যৌতুক সমাজ ও অর্থনৈতিক কৌতুক

ক’দিন বাদে আসিয়ার বিয়ে। কিন্তু বিয়ে নিয়ে আনন্দের চেয়ে আসিয়া অনেক বেশি বিষণ্ন, তার বাবার কথা চিন্তা করে। তাদের মধ্যবিত্ত জীবনে বর আকবর পরিবারের যৌতুক চাহিদা অনেক। আলাপের ছলে আকবরের মামা বলছে,  ‘যৌতুক চাওয়া অন্যায় কিন্তু আপনার মেয়েকে গিফট দিয়ে ঘর সাজিয়ে দিলে সেটা কি আমরা মানা করতে পারি? আর আকবরের পরিবারে প্রথম বিয়ে এটা। তাই বিয়ের আয়োজনটা জমকালো হবে, এই আমাদের চাওয়া।’

কুমিল্লার তেলিকোনার মেয়ে আসিয়ার গল্পটা এখন এ সমাজের নিত্যদিনের ঘটনা। যৌতুকের ভিন্ন নাম– ‘গিফট’। আমাদের সামাজিক জীবনে দায়গ্রস্ত বিবাহযোগ্য কন্যার মা বাবার আয় থাক বা না থাক, গিফট নামক লেনদেন আছেই! অনুষ্ঠানের আতিথেয়তার লাখ লাখ টাকা খরচের কথা আলাদা! যৌতুক প্রথার শুধু নামই বদল হয়েছে। পিতামাতা ও অভিভাবক বিয়ের সময় গিফট দিয়ে মেয়েকে পাঠায় শ্বশুরবাড়ি। আর নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা সে গিফট দেওয়ার উছিলায় যৌতুক নেয়। যৌতুক দেওয়া-নেওয়ার ধরনটা শুধু বদলেছে। যৌতুক ছাড়া বিয়ে হয় না, এখনও সমাজে এটাই সত্যি। তাই ধনীদের কাছে যা উপহার, গরিব কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার কাছে সেটা বোঝা।

বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় যৌতুক এখন একটা ব্যাধি। কঠোর আইনকে উপেক্ষা করে এখনও সমাজে গিফটের নামে যৌতুকের বলি হচ্ছে মেয়েরা।
দেশের বর্তমান যৌতুক নিরোধ আইনে বলা হয়েছে ‘কোনও নারীর স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি, অভিভাবক, আত্মীয় বা স্বামীর পক্ষের অন্য যেকোনও ব্যক্তি যৌতুকের জন্য কোনও নারীকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। যৌতুকের জন্য মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা (প্ররোচিত করে) করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, মারাত্মক জখমের জন্য যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড বা ন্যূনতম ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।’

কিন্তু কঠোর এ আইনকে উপেক্ষা করে সমাজে যৌতুকের বলি হচ্ছে নারীরা প্রতিনিয়ত। ইউএনডিপি পরিচালিত ‘সিস্টেম অফ ডাওরি ইন বাংলাদেশ’ নামের ১০ বছরের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ‘বাংলাদেশে শতকরা ৬০ শতাংশ বিবাহিত নারী যৌতুকের কারণে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়।’

সমাজ থেকে যৌতুক প্রথাকে নির্মূল করতে হলে আইনের পাশাপাশি মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। স্বামীর ঘরে মেয়ের সুখের আশায় গিফট দেওয়ার রেওয়াজ করে যারা যৌতুক প্রথাকে জিইয়ে রেখেছে, তাদের ভাবা উচিত অন্য ঘরের মেয়েদের কথা। বর্তমান সময়ে ছেলে সন্তানের মতোই একজন মেয়েকে মানুষ করা হয়। সুতরাং মেয়েকে বিয়ের সময় উপহার দিয়ে স্বামীর ঘরে না পাঠালে মাথা হেঁট হবে এমনটা ভাবা অর্বাচীন। যৌতুকের নামে গিফট নেওয়া নোংরা মানসিকতা।
সারা দেশে যৌতুক নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে মা-বাবা মেয়ে বিবাহযোগ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। আসিয়ার বাবার মতো কুমিল্লার দরিদ্র বাবা মায়ের কাছে মেয়ের বিয়ে পাহাড়সম বোঝা হয় যৌতুকসহ নানা আচার অনুষ্ঠান পালন করতে গিয়ে।  নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কৈয়ের তেলে কৈ ভাজার মতো পাত্রপক্ষ মেয়ের টাকাতে বিয়ে করে।

সরাসরি যৌতুক হিসাবে নগদ বা অন্য দাবি দাওয়া সবার বেলাতে না থাকলে মেয়েকে ঘরের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে থালা-বাসন সবই দিতে হয় বাবার বাড়ি থেকে। তার সঙ্গে পাত্রের বোনজামাইদের দিতে হয় সোনার আংটি মেয়ে পক্ষ থেকে। সে ক্ষেত্রে বোনজামাই যে ক’জন থাকবে তাদের সবাইকে দিতে হবে আংটি।
বিয়েতে বর পক্ষকে আপ্যায়নেও একটা অদ্ভুত বিষয় দেখা যায়। যেমন, মেয়ে পক্ষকে বলা হলো বরপক্ষের ৩০০ জনের জায়গাতে ১৫০ আসবে। বাকিরা না এলেও তাদের আপ্যায়ন করবে ছেলে পক্ষ নিজেদের বাড়িতে। আর এ আপ্যায়নের খরচ হিসাব করে মেয়ের বাবা টাকাটা ছেলের পক্ষকে দিতে হবে। তার মানে মেয়ের বাবার পরিত্রাণ পাবার কোনও পথ নেই। এসব নিয়ে কন্যাদায়গ্রস্ত পরিবার আরও হিমশিম খায় যদি সরাসরি যৌতুকের দাবি দাওয়া থাকে। উপায়ান্তে আত্মীয় স্বজনের সাহায্য বা ঋণ ছাড়া গত্যন্তর থাকে না বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে।

