ভর্তির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে, প্রসূন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির ব্যাপারে আমার চেয়ে বেশি খোঁজ-খবর রাখে মনে হচ্ছে। একদিন ফোন করে বললো, বাবা, এবার নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আমি জানতাম না, একটু অবাক হয়ে বললাম, তাই নাকি। খোঁজ নিয়ে জানলাম, কথা সত্যি। শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের আবাসন এবং ল্যাব সুবিধা বাড়াতে এবার এক হাজারের বেশি আসন কমানো হচ্ছে। প্রতিযোগিতা বেড়ে যাবে ভেবে, প্রসূনের একটু মন খারাপ মনে হলো। আমি পাত্তা দিলাম না, আসন সংখ্যা কমলে তোর সমস্যা কী? তুই এমনভাবে প্রস্তুতি নে, যাতে আসন সংখ্যা নিয়ে তোকে ভাবতে না হয়।
দু’তিন দিন আগে আবার ফোন, বাবা এবার নাকি ‘ঘ’ ইউনিট থাকছে না। আমি আবারও অজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। তবে খোঁজ নিয়ে জানলাম, এটাও সত্যি। এবারও তার একটু মন খারাপ মনে হলো। কারণ, আইবিএ এবং ‘ঘ’ ইউনিটের জন্যই সে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ‘ঘ’ ইউনিট মূলত বিভাগ পরিবর্তনের ইউনিট। প্রসূন যেহেতু বিজ্ঞান থেকে বাণিজ্যে যেতে চায়, তাই ‘ঘ’ ইউনিটই তার উপায়।
এতদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচটি ইউনিটের অধীনে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হতো। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘ক’, কলা বিষয়ের জন্য ‘খ’, ব্যবসায় শিক্ষার বিষয়গুলোর জন্য ‘গ’, চারুকলার বিষয়গুলোর জন্য ‘চ’ এবং বিভাগ পরিবর্তনের জন্য ‘ঘ’ ইউনিট।
অন্য ইউনিটগুলোতে উচ্চ মাধ্যমিকের বিষয়ে ভর্তি পরীক্ষা হলেও ‘ঘ’ ইউনিটে সাধারণ জ্ঞান, বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ের ওপর পরীক্ষা হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যুক্তি, শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার বোঝা ও ভোগান্তি কমাতেই ‘ঘ’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করা হচ্ছে। আসন সংখ্যা কমানো এবং ‘ঘ’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যুক্তির সঙ্গে আমি প্রাথমিকভাবে একমত। কোয়ানটিটির চেয়ে কোয়ালিটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমরা গর্ব করি, বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে সেটিকে তলানিতে পড়ে থাকতে দেখলে লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যায়। আমার ছেলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাক আর না পাক, আমি চাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার গুণগত মানে, গবেষণার উৎকর্ষে সারা বিশ্বে আমাদের মাথা উঁচু করুক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আসন সংখ্যা কমালে আর ‘ঘ’ ইউনিট বাতিল করলেই কি গুণগত মান বদলে যাবে। যদি কেউ সে গ্যারান্টি দেন, তবে আমি পুরোপুরি একমত হবো।
‘ঘ’ ইউনিট যে শুধু বিভাগ বদলানোর উপায় তা-ই নয়, শিক্ষার্থীদের অনেকেই নিজ নিজ বিভাগের ইউনিটের পাশাপাশি ‘ঘ’ ইউনিটেও পরীক্ষা দিতো। ফলে আসন অল্প হলেও ‘ঘ’ ইউনিটে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিতো। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাই ‘ঘ’ ইউনিটকে বাড়তি চাপ বোঝা ও চাপ হিসেবে বিবেচনা করছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেটাকে চাপ হিসেবে বিবেচনা করছে, শিক্ষার্থীরা সেটাকে আরেকটা সুযোগ হিসেবে দেখছে। যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ নেই, তাই ‘ঘ’ ইউনিট ছিল সবার জন্যই সেকেন্ড চান্স। ‘ঘ’ ইউনিট বাতিলের বিরোধিতাকারীদের যুক্তি হলো, এতে বিভাগ পরিবর্তনের সুযোগ থাকছে না। