সমাজ রক্ষণশীলতার কপাট খুলতে পারেনি

তুষার আবদুল্লাহতখন ক্লাস ফাইভে । আমরা ক্লাস করি স্কুলের পূর্বদিকের দোতালায়। সেখান থেকে  চোখ যায় পশ্চিমে স্কুলের শহীদ মিনারে। ওখানে অভিভাবকরা বসে থাকতেন। বিশেষ করে আমাদের মায়েরা। আমাদের সমাজ ক্লাস নিতেন একজন শিক্ষক, এখানে তার নাম বলছি না । তিনি শহীদ মিনারের দিকে ইশারা করে একদিন বললেন তোদের মায়েরা তো দোজখে যাবে। দোজখের আগুনে পুড়বে। আমরা স্যারের মুখ থেকে এমন কথা শুনে প্রথমত ভয় পেয়ে গেলাম ।

বলে কী স্যার! আমাদের মায়েরা কেন দোজখে যাবেন, দোজখের আগুনে পুড়বেন? স্যার বললেন- তোদের মায়েরা কপালে টিপ পরে। টিপ নষ্ট মেয়ে মানুষরা পরে। ওই ক্লাসে কোনও প্রতিবাদ হলো না । আমরা চুপ করে থাকলাম । সহপাঠীদের কেউ কেউ স্কুল থেকে ফেরার সময়েই মায়ের কপালের টিপ মুছে দিয়েছিল বা তুলে নিয়েছিল। তখন লিপস্টিক দিয়েও টিপ আঁকতেন মা- বোনেরা। আমি আমার মাকে কিছু বলিনি। পরদিন ওই স্যারের ক্লাসে এসে হাজির বন্ধু আজাদের মা। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে আজাদের মা শুধু বোরকা পরতেন। আশ্চর্য বিষয় হলো উনাকেই একমাত্র দেখেছি বোরকার সঙ্গে টিপ পরতে। তিনি এসে স্যারের কাছে জানতে চাইলেন, তিনি কেন ছাত্রদের কাছে মায়েদের বিষয়ে এমন কথা বললেন। স্যার  ভাবেননি তিনি এমন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন। তাও আবার একজন বোরকা পরা অভিভাবকের কাছ থেকে। স্যার ধর্মের নানা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু আজাদের মায়ের কাছেও ধর্মের নামা ব্যাখ্যা ছিল। বিশেষ করে তিনি স্যারকে বললেন, ধর্ম যেমন তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তেমনই বাঙালি সংস্কৃতির আচারকেও নিজের মনে করেন। দুইকে মুখোমুখি দাঁড় করাতে রাজি নন তিনি। বিষয়টি প্রধান শিক্ষকের কাছে পৌঁছে। শিক্ষককে বাধ্য করা হয় অভিভাবকদের কাছে ক্ষমা চাইতে। প্রায় তিন দশক পেরিয়ে এসেও সমাজে যে শুভ বুদ্ধি বা মুক্ত বুদ্ধির জলবায়ু তৈরি করা যায়নি, তার প্রমাণ টিপ নিয়ে সাম্প্রতিক ঘটনা। অনেকে এনিয়ে ঘটনার পেছনে ঘটনা এবং রাজনীতির নানা পূর্বাভাস দিচ্ছেন। কিন্তু মূল কথা হলো আমরা উড়ালপুল কিংবা মেট্রোরেলের সওয়ার হলেও পরিবার, সমাজ এখনও রক্ষণশীলতার কপাট খুলতে পারেনি। বরং কোনও কোনও কপাটে নতুন করে খিল দেওয়া হচ্ছে।

স্কুলে আমাদের একজন আরবি শিক্ষক ছিলেন। তিনি আরবিতে ছড়া, গল্প লিখতে শিখিয়েছিলেন আমাদের কয়েকজনকে। আরবি স্যার মোহামেডান, আবাহনীর খেলার দিন স্কুল ছুটির জন্য প্রধান শিক্ষকের কাছে আমাদের হয়ে তদবির করতেন। কখনও কখনও  ঘণ্টা বাজিয়ে দিতেন নিজেই। সেই আরবি শিক্ষকের কাছে যেমন জেনেছিলাম ইসলামি মনীষী, বিজ্ঞানীদের জ্ঞানের কথা, তেমনি গ্রিক চিন্তাবীদদের সঙ্গেও তিনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। পৃথিবী কী?পৃথিবীর ধর্মগুলোর আন্তসম্পর্ক। বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক নিয়ে স্যার আমাদের সঙ্গে বিস্তর আলোচেনা করতেন। এতে আমাদের যে উপকার হয়েছে, সেটি হলো- সকল ধর্ম সম্পর্কে জানার আগ্রহ বেড়েছে। বিজ্ঞান, বিশেষ করে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড নিয়ে আমাদের কৌতূহল আজও অক্ষুন্ন আছে। এবং সেই স্কুল সময়েই জেনে গেছি, শিক্ষকের প্রথম কাজ হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ‘প্রশ্ন’ করার তাড়না জাগিয়ে তোলা। শিক্ষার্থী যুক্তি ও জ্ঞান দিয়ে সমাধান বা উত্তর খুঁজে নেবে। একে কোনও রক্ষণশীল চিন্তার বাঁধ দিয়ে আটকে রাখা যাবে না।

ধর্মীয় উপাসনালয়ে  হামলা, আগুন, ভাঙচুর। কিংবা বিভিন্ন ইস্যুতে কোনও এলাকা বা দেশে সাম্প্রদায়িক আস্ফালন দেখা গেলে, বরাবরই আমি বলেছি-বাংলাদেশের মানুষ অসাম্প্রদায়িক। তাদের যাপনে সাম্প্রদায়িকতা নেই। তারা এখনও একই বাঙালি আচার যাপন করতে ভালোবাসে। একে অপরের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। শুক্রবার নববর্ষের মঙ্গল শোভযাত্রার প্রস্তুতি দেখতে গিয়েছিলাম চারুকলায়। সেখানে কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে দেখা। পাবলিক, প্রাইভেট, মাদ্রাসা উভয় বিদ্যায়তনের শিক্ষার্থী ছিল। উৎসবের প্রস্তুতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া এবং উপভোগে কারও মধ্যে কমতি দেখলাম না। সকলের  একই কথা- বাঙালির সকল উৎসব, সকল ধর্মের। কারণ এই ভূমিপুত্র-কন্যাদের আচার অনুষ্ঠানের প্রভাব ধর্মও গ্রহণ করেছে অনেকটাই। একারণেই এই জনগোষ্ঠীর মানুষের সাম্প্রদায়িক হওয়ার সুযোগ নেই।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী