ওমিক্রনই শেষ কথা নয়

ডা. মালিহা মান্নান আহমেদসত্যি করে বলুন তো, এই মহামারির আগে ‘অ্যান্টি-ভেক্সার’ বা ‘সায়েন্স ডিনায়ার’ (বিজ্ঞান অস্বীকারকারী)’ এই টার্মগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের লোকজন কতটা পরিচিত ছিল? সম্প্রতি ভ্যাকসিন না নেওয়া টেনিস তারকা নোভাক জোকোভিচকে অস্ট্রেলিয়া থেকে ফের পাঠানো নিয়ে যে নাটুকে ঘটনাগুলো ঘটলো সেই ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। কোভিড পজিটিভ হওয়ার পরও ওই সেলিব্রেটিকে দেখা গেছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে, ফটোসেশন করতে। এ ধরনের বেপরোয়া আচরণ পশ্চিমে খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। যেখানে ব্যক্তি অধিকারের সঙ্গে বুঝতে গিয়ে অনেক সময় জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়।

সৌভাগ্য যে আমাদের এখানে সমষ্টিগত কল্যাণই অগ্রাধিকার পায়। রেকর্ড বলছে, এখনকার তুলনায় আগে আমরা ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে থাকলেও এখন কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনেশন প্রচেষ্টার হাত ধরে সেটা আবার দাঁড়িয়ে গেছে।

ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের শুরুর দিকেই আমাদের জনগণের একটা বড় অংশ বুস্টার ডোজ নেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। অবশ্য ইসরায়েলের মতো দেশ যেখানে তাদের জনগণকে চতুর্থ ডোজ দিতে শুরু করেছে, সেখানে আমাদের মাত্র ৩৩ শতাংশ দুই ডোজের আওতায় এসেছে। আমরা যদিও সবাইকে পূর্ণাঙ্গ টিকার আওতায় আনতে কোমর বেঁধে নেমেছি, তথাপি ওমিক্রন সম্ভবত কাউকেই ছাড় দেবে না, বিশেষ করে শহরের বাসিন্দাদের। বিদ্যুৎগতিতে ভ্যাকসিন আবিষ্কার হতে থাকলেও নিত্যনতুন ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে বিশ্বকে সবসময় পাল্লা দিয়েই চলতে হবে।

ভ্যারিয়েন্টগুলো আসলে কী করে?

ইমিউনো-কম্প্রোমাইজড রোগীদের (যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল) কাছ থেকেই ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট আসে বলে ধারণা করা হয়। সার্স-কোভ২ হলো একটি আরএনএ ভাইরাস, যা মানবদেহের কোষে ঢুকেই নিজের কপি বানাতে শুরু করে। নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার জন্য ভাইরাসটি নিজের ভেতর প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনার সময় পায় না (জীববিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে প্রুফরিডিং)। এ সময় মানবদেহের রোগ প্রতিরোধক কোষগুলো ভাইরাসটিকে নির্মূল করতে শুরু করে। ভাইরাসটি তখন আরও কপি বানাতে থাকে ও নিজের ভোল পাল্টানোর চেষ্টা করতে থাকে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ অবস্থায় রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যদি দুর্বল হয়ে থাকে, তবে ভাইরাসটি নিজেকে বদলানোর মতো যথেষ্ট সময় পায় ও একপর্যায়ে সম্পূর্ণ নতুন ভ্যারিয়েন্ট আকারে আত্মপ্রকাশ করে।

সাউথ আফ্রিকার একজন রোগীর শরীরে টানা ২১৬ দিন টিকে থাকতে দেখা গিয়েছিল নতুন সেই ভাইরাসটিকে।

