রাপ্তির স্বর্গভূমি মধ্যপ্রাচ্যে মানবসম্পদ রফতানির মাধ্যমে অর্জিত হবে বৈদেশিক মুদ্রা, যা অবদান রাখবে এ দেশের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নে। সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে জাতীয়করণ ও অন্যান্য বৈষম্য চলমান থাকলে মেধাবীদের একটি বড় অংশই হারিয়ে যাবে আমাদের অবহেলার নীতিতে, যা মূলত আত্মঘাতী সিদ্ধান্তেরই শামিল।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, মেধাবীদের বৃহৎ অংশকে পাশ কাটিয়ে উন্নয়নের মাধ্যমে স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়ন অসম্ভব।

লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা