দেশের দুর্নীতি বুঝতে টিআই'র সূচক কতটা জরুরি?

আমীন আল রশীদবার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) যেদিন দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রকাশ করে জানালো যে বাংলাদেশ হচ্ছে পৃথিবীর শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে ১৩তম, তার পরদিনই গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশে ব্যবসায় প্রথম বাধা দুর্নীতি। ব্যবসায়ীদের বরাত দিয়ে সিপিডি বলছে, বাংলাদেশে ব্যবসা করতে ব্যবসায়ীরা যে ১৬টি সমস্যার মুখোমুখি হন, দুর্নীতি তার মধ্যে এক নম্বরে।

প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের দুর্নীতি বোঝার জন্য কোনও আন্তর্জাতিক সংস্থার সূচক বা জরিপ কতটা জরুরি?

টিআই ‘র দুর্নীতির ধারণা সূচকে এ বছরও দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের আগে আছে কেবল তালেবানশাসিত আফগানিস্তান। তাছাড়া এশিয়ায় তৃতীয় এবং বিশ্বে শীর্ষ ১৩তম।

দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০২১-এ টানা চতুর্থবার বাংলাদেশের স্কোর (২৬) অপরিবর্তিত। বৈশ্বিক গড় স্কোরের (৪৩) তুলনায় এবারও বাংলাদেশের স্কোর অনেক কম এবং গতবারের মতোই বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বনিম্ন স্কোর ও অবস্থানে আছে।

টিআই’র এই রিপোর্ট বাংলাদেশে প্রকাশ করে টিআইবি, অর্থাৎ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। তারা বলছে, গত এক দশকের সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ও অবস্থানের স্থবিরতা প্রমাণ করে, দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা আশঙ্কাজনক।

প্রসঙ্গত, এবারের সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন থেকে গণনা অনুযায়ী ২০২০-এর তুলনায় এক ধাপ উন্নতি হয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। প্রশ্ন হলো, এই এক ধাপ উন্নতিকে আসলে উন্নতি বলা যাবে কিনা? এই এক ধাপ উন্নতির মধ্য দিয়ে কি এটি প্রমাণিত হয় বাংলাদেশে দুর্নীতি কমেছে?

২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত টিআই’র সূচকে দুর্নীতিতে বাংলাদেশ ছিল এক নম্বরে। তখন বাংলাদেশকে বলা হতো ‘দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন’। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকেও দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন শব্দটি বেশ জোরেশোরে বলা হতো। কিন্তু প্রশ্ন হলো, গত ১৫-১৬ বছরে দেশের দুর্নীতি কি অনেক কমেছে? যদি না কমে তাহলে এবার ১৩তম হলো কী করে? আর যদি দুর্নীতি কমে, তাহলে এর প্রভাব কোথায় কোথায় পড়ছে এবং তার দৃশ্যমানতা কতটুকু?

সিপিআই অনুযায়ী দুর্নীতি হচ্ছে ব্যক্তিগত সুবিধা বা লাভের জন্য ‘সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার’ (abuse of public office for private gain)। টিআইবির অন্য গবেষণায়ই বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সরকারি খাতে সেবা নিতে গিয়ে ৮৯ শতাংশ মানুষ ঘুষ দিতে বাধ্য হন। তার মানে বাকি ১১ শতাংশ মানুষ বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় খুবই সৌভাগ্যবান, যাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবা পেতে গিয়ে কোনও ঘুষ দিতে হয় না। শুধু তা-ই নয়, ঘুষ এখন এমনই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে যে সরকারি অফিসে কোনও কাজ করতে গিয়ে ঘুষ দিতে হবে না, এটি এখন নাগরিকদের বৃহৎ অংশের ধারণারও বাইরে। বিশেষ কিছু প্রতিষ্ঠানে ঘুষ ও দুর্নীতি মোটামুটি নিয়মে পরিণত হয়েছে।