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দাবি, এখনও নীতি ও কৌশল এখনও চূড়ান্ত হয়নি বটে, তবে বিভাগ পরিবর্তনের সুযোগ থাকছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ‘ঘ’ ইউনিট থাকলে ভালো নাকি না থাকলে; এ নিয়ে দেখি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড়। গণমাধ্যমেও পাল্টাপাল্টি লেখালেখি হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও দেখি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যুক্তির লড়াইয়ে নেমেছেন। অনেকেই বলছেন, ‘ঘ’ ইউনিট না থাকলে, শিক্ষার্থীদের বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা আরও সংকুচিত হবে। অনেকে বলছেন, সবার সঙ্গে আলোচনা না করেই সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে। আর ক্যাম্পাসে আগের মতো মুক্ত ছাত্র রাজনীতি নেই বলে জোরালো প্রতিবাদও হচ্ছে না। আর ভর্তি কমিটির আলোচনাকেই সিদ্ধান্ত হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা সারা দেশ ঘুরে ঘুরে ভর্তি পরীক্ষা দেয়, তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাড়তি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা মোটেই বাড়তি চাপ বা বোঝা নয়।
আমি দুই পক্ষের যুক্তিগুলোই অনুরাগ-বিরাগের ঊর্ধ্বে উঠে নির্মোহভাবে বিবেচনা করার চেষ্টা করি। আমার ছেলেও ‘ঘ’ ইউনিটের সম্ভাব্য সুবিধাভোগী, তাই যেন এটি বাতিলের বিরুদ্ধে আমি অবস্থান নিয়ে না নিই, সে ব্যাপারে সচেতন থাকার চেষ্টা করি। প্রসূন যাতে বাড়তি কোনও সুবিধা না পায়, সে জন্য আমি বরং বাতিলের পক্ষের যুক্তিগুলোই বেশি করে বোঝার চেষ্টা করি। যুক্তিগুলো নিয়ে আমি প্রসূনের সঙ্গে কথা বলি, তাকে বোঝাই, মন খারাপ করার কিছু নেই। প্রসূনকে বলি, এসব বিষয়ে সময় নষ্ট না করে, প্রস্তুতিতে আরও মনোযোগী হতে। আমার সব যুক্তির সঙ্গে কিছুটা একমত হয়েও প্রসূন পাল্টা যুক্তি দেয়, বিজ্ঞান পড়তে ভালো লাগে না বলেই তো আমি ‘ঘ’ ইউনিটে পরীক্ষা দিতে চাই। কিন্তু ‘ঘ’ ইউনিট না থাকলে আমাকে ভর্তি পরীক্ষায় ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হবে। যে বিষয়গুলো আমি পড়তে চাই না, সেগুলো আমাকে জোর করে পড়তে হবে। আর ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে আমাকে অর্থনীতি বা মার্কেটিং পড়তে হবে। এটা কেমন কথা। তাহলে আর আমার বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা থাকলো কোথায়?
তার পাল্টা যুক্তিতে কিছুটা হতোদ্যম হলেও আমি বলি, সিস্টেমগুলো তো আর তোমার একার জন্য করেনি, সবার জন্য করেছে। আর সবার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই তোমাকে টিকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঘা বাঘা শিক্ষকরা নিশ্চয়ই তোমার-আমার চেয়ে ভালো বোঝে। তারা নিশ্চয়ই বৃহত্তর স্বার্থেই ‘ঘ’ ইউনিট বাতিল করতে যাচ্ছেন। আমি আরও বলি ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি তো ক’দিন আগেই এইচএসসি পরীক্ষার জন্য পড়েছো; এত তাড়াতাড়ি তো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। তাছাড়া ভর্তি পরীক্ষা তো আর এইচএসসি পরীক্ষা নয়। এটা যাচাইয়ের একটা পন্থা মাত্র। তোমার কাজ হলো নিজেকে আরও যোগ্য করে গড়ে তোলা। যাতে কোনও কায়দা করেই বিশ্ববিদ্যালয় তোমাকে আটকাতে না পারে। তবে প্রসূনের শেষ যুক্তিতে আমি সত্যিই কাবু হয়ে যাই। সে বললো, তোমার সব যুক্তি আমি মানলাম। কিন্তু ভর্তির জন্য আমাদের প্রস্তুতি দুই মাস পেরিয়ে গেছে। এতদিন আমরা ‘ঘ’ ইউনিটের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি; ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি খুলেও দেখিনি। এখন আমাকে অর্থনীতি পড়ার জন্য আবার ফিজিক্স পড়তে হবে। এই সিদ্ধান্তটা আরও দুই মাস আগে নিলে আমাদের প্রস্তুতিতে এত টালমাটাল লাগতো না। যুক্তিতে হেরে গিয়ে আমি ধমক দিলাম, যাও পড়তে বসো। তবে মনে মনে ভাবলাম, সময়ের কাজ সময়ে করতে না পারার সমস্যাটা আমাদের পুরানো। তাতে ভালো সিদ্ধান্তও অনেক সময় বিতর্ক তৈরি করে। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিতো, এবার আসন সংখ্যা কমবে এবং ‘ঘ’ ইউনিট থাকবে না; তাহলে সবাই সেভাবে প্রস্তুতি নিতে পারতো। আমাদের বড়দের ছোট ছোট সিদ্ধান্ত যে ছোটদের মনোজগতে কত বড় বড় প্রভাব ফেলে; তা আমরা কখনও ভেবেই দেখি না। শিক্ষকরাই যেন এখানে ছেলেমানুষ। তারা খেলার ছলে সিদ্ধান্ত ওলটপালট করেন। আর শিক্ষার্থীরা যেন এখানে ব্যাঙ। শিক্ষকদের এই খেলা খেলা, তাদের কাছে জীবন-মরণ সমস্যা।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