আর এ কারণেই ক্যানসারে আক্রান্ত, অঙ্গ প্রতিস্থাপনকারী ব্যক্তি, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ও অটো-ইমিউন রোগে আক্রান্তদের নিরাপত্তা দিতে হবে। সুস্থতা শুধু তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, নতুন ভ্যারিয়েন্ট যেন তৈরি না হয় সেজন্যেও বাড়তি দেখভাল জরুরি। আর আগাগোড়া বদলে যাওয়া নতুন কোনও সংক্রামক ভ্যারিয়েন্ট কিন্তু এখনকার টিকাগুলোকে মুহূর্তেই অকার্যকর প্রমাণ করে দিতে পারে।

আরেকটি তত্ত্ব অনুযায়ী নতুন ভ্যারিয়েন্ট হলো ‘রিভার্স জুনোসিস’ নামের একটি প্রক্রিয়ার ফল। এর মানে হলো, ভাইরাসটি মানুষ থেকে অন্য প্রাণীতে যাবে, এরপর আবার সেই প্রাণী থেকে মানুষে ফিরে আসবে। চীনা গবেষকরা এরইমধ্যে দাবি করেছেন, মানুষের শরীর থেকে এরইমধ্যে ওমিক্রনের একটি পরিবর্তিত স্ট্রেইন ইঁদুরের শরীরে ঢুকেছে। যা মিউটেট হয়ে আবার মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পেরেছে। আর তাই এটা জানাও জরুরি যে উহানে থাকা প্রথম রোগীটা (প্যাশেন্ট জিরো) কে ছিলেন, তিনি কী করে আক্রান্ত হলেন—ওটা কি বাদুড় থেকে বনরুইয়ের শরীর ঘুরে মানুষের ভেতর এলো কিনা—নাকি ওটা কোনও ল্যাব থেকেই বের হয়ে গেছে।

ওমিক্রন কি ‘প্যান্ডেমিক’ থেকে ‘এন্ডেমিক’ হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে?

ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের কম সিভিয়ারিটি দেখে আমরা আশা করতে পারি যে প্যান্ডেমিক (বৈশ্বিক মহামারি) থেকে এখন এন্ডেমিকের (স্থানীয় পর্যায়ে সংক্রমণ) দিকে যাচ্ছে। তবে ‘কোভিড জিরো’ তথা পুরোপুরি নির্মূল হবে এমনটা আশা করা একেবারেই যাচ্ছে না। কেননা, ভাইরাসটা এখন পোল্ট্রি, বাদুড় ও ইঁদুরের ভেতরও শনাক্ত করতে পেরেছেন ইমপেরিয়াল কলেজ অব লন্ডনের গবেষকরা।

ভ্যারিয়েন্টটির যেহেতু বাহকের অভাব হচ্ছে না এবং এটি এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীর মধ্যেও সহজে ছড়াতে পারছে, তাই বিবর্তিত হয়ে যেকোনও দিকেই মোড় নিতে পারে পরিস্থিতি।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, অনেক ভাইরাস বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। কন্টাক্ট ট্রেসিং প্রক্রিয়া ও নিজে থেকে বদলে যাওয়ার কারণে সার্স ও সোয়াইন ফ্লু-ও এখন প্রায় বিলুপ্ত। ফ্লু ভাইরাস পরিবর্তিত হয়। ১২০ বছর আগে যে ভাইরাসটি ছিল সেটা এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু এরপর এলো কিছু মৌসুমি ভাইরাস—এইচআইভি ও ইবোলা কিন্তু প্রতিনিয়ত নিজেদের বদলাচ্ছে। যে কারণে এদের জন্য জেনেরিক ভ্যাকসিন তৈরি করাটাও প্রায় অসম্ভব।

ওমিক্রন কত দ্রুত ছড়ায়, সাধারণ লক্ষণগুলো কী?