নানাভাবে যৌতুকের বিরুদ্ধে আন্দোলন, আইন হলেও কিছুই পরিবর্তন হয়নি। বরং আইনি জটিলতা এড়াতে যৌতুকের লেনদেন সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আজকাল আর সাক্ষী থাকে না। এমনকি বিয়ের কোনও কাগজপত্রে যৌতুকের বিষয় উল্লেখ করা হয় না।

গিফট দেওয়ার নামে আসিয়ার মতো মেয়েরা যখন বাবার অসহায়ত্বের অশ্রু নিয়ে সংসার শুরু করে তখন তার কাছে বিয়েটা আনন্দের হয় না। আবার নানা যুক্তি বাহানা দিয়ে মেয়ের বাবার টাকাতে ছেলে বিয়ে করছে এ সত্যটা স্বীকার করতে আকবরের মতো ছেলেদের আত্মসম্মানে বাধে।

এ অবস্থায় সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির গিফটের বিলাসিতা মধ্য নিম্নবিত্ত শ্রেণিকে প্রভাবিত করছে। কিন্তু যৌতুকের অলিখিত এ নিয়মের কাছে পরাস্ত কন্যা দায়গ্রস্ত পিতা। আর তাই গিফটকে যৌতুক জেনেও একজন পিতা বা মা বলতে পারে না, ‘যৌতুক দিয়ে কন্যাকে বিয়ে দেবো না।’

নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা রোধে কঠোরতম শাস্তির বিধান রেখে ২০০০ সালে প্রণয়ন করা হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন। এ আইনে দ্রুত সুবিচারের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু গত ২১ বছরে নারীর প্রতি সহিংসতা তো কমেইনি, বরং বিভিন্ন গবেষণা ও প্রতিবেদন বলছে, নানারকম নির্যাতনের ভয়াবহতা দিন দিন প্রকটতর হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই আইনটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে নানা পদ্ধতিগত জটিলতা রয়েছে। আছে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও মামলার দীর্ঘসূত্রতা। তাছাড়া মূল আইনটিতেই রয়েছে বেশ কিছু অস্পষ্টতা। আইনটির একটি বড় দুর্বলতা হচ্ছে, শুধু যৌতুকের জন্য ঘটানো সহিংসতা ছাড়া আইনটিতে পারিবারিক সহিংসতা অন্তর্ভুক্ত নয়। ফলে একজন নারী যদি সাধারণভাবে পরিবারের সদস্যদের নির্যাতনে জখম হন, এমনকি মারাও যান, তিনি কিন্তু এই আইনের সুবিধা পাবেন না। অথচ বিভিন্ন জরিপ বলছে, দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার একটি বড় অংশই ঘটান পরিবারের সদস্যরা। এ কারণে নারীনেত্রী ও মানবাধিকার কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরেই আইনটির কয়েকটি ধারা সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছেন।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) এর ১১(গ) ধারায় যৌতুকের জন্য সাধারণ বা মারাত্মক জখম এবং মৃত্যু ঘটানো বা ঘটানোর চেষ্টার শাস্তি বিধান করেছে। ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা বলছেন, দ্রুত ও কার্যকর প্রতিকারের আশায় পারিবারিক সহিংসতার শিকার অধিকাংশ নারী এই ধারায় মামলা করেন।

স্বামী-স্ত্রীর মতের অমিল, পারিবারিক অশান্তি ও পরকীয়াসহ নানা কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হওয়া বা বিবাহ বিচ্ছেদ সমাজে একটি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনাও অহরহ ঘটতে থাকায় এ ধারায় মামলার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

মা-বাবা আদর করে মেয়ের নাম রেখেছিলেন সুখী (২৪)। কিন্তু সুখীর কপালে সুখ তো জোটেইনি, বরং শ্বশুরবাড়িতে বর্বর নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। বিয়ের ১২ বছরের মাথায় যৌতুক না পেয়ে স্বামী ও তাঁর স্বজনেরা মিলে টেস্টার দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সুখীর ডান চোখটি একেবারে উপড়ে ফেলেন। বাঁ চোখেও ছিল মারাত্মক আঘাত। ঘটনাটি ২০১৫ সালে সাভারের জিঞ্জিরার।

যৌতুকের কারণে অনেক নারীকেই হত্যার শিকার হতে হচ্ছে। মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচলেও অনেকে বেছে নেন আত্মহত্যার পথ। ২০১৬ সালে যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার ৯ জন নারী আত্মহত্যা করেন। ২০১৫ সালে আত্মহত্যাকারী নারীর সংখ্যা ছিল ১৮। হিসাবটি বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, যৌতুককে কেন্দ্র করে ২০১৬ সালে ১৭৩ জন নারী খুন হয়েছেন। নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৩৬২টি। আর গত ৫ বছরে এ সংখ্যা ২ হাজারের বেশি। হত্যার শিকার হয়েছেন ১ হাজার ১৫১ জন নারী।

দেখা যাচ্ছে, পারিবারিক সহিংসতার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার যৌতুক। প্রতিরোধে প্রয়োজন আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ ও সামাজিক আন্দোলন।

লেখক:  সাহিত্যিক ও অর্থকাগজ সম্পাদক
reporterpranab@gmail.com