এই যুগে লেখকদের কদর কেমন?

আনোয়ার সাদীমানিক বাবু মানে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যদি এখন বেঁচে থাকতেন তাহলে তিনি কি অর্থকষ্টে থাকতেন? কিংবা জীবনানন্দ যদি এখন বেঁচে থাকতেন তাহলে তার জীবন কি রাজকীয় হতো?

পাঠক মাত্রই জানেন, যে দুজন লেখকের নাম বললাম, তাদের মেধা নিয়ে প্রশ্ন করার কোনও সুযোগ নেই।

আচ্ছা, হুমায়ূন আহমেদ যদি এখন বেঁচে থাকতেন তাহলে কী তিনি ওল্ড মিডিয়া নিয়ে পড়ে থাকতেন, নাকি নিউ মিডিয়ায় আয় করতেন?

আমার ধারণা, তিনি ইউটিউবের জন্য নাটক, সিনেমা বা কনটেন্ট বানাতেন। অবশ্য টিভি তাকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করতো। সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত রাখতো ‘চ্যানেল আঁখি’। এই নামটি তিনি হিমু সিরিজের একটি বইয়ে ব্যবহার করেছিলেন। বইটির নাম নাম সম্ভবত হিমু ও কালো র‌্যাব।

টিভি প্রথমে নিজেদের বক্সে আয় করতো টাকায়, পরে একই কনটেন্ট ডলারে বেচতো নেটে।

মানিক বা জীবনানন্দ বেঁচে ছিলেন ‘টেক্সট’ মানে সাদা কালোর জগতে। কাগজও সাদা, নিউজপ্রিন্টের বিষয়টি আলাদা, তর্কের খাতিরে তাকেও সাদা ধরে নিন। এ কারণেই কি তাদের টাকা কম ছিল?

হুমায়ূন আহমেদ নতুন প্রযুক্তি কাজে লাগিয়েছেন, মানে টিভির রঙিন ছোট পর্দা ও সিনেমার বড় পর্দায় আয় করেছেন কড়কড়ে নোট। পুরোটা তার পকেটে গেছে এমন নয়, ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলে, নিজে আয় করেন, অন্যকেও আয় করার সুযোগ দেন। এটাকে ব্যক্তির বিকাশ বলে। সে হিসাবে হুমায়ূন আহমেদ বিকশিত হয়েছিলেন, সামনে আরও সুযোগ ছিল।

বই লিখে হুমায়ূন আহমেদের আয় হয়েছে অনেক। পাঠকপ্রিয়তা ও ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা দেখে তিনি পরপারে যেতে পেরেছেন। পৃথিবীর অনেক বড় লেখকের সেই সৌভাগ্য হয়নি। তারপরও মনে প্রশ্ন জাগে, এই জনপ্রিয়তা কি কেবল লেখা থেকে এসেছে? লেখার হুমায়ূনকে প্রথমে ভালোবেসে নাটকের হুমায়ূনে কী মুগ্ধ হয়েছে জনতা? নাকি নাটকের দর্শক একইসঙ্গে নিজেকে পাঠকে রূপান্তর করেছে, তা একটা দামি প্রশ্ন হতে পারে।

বলছি, যুগের সঙ্গে প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এই যে সাফল্য অর্জন, এর নিরিখে অতীতের লেখকের তুলনা করা কতটা কাজের কাজ হয়? খুব একটা নয়। কেননা, এখনও আমাদের অনেক লেখকই টিভি বা সিনেমাকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পেরেছেন বলা যায় না। বিশেষ করে সিনেমা আমাদের লেখকদের খুব একটা কাজে লাগাতে পারছে, তা বলা যাবে না। ফলে, শক্তিশালী চিত্রনাট্যের এখন অভাব, ভালো বাংলা সিনেমা কষ্ট করে খুঁজে নিতে হয়। সিনেমা আলোচিত না হয়ে, শিল্পীদের নির্বাচন ও নানা নাটকীয়তা ধারাবাহিকভাবে আলোচিত হতে থাকে।

ফেব্রুয়ারি মাস এসেছে। দেশে করোনা মহামারির প্রকোপ থাকলেও প্রেস পাড়ায় দারুণ ব্যস্ততা চলছে। প্রকাশকরা কপালে কিছুটা চিন্তার রেখা ফুটিয়ে মাসটির জন্যে অপেক্ষা করছেন। তাদের লগ্নি উঠে মুনাফা হবে তো? তারা শুনেছেন মেলার সময় কিছুটা কমছে। আবার শীত পার হতে হতে করোনা সংক্রমণ দ্রুত কমবে কিনা, তার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে। বিশেষ করে লোকসমাগম ভালো হওয়া ব্যবসার জন্যে বিশেষভাবে দরকার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ভাইরাস ঠোকানোর অন্যতম উপায় হলো মানুষদের দূরে দূরে রাখা।

যাহোক, প্রতিবছর মেলা হয়, অনেকেই নতুন করে মেলায় মলাটবদ্ধ হন। তাদের চোখে অনেক স্বপ্ন থাকে। লেখক জীবন পার করার স্বপ্ন। অনেকে একটা চাকরি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, অনেকে লেখালেখি ছেড়ে দেন, তাদের স্বপ্নভঙ্গের সাক্ষী হয়ে পরের বছর আবারও বই মেলা চলে আসে। কিন্তু মেলার পর প্রকাশিত বই নিয়ে বড়মাপে কোনও মূল্যায়ন হয় কি?

