নড়াইলের তিনশ অপরাজিতা

তুষার আবদুল্লাহজিতে যাওয়ার আনন্দে কাটলো শুক্রবার সারাদিন। আনন্দের সেই রেশ এখনও কাটেনি। টুকটাক খারাপ খবর আসছে। কিন্তু মনে বিষাদ, বিষন্নতার মেঘ এসে বসতে পারছে না। জিতে যাওয়ার আনন্দ খবরটি এসেছে  বাংলাদেশের নিভৃত গ্রাম থেকে। গ্রামের নামটি জেলা শহরের অনেকেরই জানা নেই। গ্রামের নামটি বেশিরভাগই ১৪ এপ্রিল প্রথম শুনেছেন। খবরটির বিস্তারিত জানতে জেলা শহরের গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের কাছে যখন ফোন দেই, তারা তাৎক্ষণিকভাবে আমাকে কিছু জানাতে পারেননি। কারণ জেলা শহরে খবরটি এসে পৌঁছাতেও সময় লেগেছে। এখন সেই গ্রামের নাম সবার জানা। গ্রামের নামটি শেখ হাটি। এই গ্রামকে, না শুধু এই গ্রামকে নয়, বাঙালি ও বাংলাদেশকে যারা বিজয়ী করেছে, তারা ওই গ্রামের গুয়াখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

এবারের বর্ষবরণ বা পহেলা বৈশাখ দিনকে পঞ্জিকার পাতা উল্টিয়ে স্বাভাবিকভাবে ফেলে আসা যাবে না। ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনায় এটি ২০০১ সালের বর্ষবরণ উৎসবে বোমা হামলার ঘটনার চেয়েও সূদুর প্রভাব ফেলবে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে কালো দাগটি দীর্ঘদিন বিরাজ করবে। আমরা শুধু মঙ্গল শোভাযাত্রার সামনে নিরাপত্তারক্ষীদের সাঁজোয়া অবস্থানটি দেখেছি। আলোচনা-সমালোচনা করেছি উদযাপনের সময় কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি নিয়ে। অস্বস্তি প্রকাশ করেছি উৎসব এলাকায় মাইকিং। যেখান থেকে উৎসবে অংশ নিতে আসা মানুষদের সতর্ক করা হচ্ছিল জড়ো না হতে বা দ্রুত উৎসব এলাকা থেকে সরে যেতে। এই বিষয়গুলো অস্বস্তিকর হলেও, ২০০১ এবং তার পরবর্তী ঘটনাবলীর কারণে মেনে না নিয়েও উপায় নেই।  নিরাপত্তার ব্যবস্থা না নিলে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবহেলার  অভিযোগ তোলা হতো। তবে আলোচনা হতে পারে বিভিন্ন হুমকি মোকাবিলায় কীভাবে উৎসবের সৌন্দর্য রক্ষা করে নিরাপত্তা  নিশ্চিত করা যায়।

আমাদের এবারের চরম পরাজয়ের বিষয়টি ছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা ও পহেলা বৈশাখ নিয়ে বিতর্ক। ‘ধর্ম’কে ব্যবহার করে আলেম, ওলামা পরিচয়ে অনেকেই এনিয়ে নানা সময়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। দিয়ে যাচ্ছেন। এটি তাদের ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত দৃষ্টিভঙ্গী। এনিয়ে তর্ক-বিতর্কে জড়ানোর কিছু নেই। বাঙালি নিজের মতো করে উৎসব পালন করে আসছে। কিন্তু এবার ভিন্ন রূপ দেখা গেলো বিতর্কের।  পুরনো সেই তর্ক-বিতর্কের সঙ্গে এবার একেবারে আমার, আপনার পাশের মানুষেরা যোগ দিয়েছেন। তাদের কেউ প্রবীন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদানের প্রতি জনগণ রাষ্ট্র শ্রদ্ধাশীল। কেউ কেউ সাংস্কৃতিকভাবেও অগ্রসর মানুষ বলে পরিচিত ছিলেন। সেই মানুষেরাই রাজনৈতিক কারণে ‘মঙ্গল’ ও প্রকৃতির বিভিন্ন অনুসঙ্গ নিয়ে বিতর্কে  নিজেদের নাম লিখিয়েছেন। বিভিন্ন পেশাজীবী, যাদের উদার ও সংস্কৃতিমনা ভাবতেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘টেপা পুতুল’, পেঁচা’ এবং মঙ্গল নিয়ে তাদের আপত্তি এবং ব্যাখ্যা দেখে নিশ্চয়ই বিস্মিত হয়েছেন আপনি? আপনি, আমি হয়তো আমাদের আশাপাশের মানুষগুলোর বদলে যাওয়া ঠাওর করতে পারিনি। পরিবারের নতুন সদস্যের নাম রাখা। বাড়ির আসবাব এবং অন্যান্য অনুসঙ্গ থেকে বাঙালিয়ানা বা বাংলাদেশ হারিয়ে যাওয়া। বদলে যাওয়া সম্বোধন। পাল্টে যাওয়া পোশাক এবং জীবনের অন্যান্য আচরণে চেনা সংস্কৃতি কবে উধাও হয়ে গেলো আমরা বুঝতে পারিনি।

এবার কোভিডের মুখোশ খুলে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে পরিচিতজনদের সেই মুখোশটিও আমাদের সামনে খসে পড়লো। এখানে স্মরণে রাখা ভালো, বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে কোনও ধর্মকেই কখনও মুখোমুখি অবস্থানে ফেলা হয়নি। বরং উৎসবগুলো গ্রামে সার্বজনীন ভাবে উদযাপিত হতো। বিতর্কের সূত্রধর শহর। সেটি গ্রামে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও পালন করেছে নগরায়ন। এবারের পহেলা বৈশাখে যখন ভাবতে বসেছিলাম। হেরে গেছি। আমাদের পরাজয় ঘটেছে সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে। তখনই নড়াইল থেকে খবর এলো- জেলা সদরের শেখাহাটি গ্রামের গুয়াখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৩০০ মেয়ে শিক্ষার্থী সাত দিনের প্রস্তুতি নিয়েছিল বর্ষবরণ আয়োজনের। ওরা পেঁচা, পাখি, ঘুড়িসহ নানা উপকরণ বানিয়ে সাইকেল র‌্যালির মাধ্যমে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে। ওরা সাইকেলে ১১টি গ্রাম ঘুরে, ওই গ্রামগুলোর মানুষদেরও পহেলা বৈশাখের উৎসবের সঙ্গে যুক্ত করেছে। ওদের র‌্যালির ভিডিও চিত্রতে বিদ্যালয় ও গ্রামে ছেলে শিক্ষার্থীরাও অংশ নিয়েছে। ওই তিনশ কন্যা আমাদের দেখিয়ে দিলো, আমরা হেরে যাইনি। বাঙালির ইতিহাস হেরে যাওয়ার নয়। লড়াইয়ের। এবং যে সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের কথা বলে আসছি নিরন্তর, আমার তিনশ কন্যা সেই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে পথে নেমেছে। অভিবাদন সেই বীরকন্যাদের। ওদের বিজয়ে আনন্দ জলের ঢেউ নেমেছে চোখে। আপনিও যখন সেই আনন্দ জলে ভাসছেন?

আপনিও নিশ্চয়ই সেই আনন্দ জলে ভাসছেন।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী