তিন বছর আগে অবসরে যাওয়া একজন শিক্ষক যেটা পারলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য, প্রক্টর, শিক্ষকরা সেটা পারলেন না কেন? আমি এই প্রশ্নটার উত্তর খুঁজছি। অনেকে বলছেন, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগের একদফা আন্দোলনে যুক্তির চেয়ে আবেগ বেশি। এটা কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আবেগ থাকারই কথা। কিন্তু সেই আবেগকে ধারণ করে মমতার হাত নিয়ে তাদের পিঠে হাত বুলিয়ে দেওয়ার মতো একজন শিক্ষকও কি সেখানে নেই? বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদ লিজার বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ তুলে তার পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলেন হলের কয়েক শ’ ছাত্রী। একটি হলের শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ প্রশমনের জন্য উপাচার্য নয় প্রক্টরের উদ্যোগই যথেষ্ট হওয়ার কথা। তাতো হলোই না, প্রভোস্টের পদত্যাগের আন্দোলন বদলে গেলো উপাচার্যের পদত্যাগের একদফা আন্দোলনে। এটা অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, উপাচার্য, শিক্ষকদের ব্যর্থতা। গত সপ্তাহে এই কলামে ‘ভয় দেখিয়ে জয় করা যায় না’ শিরোনামে আমি লিখেছিলাম ‘আমার মনে হয়, শিক্ষার্থীদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে, তাদের পিঠে মমতার স্পর্শ বুলিয়ে, তাদের ক্ষোভের জায়গাটা অনুধাবন করেই সহজে এই সমস্যার সমাধান করা যেত। ভয় দেখিয়ে নয়, জয় করা যেত ভালোবেসেই। কিন্তু আমরা গায়ের জোরের ওপর বেশি নির্ভর করতে গিয়ে ভালোবাসতেই ভুলে গেছি।’
ড. জাফর ইকবাল ঢাকা থেকে ছুটে গিয়ে আবারও প্রমাণ করলেন, শিক্ষার্থীরা যত আবেগীই হোক, যত অনড়ই থাকুক; ভালোবেসে তাদের হৃদয়ও জয় করা যায়।
আগেই বলেছি, আন্দোলনটা শুরু হয়েছে প্রভোস্টের পদত্যাগের দাবিতে। যেটা পরে বদলে গেছে উপাচার্যের পদত্যাগের একদফা দাবিতে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ এভাবে হামলা চালাতে পারে; লাঠি-গুলি-টিয়ার গ্যাস-সাউন্ড গ্রেনেড নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে; এটা আসলে অবিশ্বাস্য। আন্দোলন বদলে যাওয়াটা সেই অবিশ্বাস আর অভিমান থেকেই আসা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যুক্তির চেয়ে আবেগ বেশি, তারচেয়ে বেশি অভিমান। ‘আমাদের ক্যাম্পাসে আমাদের শিক্ষকদের সামনে পুলিশ এভাবে আমাদের ওপর হামলা করতে পারলো’ এই তীব্র অভিমানই তাদের অনমনীয় করে তুলেছে। আমরণ অনশন ভাঙ্গলেও উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি থেকে এখনও সরে আসেনি তারা। তবে জাফর ইকবাল পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। ছাত্রলীগ দিয়ে হামলা, পুলিশ দিয়ে হামলা, পুলিশের মামলা, আন্দোলনের সমর্থকদের গ্রেফতার, বিকাশ বন্ধ, খাবার বন্ধ করে আন্দোলন দমানো যাবে না। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলতে হবে, তাদের অভিমানের জায়গাটা বুঝতে হবে। জয় করতে হবে ভালোবাসা দিয়েই।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি অবশ্য সে পথেই হাঁটলেন। সব দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের প্রশংসা করেছেন। শিগগিরই তাদের সঙ্গে আলোচনার কথা বলেছেন। শুধু শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজমান অভিন্ন সমস্যার যৌক্তিক সমস্যার আশ্বাস দিয়েছেন। আশ্বাস দিয়েছেন মামলা প্রত্যাহার, গ্রেফতার করা সাবেক শিক্ষার্থীদের মুক্তির। তবে শিক্ষামন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দেয়নি শিক্ষার্থীরা। আমরণ অনশন ভাঙলেও উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে অনড় তারা। তবু শিক্ষামন্ত্রীর কণ্ঠে যে মমতার ছোঁয়া ছিল, তাতেই যেন সমস্যার সমাধান হয়। শিক্ষার্থীদের সব যৌক্তিক দাবি যেন মেনে নেওয়া হয়।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