‘ভিউ ব্যবসা’র ভবিষ্যৎ পরিণতি কী?

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ‘জীবিত ও মৃত’ ছোট গল্পের বিখ্যাত চরিত্র ছিল কাদম্বিনী, সেই গল্পের বিখ্যাত ও সুপরিচিত লাইনটি ছিল, ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিলো সে মরে নাই।’

সম্প্রতি বাংলাদেশের জনপ্রিয় টিভি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র উপস্থাপক ও নাট্যনির্মাতা হানিফ সংকেতের মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। এই গুজব ঘটনায় হতবিহ্বল সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষটি প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরে নিজেই দুঃখ করে ফেসবুকে জানান, তিনি যে বেঁচে আছেন এটাও তাকে ফেসবুকে পোস্ট করে জানাতে হলো। তিনি ও তার পরিবার যে এই ঘটনায় নানাভাবে বিব্রত ও হয়রানির শিকার, সেটাও তিনি উল্লেখ করেন।

শুধু হানিফ সংকেতের ঘটনাই নয়, সম্প্রতি চিত্রনায়ক ফারুক, আলমগীরকে নিয়েও এ ধরনের মিথ্যা ও হীন সংবাদ প্রচার করা হয়েছে ফেসবুক ও ইউটিউবের বিভিন্ন চ্যানেলে। প্রয়াত বরেণ্য চলচ্চিত্র খল অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামানকেও এরকম কয়েকবার ‘মেরে ফেলা হয়েছিল’ পরবর্তী সময়ে তাকে টিভি ক্যামেরার সামনে এসে প্রমাণ করতে হয়েছে যে তিনি বেঁচে আছেন। প্রায়ই আমরা এরকম ভিত্তিহীন সংবাদ লক্ষ করি। ভিত্তিহীন সংবাদ অনেক হচ্ছে বা হবে তাতে আমাদের খুব বেশি আপত্তি নেই, কিন্তু সংবাদটি যখন জীবন-মরণের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত তখন এগুলো নিয়ে আমাদের আপত্তি থাকাটা কি স্বাভাবিক নয়?

বর্তমান বিশ্ব তথ্যপ্রযুক্তির। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়ন এবং তার উপকারিতা অনস্বীকার্য। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে যেমন প্রত্যেকটা দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, একই সঙ্গে আমাদের দেশেও সেই উন্নয়ন ধারা অব্যাহত। ডিজিটাল বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের বড় একটা অংশই নিজ উদ্যোগে তাদের বেকারত্ব ঘুচিয়ে আয়ের রাস্তা তৈরি করছেন এই তথ্য প্রযুক্তির সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে, যাদের অধিকাংশই স্বল্প শিক্ষিত ও বয়সে তরুণ। আর তাদের এই আয়ের রাস্তার একটি বড় খাতই হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নির্ভর বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ, পেজ বা ইউটিউব চ্যানেল অথবা নামসর্বস্ব অনলাইন নিউজ পোর্টাল। এসব চ্যানেল, নিউজ পোর্টাল বা পেজে বিভিন্ন ধরনের কন্টেন্ট ভিডিও আপলোড করে কেউ কেউ রাতারাতি ভাইরাল হয়ে তারকা বনে যাচ্ছেন এবং তাদের আপলোডকৃত ভিডিও অধিক ভিউয়ার আকৃষ্ট করে বড় অঙ্কের টাকাও আয় করছেন। এটা অবশ্যই আনন্দের বিষয় যে শুধু সরকারি চাকরি নির্ভর না হয়ে অল্প বয়সী তরুণ বা যুবকরা স্বনির্ভর হয়ে উঠছেন নিজ মেধা আর উদ্যোগে। কিন্তু তাদের এই তারকা-খ্যাতি আর আয়ের নেশা হয়ে উঠতে যাচ্ছে ভয়ানক সামাজিক অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু। অর্থ ও অধিক ভিউয়ার লাভের কৌশল হিসেবে অনেকেই বেছে নিচ্ছেন অবৈধ ও অনৈতিক পন্থা। কোনও কোনও চ্যানেল যেমন নারীদের ব্যবহার করে অশ্লীল ভিডিও আপলোড করে যৌন সুড়সুড়ি দিয়ে চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার ও ভিউয়ার বাড়ানোর পথ বেছে নেন, আবার কেউ নেন বিতর্কিত কথা, বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিদের নিয়ে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন সংবাদ ছড়িয়ে। কোনও কোনও নিউজ পোর্টাল সংবাদের ভুয়া, বিতর্কিত  বা ভিত্তিহীন শিরোনাম করেও এই পন্থা বেছে নেন। এসব কিন্তু সচেতনভাবেই  তারা করেন। কারণ, তারা ভালো করেই জানেন মিথ্যা বা বিতর্কিত অথবা অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ সংবাদ বা কন্টেন্ট করলে কমেন্ট বক্সে সবাই তাদের গালাগালি করবেন আর এটা হলেই তারা সার্থক। কারণ, যত বেশি কমেন্ট পড়বে তত বেশি অনলাইনে এটি প্রদর্শিত হবে এবং অধিক নেটিজেনের নজরে আসবে। এই যে হীন কৌশলগত বিষয় এটিই এখন অধিকাংশ অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ইউটিউব চ্যানেল বা ফেসবুক পেজ ব্যবসায়ীরা গ্রহণ করেছেন, যার ক্ষতিকর ও আশঙ্কাজনক প্রভাব পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর। অনেক প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্রের অনলাইন সংস্করণেও আজকাল এ ধরনের প্রবণতা লক্ষণীয়। সবাই যেন অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। এই প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে কেউ কেউ জীবিত মানুষকে মৃত বলে সংবাদ পরিবেশন করছেন, আবার ইউটিউব চ্যানেলগুলো শিরোনাম কন্টেন্টে যে নাটক বা সিনেমার নাম দিয়ে থাম্বল দিচ্ছেন, ভেতরে সেই নাটক সিনেমার অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। একইভাবে নিউজ পোর্টালে যে শিরোনাম করা হচ্ছে প্রকৃত খবর তার ধারে-কাছেও নেই। এই যে মানুষকে ঠকানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে সেটা দিন দিন বেড়েই চলছে, যার বলির শিকার হচ্ছেন হানিফ সংকেতদের মতো তারকা খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিরা। তার হঠাৎ মৃত্যুর সংবাদ শুনে কোনও স্বজন বা শুভাকাঙ্ক্ষী যদি হার্ট অ্যাটাকে মারাও যান বা দুর্ঘটনার শিকারও হন তার দায় কে নেবে।

একইভাবে মানহীন কুরুচিপূর্ণ নাটক বা শর্টফিল্ম নির্মাণ করেও মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ দিয়ে অর্থ উপার্জন করায় মত্ত হয়েছেন নামসর্বস্ব মিডিয়াগুলো ইউটিউব চ্যানেলকে পুঁজি করে, এই অর্থ আয়ের মানদণ্ড হলো কতটা ভিউ হয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে। এতে কথিত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে পেশাদার মিডিয়া কর্মী ও প্রতিভাবান নির্মাতারাও। এর ফলে এ ধরনের শিল্প কন্টেন্টের মান এখন ভিউ প্রতিযোগিতার কাঠগড়ায়। তাই এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ভিউ ব্যবসায়ীদের হাতে শিল্প বিনোদনের ভবিষ্যৎ কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। ইতোমধ্যে ডিজিটাল আইন, তথ্যপ্রযুক্তি নিয়েও নানা আইন রয়েছে অথচ এগুলো ঘটছেই প্রতিনিয়ত, যার প্রভাবে ঝুঁকিপূর্ণ সমাজের সব শ্রেণির মানুষ। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরও সচেতন হওয়ার পাশাপাশি এসব ভুয়া অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ফেসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলের ওপর নজরদারিও বাড়ানো প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে নৈতিক অবস্থান থেকেই। একইসঙ্গে নেটিজেনদেরও আরও সচেতন হওয়া জরুরি, যাচাই-বাছাই ছাড়াই কোনও সংবাদ, ভিডিও কন্টেন্ট ছড়িয়ে দেওয়াটা শুধু দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়ই নয়, একইসঙ্গে এটি একটি অপরাধেরও অংশ।

আইনের প্রয়োগ ও আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধি পেলেই ভিউ ব্যবসায়ীদের প্রতিহত করা সম্ভব হবে। আর এটা হলেই মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ ফিরে আসবে যোগ্য ও সৃষ্টিশীল মানুষের হাতে। আমরা পাবো সুশৃঙ্খল শিল্পসমৃদ্ধ বিনোদন।


লেখক: নাট্যকার ও ব্যাংক কর্মকর্তা।