শ্বাসনালির ওপরের অংশে দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধি করে ওমিক্রন। এর ইনকিউবেশন পিরিয়ড মাত্র তিন দিন। আর আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে এটা তিন থেকে ছয় দিনের মধ্যেই সবচেয়ে দ্রুত ছড়ায়। ছড়ানোর প্রক্রিয়াটা ৯ দিনব্যাপীও চলতে পারে। ছড়ানোর ফলে যেহেতু একজন থেকে গড়ে অন্তত দশ জন আক্রান্ত হতে পারে, তাই এ ভাইরাসের ক্ষেত্রে কন্টাক্ট ট্রেসিং খুব কঠিন কাজ। যদিও ৮০ ভাগের মধ্যে মৃদু উপসর্গ বা কোনও লক্ষণই দেখা যায় না, তথাপি এর উচ্চ সংক্রমণশীলতার কারণে এটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ব্যাপক চাপ তৈরি করতে পারে। এ ছাড়া ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের মতো কো-মরবিডিটিযুক্ত রোগীদের ক্ষেত্রে বড় ঝুঁকি থেকেই যায়।

টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এ ভাইরাসের সাধারণ লক্ষণগুলো হলো, নাক আটকে যাওয়া, মাথাব্যথা, শরীরে ব্যথা, কাশি, হাঁচি, গলা ব্যথা, অবসাদগ্রস্ততা ও মৃদু জ্বর। টিকা নেয়নি এমন শিশু ও তরুণদের ক্ষেত্রে একদিন ধরে বেশি জ্বর থাকতে পারে (১০২ ডিগ্রির মতো)। সঙ্গে অল্প সময়ের জন্য দেখা দিতে পারে প্রচণ্ড কাশি ও সর্দি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এই লক্ষণগুলো দ্রুত কেটে যায় এবং ৭০ ভাগের ক্ষেত্রে হাসপাতালে যেতে হয় না।

ফুসফুসের ভেতরকার কোষগুলোকে আক্রান্ত করতে ওমিক্রনকে বেশ বেগ পেতে হয়, যে কারণে এটি ডেল্টার চেয়ে কম মারাত্মক। তবে ওমিক্রনের সংক্রমণশীলতা ১০ হলেও ডেল্টার সংক্রমণশীলতা মাত্র ৫। আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর এ সূচক ছিল ২ থেকে ৩।

ওমিক্রনের ক্ষেত্রে স্বাদ-গন্ধের অনুভূতি হারানোর ঘটনা খুব একটা দেখা যায় না। আবার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া অনেকের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে তাদের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে না বা অক্সিজেন স্যাচুরেশনও মারাত্মক পর্যায়ে কমে যাচ্ছে না।

ব্রেকথ্রু কেস অনেক, টিকা কি কাজে আসছে?

উত্তর হলো ‘হ্যাঁ’। ভ্যাকসিন আমাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে। কমিয়ে দিচ্ছে রোগের তীব্রতা ও মৃত্যুর ঝুঁকি। ওমিক্রনে মোট মিউটেশন (জিনগত পরিবর্তন) আছে  ৫৯টি। এরমধ্যে ৩৬টি পরিবর্তন দেখা গেছে স্পাইক প্রোটিনে। যেগুলো শুরুর দিকের উহান স্ট্রেইন থেকে বেশ ভিন্ন। ইউএস সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, তৃতীয় বুস্টার ডোজ, বিশেষ করে সেটা ফাইজার বা মডার্নার টিকা হলে তা ওমিক্রনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী নিরাপত্তা তৈরি করে। যাদের দ্বিতীয় ডোজের ছয় মাস পেরিয়েছে, তাদের জন্য ডোজ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে জোরেশোরে।

ওমিক্রনে ব্রেকথ্রু ইনফেকশনের পর (টিকা নেওয়ার পরও যারা আক্রান্ত) এর তীব্রতা, মারাত্মক অবস্থা ও দীর্ঘমেয়াদি কোভিড সিম্পটমগুলোর ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা টিকা নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।

