জাহানারা ইমামের সঙ্গে আরও ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী নূরুজ্জামান ও বর্তমান নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। কলেজ পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থী নিয়মিত সব মিছিল মিটিংয়ে অংশ নিচ্ছিলাম। চোখে সামনে গড়ে উঠলো গণআদালত। সে এক অনুভূতির সময় আমাদের। দারুণ উত্তেজনা আর আবেগের নাম হয়ে গেলো একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, যা সংক্ষেপে “নির্মূল কমিটি” নামে পরিচিত।
বিএনপি ক্ষমতায় তখন। সেই বিরূপ সময়ে সাহসিকতার সঙ্গে বিএনপি বাদে সব রাজনৈতিক দল একত্রিত হলো ঘাতকদের বিচারের দাবিতে। গণআদালতে গোলাম আযমকে যুদ্ধাপরাধী ঘোষণা করে তার বিরুদ্ধে শাস্তি ঘোষণা করা হলো। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সবচেয়ে বড় দল আওয়ামী লীগের তখন বিশাল বিশাল জমায়েত। আজকে যারা এই লেখা পড়ছেন তাদের একটা বড় অংশ যারা বয়সে তরুণ তারা কোনোভাবেই অনুধাবন করতে পারবেন না কোনও ধরনের বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশে সেদিন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি করার সাহস দেখিয়েছিলেন কিছু মানুষ। বিএনপি’র হাত ধরে জামায়াতের মতো ঘাতকদের দল স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত।
সেই নির্মূল কমিটির ৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমি কিছু লিখবো বা লেখার সৌভাগ্য হবে সেটি আমি ৯২ সালে কোনোভাবেই কল্পনা করিনি। আমার সৌভাগ্য যে আজকে আমি নির্মূল কমিটির সঙ্গে অফিসিয়ালি যুক্ত আছি। তারা আমাকে দেশের জন্য কিছু করার সুযোগ করে দিয়েছেন। মূলত ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিই বাংলাদেশে প্রথম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসকে সাধারণ মানুষের দুয়ারে পৌঁছে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিল। তারা নিজ দায়িত্বে দেশে ও বিদেশে নেটওয়ার্কিং গড়ে তুলে মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে অমীমাংসিত কিছু দাবি আবারও জীবিত করে তুলেছিলেন।
শহীদ জননীর মৃত্যুর পর এর পুরোপুরি দায়িত্বে আসেন আজকের সবার পরিচিত মুখ শাহরিয়ার কবির। আমরা এ প্রজন্মের কে না জানি, কেবল যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে একগুঁয়ে ও নাছোড়বান্দা হওয়ার কারণে এই শাহরিয়ার কবিরকে কী পরিমাণ হেয় করার চেষ্টা করেছে জামায়াতের সমর্থকরা। এখনও চলছে সেই প্রচেষ্টা। বিএনপি সরকারের দেওয়া রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা মাথায় নিয়েই মৃত্যুবরণ করেছেন আমাদের সবার “আম্মা” শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।
আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করেন নির্মূল কমিটিকে আমি কেন শ্রদ্ধা করবো বা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে কেন নির্মূল কমিটির ইতিহাস তুলে ধরা প্রয়োজন, তাহলে একবাক্যে যা বলবো সেটি হলো, সেদিনের, ১৯৯২ সালে নির্মূল কমিটির জন্ম না হলে হয়তো ২০১৩ সালে গণজাগরণ সৃষ্টি হতো না। নির্মূল কমিটির জন্ম না হলে আমাদের জীবদ্দশায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়তো দেখে যেতে পারতাম না। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগ হয়তো তাদের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিল কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের শিকড় এতটাই শক্ত হয়ে গিয়েছিল যে ক্ষমতার রাজনীতি করা দল আওয়ামী লীগও হয়তো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজটি এতটা নিঃসংকোচে সাহস করতে পারতো না। এই একটা জায়গায় নির্মূল কমিটি তাদের প্রধান ঢাল হিসেবে কাজ করেছে। আরেকটা বিষয় হলো, আজকের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যতটা জানার সুযোগ পাচ্ছে অথবা সারা বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যতটা আলোচনা বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ হচ্ছে, তার সিংহভাগ কৃতিত্ব নির্মূল কমিটির।
জামায়াতের সহিংসতার বিরুদ্ধে শ্বেতপত্র প্রকাশ, হিন্দু জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক হামলার শ্বেতপত্র প্রকাশ নির্মূল কমিটির অন্যতম ঐতিহাসিক দলিল। আঞ্চলিক বা দেশের বাইরে কোনও রাজনৈতিক দলেরও এতটা ভিত্তি নেই, যতটা নির্মূল কমিটির আছে। কেবল দেশকে ভালোবেসে, মুক্তিযুদ্ধকে ভিত্তি করে কোনও কিছু বিনিময়ের আশা না করে যেসব লোক জীবনের স্বর্ণালি সময় উৎসর্গ করেছেন, আজকের এই বিশেষ দিনে তাদের প্রতি আমি বাংলাদেশের একটি প্রজন্মের পক্ষ থেকে বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই।
জন্মদিনের এই শুভক্ষণে আমি চাই, নির্মূল কমিটির এই কার্যক্রম আরও বেশি সামনে নিয়ে আসতে হবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যেন মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পৌঁছে যায়, সেই শক্ত কাজটি দলিলবদ্ধ করতে হবে প্রজন্মের স্বার্থে। ৭৫ পরবর্তী সময়ে ইতিহাস বিকৃতি বা বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অংশে ফিরিয়ে নেওয়ার যে অপচেষ্টা করেছিল স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, ভবিষ্যতে যেন এমন দুঃসাহস আর কেউ করতে না পারে এই কাজটি করতে হবে দায়িত্বের জায়গা থেকে। ভবিষ্যৎ কোনও সরকার যেন আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কাজ করার চিন্তাও না করে, এমন ব্যবস্থার লড়াইটি করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারকে সঙ্গে নিয়েই।
লেখক: কলামিস্ট