ভবনের নকশা অনুমোদন, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ, চিকিৎসা, থানা, আদালত, ব্যাংকসহ সেবাদানকারী যেকোনও প্রতিষ্ঠানেই দুর্নীতি যে কমেনি, বরং কোনও কোনও ক্ষেত্রে বেড়েছে, তা আশপাশে তাকালেই বোঝা যায়। শুধু বিভিন্ন সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রেই নয়, চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রেও দুর্নীতি আগের চেয়ে বহুগুণ যে বেড়েছে, তা জানা-বোঝার জন্য আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বললেই পরিষ্কার হওয়া যায়। এখানে টিআই’র রিপোর্টে কী থাকলো বা না থাকলো, সেটি জরুরি নয়। বরং টিআই’র রিপোর্ট কিছু সংবাদ, কিছু নিবন্ধ, কিছু টকশো আর বিতর্ক তৈরি করতে পারে। কিন্তু দুর্নীতি কমানোর জন্য বা দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সিদ্ধান্ত প্রয়োজন, সেখানে এখনও যে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে, তা নিশ্চয়ই কেউ অস্বীকার করবেন না।

শুধু দুর্নীতি নয়, প্রতি বছর আইনের শাসনের সূচক তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্য ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট (ডব্লিউজেপি); যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য ইকোনমিস্ট প্রকাশ করে বৈশ্বিক গণতন্ত্রের সূচক; অস্ট্রেলিয়ার সিডনিভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড পিস প্রকাশ করে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ সূচক; বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম বা ডব্লিউইএফ প্রকাশ করে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচক; যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নাগরিকত্ব ও পরিকল্পনা বিষয়ক ফার্ম ‘হেনলি’ প্রকাশ করে বৈশ্বিক পাসপোর্ট সূচক ইত্যাদি। কিন্তু এর কোনও সূচকেই বাংলাদেশ খুব আশাব্যঞ্জক অবস্থানে থাকে না। তবে এও ঠিক যে বাংলাদেশের দুর্নীতি বা আইনের শাসন বোঝার জন্য এসব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সূচক আমলে না নিলেও বাংলাদেশের মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনে বিবিধ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তা টের পায়।

দুর্নীতি একটি ধারণা বা পারসেপশন। যে কারণে টিআইর এই জরিপের নামও করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স। যেমন, ছোটবেলা থেকেই আমরা শুনে আসছি, ‘পুলিশ ঘুষ খায়’। কিন্তু এরপর জানা গেলো, শুধু পুলিশ নয়, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মী, শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী এমনকি শিক্ষক-সাংবাদিকরাও নানাবিধ অনিয়ম দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের হাজার কোটি টাকা লোপাট করেন। জনগণের করের পয়সায় পরিচালিত যেকোনও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে লুটপাট ও দুর্নীতি এখন স্বতঃসিদ্ধ। ফলে এখন এ প্রশ্নটিই অধিকতর সঙ্গত, তা হলো- কোন খাতটি দুর্নীতিমুক্ত?

বিশেষ করে ভূমি ও স্বাস্থ্য খাতের প্রকট দুর্নীতি, উচ্চ পর্যায়ের অনেক দুর্নীতির বিচার না হওয়া, আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে ভয়াবহ খেলাপি ঋণ ও জালিয়াতি, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের অবস্থান ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়া এবং ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতার ঘাটতিও বৈশ্বিক বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেয়।

