X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভয় দেখিয়ে জয় করা যায় না

প্রভাষ আমিন
২০ জানুয়ারি ২০২২, ১৬:৫৭আপডেট : ২০ জানুয়ারি ২০২২, ১৬:৫৭

প্রভাষ আমিন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ডামাডোলে একটু আড়ালেই পড়ে গিয়েছিল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। কিন্তু পুলিশের হামলা আড়াল সরিয়ে সবার সামনে নিয়ে সে আন্দোলনের খবর। সারা দেশের মানুষ এখন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করা শিক্ষার্থীদের খবর জানতে চায়। তিলকে কীভাবে তাল বানাতে হয়, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তার বড় প্রমাণ।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ঠিক এক সপ্তাহ পূর্ণ হলো আজ। ঠিক গত বৃহস্পতিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদ লিজার বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ তুলে তার পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন হলের কয়েকশ’ ছাত্রী। শনিবার সন্ধ্যার দিকে ছাত্রলীগ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে। পরদিন রবিবার বিকালে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি ভবনে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেন। উপাচার্যকে উদ্ধার করতে গিয়ে পুলিশ শিক্ষার্থীদের লাঠিচার্জ করে, শটগানের গুলি এবং সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। তারপর থেকেই আন্দোলন একদফার– উপাচার্যের পদত্যাগ। রবিবার রাতেই কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ও শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষের নির্দেশ উপেক্ষা করে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে তারা। বুধবার রাত থেকে ২৪ জন শিক্ষার্থী আমরণ অনশন শুরু করেছে।

প্রবল শীতে শিক্ষার্থীরা রাতভর উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অনশন করছে; এরচেয়ে বেদনাদায়ক দৃশ্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আর কী হতে পারে। অথচ শিক্ষার্থীরা কিন্তু উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেনি। একটি ছাত্রী হলের প্রভোস্টের পদত্যাগের আন্দোলনকে উপাচার্যের পদত্যাগের আন্দোলনে টেনে নেওয়ার ‘কৃতিত্ব’ অবশ্যই ছাত্রলীগ আর পুলিশের। আমি একটা বিষয় বুঝি না, শিক্ষার্থীদের আবেগকে বোঝা, মমতা নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কোনও শিক্ষক কি শাহজালালে নেই। উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ দাবি করেছেন, তিনি পুলিশকে হামলা চালাতে বলেননি। আমরা তার কথা বিশ্বাস করছি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যখন পুলিশ ডেকে আনবেন, তখন তো পরিস্থিতি আর তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। পুলিশ তো পুলিশের মতোই আচরণ করবে। প্রভোস্টের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে নামা কয়েকশ’ ছাত্রীকে দমন করতেও বুঝি পুলিশ লাগে।

এটা ঠিক আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ এখন আর আগের মতো নেই। শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসার সম্পর্কটা এখন আর নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের প্রধান যোগ্যতা হলো দলীয় আনুগত্য। আর এই আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের বিরুদ্ধে প্রায়শই দুর্নীতি, অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। একটি উপাচার্যের বিরুদ্ধে যখন দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ওঠে, তখন আমরা বুঝি ঘুণ আমাদের কত গভীরে পৌঁছে গেছে। সত্যি বলতে, শুরুর দিকে উপাচার্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ শুনলে আমি অবিশ্বাসে চমকে যেতাম। একের পর এক অভিযোগ আসতে আসতে বিষয়টা এখন আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। উপাচার্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগটা গা সওয়া হয়ে যাওয়াটা আমাদের সমাজের জন্য, জাতির জন্য বিপজ্জনক। এরপর আমরা আর কিছুতেই অবাক হবো না।

তবে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা অনিয়মের অভিযোগ নেই। ছাত্রীদের ক্ষোভকে মমতার সঙ্গে প্রশমিত করতে না পারায় তিল আজ তাল হয়ে গেছে। একটা বিষয় কিছুতেই মাথায় ঢোকে না, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান, যারা ছাত্রলীগ করেন; তারা কি জানেন না পুলিশ দিয়ে কখনও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমন করা অসম্ভব। যুগে যুগে কখনও যায়নি। বরং বাধা দিলেই বাধে লড়াই। শিক্ষার্থীরা হলো উপাচার্য বা শিক্ষকদের সন্তানের মতো। তাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে ক্লাসে ফেরানো যাবে না, এটা আমি বিশ্বাস করি না। দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই এখন শান্ত। আপাতত শান্ত; কারণ সব ক্যাম্পাসেই ছাত্রলীগের একক আধিপত্য। বিরোধীরা ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারেন না বলে কোনও অশান্তি হয় না। কিন্তু আপাতত শান্ত মনে হওয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা কিন্তু একেকজন ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মতো। তাদের ক্ষোভের লাভা যদি একবার উদগিরণ শুরু হয়, তা কিন্তু ভাসিয়ে নিতে পারে অনেক কিছু। কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন থেকে সরকার, পুলিশ এবং ছাত্রলীগের শিক্ষা নেওয়া উচিত ছিল। তাদের বোঝা উচিত ছিল ভয় দেখিয়ে জয় করা যায় না, জয় করতে হয় ভালোবাসা দিয়ে। গত মঙ্গলবার প্রথম আলোর প্রথম পাতায় একটি চমৎকার ছবি ছাপা হয়েছে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ভিসির বাসার সামনে অবস্থান নেওয়া পুলিশকে ফুল দিয়ে অনুরোধ করছে ক্যাম্পাস ছাড়ার জন্য। অথচ এই পুলিশই আগের দিন তাদের ওপর শটগানের গুলি ছুড়েছে, সাউন্ড গ্রেনেড মেরেছে। আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীরা যদি এতটা সংযত হতে পারে; উপাচার্য, শিক্ষক, ছাত্রলীগ, পুলিশ কেন গায়ের জোরে সমস্যা সমাধান করতে চাইবে। আর চাইলেও সেটা হবে না।

একজন উপাচার্যের পদত্যাগেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, ব্যাপারটি এমন নয়। ব্যাপারটি আসলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগের জায়গায় চলে গেছে। যদি পদত্যাগেই সমাধান হয়, তাহলে হয়তো শাহজালালের উপাচার্যকেও পদত্যাগ করতে হবে। তবে আমার মনে হয়, শিক্ষার্থীদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে, তাদের পিঠে মমতার স্পর্শ বুলিয়ে, তাদের ক্ষোভের জায়গাটা অনুধাবন করেই সহজে এই সমস্যার সমাধান করা যেতো। ভয় দেখিয়ে নয়, জয় করা যেতো ভালোবেসেই। কিন্তু আমরা গায়ের জোরের ওপর বেশি নির্ভর করতে গিয়ে ভালোবাসতেই ভুলে গেছি।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউরোপা লিগ থেকে বিদায়ের ভালো দিক দেখছেন লিভারপুল কোচ
ইউরোপা লিগ থেকে বিদায়ের ভালো দিক দেখছেন লিভারপুল কোচ
রাশিয়ায় বোমারু বিমান বিধ্বস্ত
রাশিয়ায় বোমারু বিমান বিধ্বস্ত
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীদের নিতে জাহাজ আসবে এ সপ্তাহেই
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীদের নিতে জাহাজ আসবে এ সপ্তাহেই
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কড়া নিরাপত্তায় চলছে ভোটগ্রহণ
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কড়া নিরাপত্তায় চলছে ভোটগ্রহণ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