গবেষণায় দেখা গেছে, নতুন ভ্যারিয়েন্টের ভিন্ন স্পাইক প্রোটিনকে যদি অ্যান্টিবডি আলাদা করে শনাক্ত করতে না-ও পারে, তবু টি-সেলগুলো সব স্পাইক প্রোটিনের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে বড় আকারে ইমিউনিটি তৈরি করতে পারে।

ফাইজার ও মডার্না বলেছে, তারা ১০০ দিনের মধ্যেই ওমিক্রনের জন্য বিশেষায়িত ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারবে। তবে বিশেষজ্ঞরা ওই টিকাকে এখনই সবুজ সংকেত দিচ্ছেন না। কারণ, বর্তমান ভ্যাকসিনগুলো ‘ক্রস-ইমিউনিটি’ দিচ্ছে, এবং তারা শরীরে দুই স্তরের একটি সিস্টেম তৈরি হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে চাচ্ছেন, যেখানে কিনা দরিদ্র দেশগুলো এখনও মেয়াদোত্তীর্ণ ভ্যাকসিন নিয়েই আটকে আছে।

নতুন কোনও পরামর্শ?

গাইডলাইনগুলো আগের মতোই আছে—মাস্ক পরতে হবে, সামাজিক দূরত্ব, টিকা ও ভেনটিলেশন ব্যবস্থা থাকতে হবে। এভাবে টানা দু’বছর ধরে চলার কারণে জনগণের ভেতর তৈরি হওয়া অবসাদ, সংক্রমণ সম্পর্কে আরও ভালো করে জানা, রোগের মারাত্মক অবস্থা কম থাকা, নতুন ওষুধ ও ভ্যাকসিনেশন; এসবের কারণে লোকজনের সচেতনতা অনেকটা কমে গেছে। আবার ওমিক্রনের সংক্রমণশীলতা এমন যে, আমরা খুব দ্রুত এর চূড়ান্ত রূপটা দেখতে পাবো। আবার সেই সঙ্গে এর দ্রুত পতনও দেখবো। কারণ, এরমধ্যে প্রায় সবাইকেই ভাইরাসটি সংক্রমিত করবে। সাউথ আফ্রিকা ও যুক্তরাজ্য এরই মধ্যে দাবি করেছে যে তারা ওমিক্রনের ‘পিক’ পার করে এসেছে।

ওমিক্রনকে বলা যায় উহান স্ট্রেইনের ‘দূরবর্তী আত্মীয়’। আমরা আপাতত শুধু আশা করতে পারি যে সার্স-কোভ২ ভাইরাসটি একপর্যায়ে অন্য চারটি কমন কোল্ড করোনাভাইরাসের দলে যোগ দেবে এবং অন্য কোনও মারাত্মক ভ্যারিয়েন্টে রূপ নেবে না। নতুন স্ট্রেইনের জন্য উপযোগী করেই ভ্যাকসিন বানানো এখন জরুরি, অথবা এমন ‘মাল্টিভ্যালেন্ট ফরমুলেশন’ কৌশল নেওয়া উচিত, যাতে ভ্যাকসিনটা একাধিক স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে কার্যকর হয়। যে কাজটা করে থাকে সিজনাল ফ্লু ভ্যাকসিনগুলো।

‘টিকা জীবন বাঁচায়’ এটা বাংলাদেশিদের মননে একদম গেঁথেই আছে বলা যায়। আর তাই জনগণকে টিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করতে সরকারের পুরস্কার ঘোষণা করতে হবে না। আমাদের তাই এখন যতটা সম্ভব দ্রুত সবাইকে টিকার আওতায় আনতে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। কারণ, ব্রেকথ্রু কেইস, তথা পুনরায় আক্রান্ত হলেও এই টিকাই পারবে হাসপাতালে ভর্তি কিংবা মৃত্যু ঠেকাতে।

লেখক: অর্গানিকেয়ার-এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক। এমবিবিএস, এমবিএ ও হেলথ কেয়ার লিডারশিপে স্নাতকোত্তর।