সুতরাং টিআই’র এই সূচক আপনি মানবেন কী মানবেন না; এই সূচক নির্ধারণের পদ্ধতি নিয়ে আপনি প্রশ্ন তুলবেন কী তুলবেন না—সেটি অন্য তর্ক। বরং বাংলাদেশ যে বিশ্বের শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলো মধ্যে অন্যতম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তান এবং আমাদের আগে যে অন্য কোনও দেশের থাকার চান্স কম, সেটি বোঝার জন্য, জানার জন্য এরকম সূচক বা জরিপ না হলেও চলে। শুধু সরকারি অফিসগুলোয় যেকোনও কাজের জন্য গেলেই টের পাওয়া যায় দুর্নীতি কাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী এবং কীভাবে নাগরিকদের হয়রানি করে, ট্র্যাপে ফেলে দুর্নীতির জালে বন্দি করা হয়। অবশ্য আপনি ক্ষমতাবান কেউ হলে সরকারি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি আপনাকে স্পর্শ নাও করতে পারে।

এ বছর টিআইয়ের প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেছেন, ‘আজ ঘুমাতে যাবেন, কালই দেশ দুর্নীতিমুক্ত হয়ে যাবে- এমনটা সম্ভব নয়।’ তবে দেশে দুর্নীতি বেড়েছে না কমেছে—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘দুর্নীতি বাড়লো না কমলো তা আমরা বলবো না। আমাদের কাছে দুর্নীতির অভিযোগ এলে সেটা অনুসন্ধান করে বিচারের আওতায় আনা হলো আমাদের কাজ।’

দুদক চেয়ারম্যানের এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমতের সুযোগ কম। কেননা, একটি দেশ থেকে দুর্নীতি ওভারনাইট (রাতারাতি) দূর হয়ে যায় না। এটা সম্ভবও নয়। কারণ, দুর্নীতি হচ্ছে এমন একটি বিষবৃক্ষ, যা বছরের পর বছর ধরে মহীরুহে পরিণত হয় এবং এই বিষবৃক্ষটি রাষ্ট্রের প্রভাবশালী মহল এবং নীতিনির্ধারকদের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই বেড়ে ওঠে।

সুতরাং খুব সৎ ও দেশপ্রেমিক একজন শাসকও যদি চান যে তিনি তার দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করবেন, সেটিও একদিনেই করা সম্ভব নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, গত অর্ধশত বছরে যারা দেশ শাসন করেছেন এবং বর্তমানে করছেন, তারা দেশকে পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত করতে কতটা সিরিয়াস ছিলেন?

রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স বা শূন্য সহনশীলতা নীতির কথা ঘোষণা করেন, কিন্তু বাস্তবতা হলো সরকারি কেনাকাটা ও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে যে ভয়াবহ দুর্নীতি এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় যেকোনও কাজ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে হয়রানি ও দুর্নীতির শিকার হতে হয়, সেখান থেকে উত্তরণের খুব বেশি লক্ষণ দেখা যায় না। উপরন্তু দুর্নীতি ও অনিয়মের ইনোভেটিভ অনেক আইডিয়া বেরিয়ে আসে, যার ফলে বালিশকাণ্ড, রডের বদলে বাঁশ, উদ্বোধনের আগেই সেতু ভেঙে পড়ার মতো বিষয় নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় নাগরিকরা রসিকতা করেন।

দুর্নীতির মতো অতি সিরিয়াস বিষয় নিয়েও মানুষ কেন রসিকতা করে? তারা হয়তো জানেন, এটা নিয়ে সিরিয়াস আলাপ করে লাভ নেই অথবা এই রসিকতাটাই প্রতিবাদের ভাষা। সুতরাং, টিআইয়ের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ১৩তম নাকি ২৩তম, তারচেয়ে বড় কথা দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে রাষ্ট্রের পদক্ষেপগুলো কী? নীতিনির্ধারকরাই চান কিনা যে দেশ পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত হোক?

প্রতিটি সরকারের আমলেই তার দলের নেতাকর্মী ও অনুসারীরা দুর্নীতি করার সুযোগ না পেলে সেই দলটি অজনপ্রিয় হয়ে যাবে কিনা এবং নেতাকর্মীরা সংকটে পড়বে কিনা—সেটিও বাংলাদেশের পলিটিক্যাল সায়েন্সে একটি বড় প্রশ্ন।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।