গত বছর প্রকাশিত নতুন উপন্যাস বা গল্পের কোনও চরিত্র জাতীয় জীবনে আলোচিত হয়েছে কি? তার কোনও প্রভাব কি জাতীয় জীবনে পড়েছে?

আমি বলছি না মেলায় কোনও ভালো বই প্রকাশিত হয়নি। জাতির মানস গঠনে অবদান রাখবে এমন বই প্রকাশিত হয়নি, এ কথাও আমি মানতে নারাজ। কিছু ভালো বই, কিছু ভালো জ্ঞান অবশ্যই তৈরি হয়েছে। কিন্তু তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়নি।

পৃথিবীর কিছু কিছু দেশ আছে, যারা বছরব্যাপী বই নিয়ে মাতামাতি করে, আলোচনা করে, প্রতিযোগিতা করে। ফলে, জ্ঞান অর্জনে মানুষের আগ্রহ বাড়ে, লেখকদের কদর বাড়ে, প্রকাশকদের চাকচিক্য বাড়ে, মোটা দাগে এসব ঘটনা দেশকে খানিকটা এগিয়ে দেয়।

যাহোক, ভারী কথায় না গিয়ে এবার কিছু হালকা কথা বলি। মানুষ কেন পড়ে? সহজ কথায় দুটো কারণ বলতে পারি। এক. বিনোদন, দুই. প্রয়োজন। যদি বিনোদনের প্রশ্নে যাই, তাহলে লেখার প্রতিযোগী ভিডিও এবং অডিও। ভিডিও এবং অডিওর জগৎ অনেক রঙিন, সহজলভ্য এবং আন্তর্জাতিকতায় ভরপুর। তা ইন্দ্রিয়কে আচ্ছন্ন করে রাখে। সেসবকে পাশ কাটিয়ে লেখায় মগ্ন হওয়া সবার জন্য সহজ নয়। আবার অনেকেই আছেন যাদের কাছে লেখার জগৎ বেশ রাঙিন। তারা সবকিছু পাশ কাটিয়ে সাদাকালো লেখায় নিজেকে মগ্ন রাখতে পারেন। কারণ, তাদের কল্পনা করার শক্তি আছে। এই শক্তি লেখাই তাদের মনে তৈরি করে দেয়। একটা উদাহরণ দেই। ঠাকুরমার ঝুলি বইটি  আমি আপনি অনেকেই পড়েছি। তার পাতায় পাতায় যেসব রাক্ষস, খোক্ষস, রাজকুমারী, রাজকুমারের কথা লেখা আছে, তাদের অবয়ব আমরা মাথার ভেতর নিজেরা তৈরি করে নিতাম। এতে আমাদের কল্পনাশক্তি বাড়তো বলে মনে করি। এখন ঠাকুরমার ঝুলি টিভি ইউটিউবে দেখতে পাওয়া যায়, কার্টুন অ্যানিমেশনও সহজলভ্য। সেখানে কোনও একজন মানুষ তার কল্পনার দৈত্য ও রাজকুমার বানিয়ে রেখেছে। কেউ একজন ভয়েস দিয়েছে। শিশুরা মুগ্ধ হয়ে দেখছে। কেউ কেউ অনুকরণ  করছে। মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে আমাদের শৈশব থেকে এখনকার শিশুদের কল্পনা শেখার প্রক্রিয়াও কী আলাদা হয়ে যাচ্ছে ?

প্রযুক্তি অস্বীকার করার পক্ষে আমি নই। তবে তাকে নিজেদের অনুকূলে কাজে লাগানোর পক্ষে আমি। তার প্রস্তুতি কতটা আছে?

যাহোক, কিছু বিষয় লেখকদের অন্যদের চেয়ে আলাদা করে দেয়। লিখতে লিখতে এবং পড়তে পড়তে তারা অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করার চমৎকার একটা স্কিল নিজেদের মাঝে তৈরি করে নেন। ফলে, তারা চারপাশের মানুষদের বেশ খানিকটা বিকশিত করে দেন। এখনকার লেখকদের সঙ্গে এই বিচারে আগের লেখকদের তাই তুলনা করার কিছু নেই। লেখকরা যুগে যুগে মানুষদের চিন্তাকে প্রভাবিত করেছেন, যুগের পরিবর্তন করেছেন। সময় লেখক তৈরি করে, সেই লেখক সময়কে বদলে দেয়। ফলে, আমি মনে করি লেখকদের কদর সামনে আরও বাড়বে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক