বাহারের কাছে কমিশনের হার!

শুরুটা হয়েছিল টেস্ট মেজাজে, আর শেষটা হলো টি-২০ মেজাজে টানটান উত্তেজনায়। টেস্ট মেজাজ মানে একদম বৃষ্টিবিঘ্নিত টেস্ট ম্যাচ। তারপর ইভিএম’এর ‘বোলিংয়ে’ কুপোকাত ভোটার ব্যাটাররা। রান উঠলো খুবই ধীরগতিতে। আস্তে আস্তে বৃষ্টি থামলো, ইভিএমও চেনা লাগলো। রানের গতি বাড়লো। শেষ বেলায় রানের গতি বাড়লো।

আজ রাতে অ্যান্টিগায় শুরু হচ্ছে বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট ম্যাচ। তবে আমি বলছিলাম কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনি খেলার কথা। যার শুরু টেস্টের মতো হলেও শেষটা হয়েছে টি-২০ মেজাজে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছিল কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশনের জন্য প্রথম পরীক্ষা। ইভিএম-ভীতি বাদ দিয়ে দিনভর ভোটগ্রহণের পরিবেশ বিবেচনায় নিলে কমিশন জিপিএ-৫ পেয়েছে। ভোটগ্রহণের পরিবেশ নিয়ে কোনও প্রার্থীরই কোনও অভিযোগ ছিল না। ইদানীং বাংলাদেশের নির্বাচনের কিছু কমন অভিযোগ আছে– এজেন্ট ঢুকতে না দেওয়া, ভোটারদের আসতে বাধা দেওয়া, ভোটকেন্দ্র দখল করা; এ ধরনের কোনও অভিযোগই ছিল না দিনভর। বরং ইভিএম আর প্রথমবারের মতো কেন্দ্রে কেন্দ্রে সিসিটিভি মিলে প্রায় আদর্শ এক নির্বাচন হয়েছে। ভোটগ্রহণ শেষে শুরু হয় গণনা। যেহেতু ইভিএম, তাই ফলাফল পেতে খুব একটা সময় লাগবে না, এটা অনুমিতই ছিল। ফলাফল ঘোষণার শুরু থেকেই টানটান উত্তেজনা, হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত আর বিএনপির বহিষ্কৃত প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। দুজনের ব্যবধান কখনোই হাজারের অঙ্ক ছাড়ায়নি। কখনও রিফাত এগিয়ে, কখনও সাক্কু। মূল লড়াইয়ে না থাকলেও বিএনপির অপর বহিষ্কৃত প্রার্থী নিজামউদ্দিন কায়সারও দৌড়ে ছিলেন ভালোভাবেই। একপর্যায়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ১০৫ কেন্দ্রের মধ্যে ১০১ কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা করা হয়। তখনও ৬২৯ ভোটে এগিয়ে সাবেক মেয়র সাক্কু। কেন্দ্র বাকি মাত্র ৪টি, ভোটের ব্যবধান ৬২৯; যেন টি-২০ ম্যাচের শেষ ওভারের খেলা। তখনই ফলাফল ঘোষণায় ধীরগতি। খবর পেয়ে কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে ছুটে আসেন মনিরুল হক সাক্কু। খবর পেয়ে যেখানে ফলাফল ঘোষণা হচ্ছিল সেই শিল্পকলা একাডেমিতে ছুটে আসেন রিফাত সমর্থকরাও। একপর্যায়ে দুই পক্ষ মুখোমুখি হলে উত্তেজনা ছড়ায় একাডেমি মিলনায়তনে। সরকারি দলের সমর্থকরা সাক্কুর ওপর চড়াও হলে পুলিশ হল খালি করে দেয়। কিছুক্ষণের জন্য ফলাফল ঘোষণা আনুষ্ঠানিকভাবে স্থগিত রাখেন রিটার্নিং অফিসার। এরপর যখন ফলাফল ঘোষণা করা হলো, দেখা গেলো শেষ দৌড়ে এগিয়ে গেছেন রিফাত। মাত্র ৩৪৩ ভোটে সাবেক দুইবারের মেয়র সাক্কুকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো কুমিল্লার নগরপিতা হয়েছেন আওয়ামী লীগের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা আরফানুল হক রিফাত। শুরু থেকে যে ধারাবাহিকতায় ফলাফল আসছিল, যেভাবে হাড্ডাহাড্ডি আসছিল, ৩৪৩ ভোটের জয়-পরাজয় অস্বাভাবিক নয়। এমনটাই হওয়ার কথা। জিততে পারতেন সাক্কুও।

শিল্পকলা একাডেমিতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মাস্তানি, সাক্কুর ওপর হামলা, ফলাফল ঘোষণা স্থগিত না হলে নির্বাচন কমিশনের চাওয়া মানে ‘সুন্দর নির্বাচন উপহার’ দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণতা পেতো। কিন্তু আরফানুল হক রিফাতের সমর্থকরা সারা দিনের সাজানো সুন্দর বাগান তছনছ করে দিলেন এক লহমায়।

এখন এই নির্বাচনের ফল নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে, অন্তত ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মনিরুল হক সাক্কু ফলাফল প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ পেয়েছেন। বিষয়টা এখন খুব সহজ- মনিরুল হক সাক্কুর কাছে ১০৫ কেন্দ্রের স্বাক্ষরিত ফলাফল শিট থাকার কথা। তিনি সব শিট এবং একটি ক্যালকুলেটর নিয়ে গণমাধ্যমের সামনে হাজির হতে পারেন। সব কেন্দ্রের ভোট যোগ করে যদি না মিলে তবে তিনি আদালতে যেতে পারেন। নিছক প্রত্যাখ্যান বা মানি না বলে কোনও লাভ নেই। তবে এটা ঠিক, সব কেন্দ্রের ফলাফল যোগ করে যদি সাক্কু বেশি ভোট পান, আদালতেও যান; রায় পেতে লেগে যাবে বছরের পর বছর। নির্বাচনের ফল একবার ঘোষণা হয়ে গেলে তা বদলানোর রেকর্ড বড় কম।

ব্যবধান যাই হোক, এই জয় আরফানুল হক রিফাত তথা আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার তথা আওয়ামী লীগের জন্য বড় স্বস্তির। মাঠের লড়াইয়ে আরফানুল হক রিফাত থাকলেও এই নির্বাচনটি আসলে ছিল স্থানীয় সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন বাহারের জন্য প্রেস্টিজ ইস্যু। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে প্রথম দুটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন দলীয় রাজনীতিতে বাহারের প্রতিপক্ষ গ্রুপ। প্রথম নির্বাচনে আফজল খান, দ্বিতীয় নির্বাচনে তার কন্যা আঞ্জুম সুলতানা সীমা। সে দুবারই হেরেছিল আওয়ামী লীগ প্রার্থী। বলা হয়, সেই দুই নির্বাচনে বাহারের আশীর্বাদেই জয় পেয়েছিলেন মনিরুল হক সাক্কু। এবারই প্রথম বাহারের পছন্দের প্রার্থী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তাই জয় পেতে বেপরোয়া ছিলেন বাহাউদ্দিন বাহার। এমনিতেই কুমিল্লার রাজনীতিতে বাহারের একক আধিপত্য রয়েছে। এই জয় তার আধিপত্য আরও নিরঙ্কুশ করবে। এখন তিনি বুক ফুলিয়ে বলতে পারবেন, ১৯৭৩ সালের পর ২০০৮ সালে এসে জাতীয় সংসদের কুমিল্লা-৬ আসনটি পেতেও বাহারকেই লেগেছে। আবার সিটি করপোরেশনে জয় পেতেও বাহারকেই লাগলো। তার মানে কুমিল্লা আওয়ামী লীগে বাহারের কোনও বিকল্প নেই। পছন্দের প্রার্থীকে জেতাতে যেমন তাকে লাগে, তেমনি প্রয়োজনে দলীয় প্রতিপক্ষ গ্রুপের প্রার্থীকে হারাতেও তার জুড়ি নেই। তবে এবারের নির্বাচনে পছন্দের প্রার্থীকে জেতাতে বাহারের অনেক ঘাম ঝরাতে হয়েছে।

এতদিনের প্রিয় মনিরুল হক সাক্কু তো এবার প্রতিপক্ষ ছিলেনই, ছিলেন মনোনয়ন চেয়ে না পাওয়া আওয়ামী লীগের ১৩ প্রার্থীও। মাত্র ৩৪৩ ভোটের ব্যবধান হলেও এই জয় বাহারের জন্য তাই বিশাল স্বস্তির। ফলাফলটি আওয়ামী লীগের জন্য বড্ড অস্বস্তির। কারণ, আরফানুল হক রিফাত ৫০ হাজার ৩১০ ভোট পেলেও বিএনপির দুই বহিষ্কৃত প্রার্থী মিলে পেয়েছেন ৭৯ হাজার ৬৬ ভোট। জাতীয় নির্বাচনে এই অঙ্ক আওয়ামী লীগকে বিপাকে ফেলতে পারে। আবার বাহাউদ্দিন বাহারের একক ও নিরঙ্কুশ আধিপত্য স্থানীয় রাজনীতিতে তার প্রতিপক্ষ গ্রুপগুলোকে অনেক হতোদ্যম করে দেবে, যা চূড়ান্ত বিচারে আওয়ামী লীগের ক্ষতির কারণ হতে পারে।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন বাহাউদ্দিন বাহারের জন্য যেমন বড় পরীক্ষা ছিল, নির্বাচন কমিশনের জন্য তার চেয়ে বড় টেস্ট ছিল। মাঠের লড়াই রিফাত আর সাক্কুর মধ্যে হলেও মর্যাদার লড়াইটা বাহার আর নির্বাচন কমিশনের মধ্যে হয়েছে। সে লড়াইয়ে স্পষ্ট ব্যবধানে হেরেছে নির্বাচন কমিশন। আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় নির্বাচন কমিশন স্থানীয় সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন বাহারকে এলাকা ছাড়ার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু বাহার সে অনুরোধকে পাত্তা দেননি। তিনি বহাল তবিয়তেই নির্বাচনি এলাকায় ছিলেন। বাহার সত্যি আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছিলেন কিনা, নির্বাচন কমিশনের এ ধরনের অনুরোধ করার এখতিয়ার আছে কিনা তা নিয়ে তর্ক হতে পারে; নির্বাচন কমিশনের হাতে যে নিজের অনুরোধ কার্যকর করার মতো ক্ষমতাও নেই, সেই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশজুড়ে। ভবিষ্যতে আর কারও বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার নৈতিক অধিকার থাকবে না নির্বাচন কমিশনের। প্রধান নির্বাচন কমিশনার যতই বলুন ‘বাহার ইস্যু পাস্ট অ্যান্ড ক্লোজড’, মানুষ কিন্তু তা মানবে না। বারবার এই রেফারেন্স আসবে। বলাবলি হচ্ছে, যে নির্বাচন কমিশন স্থানীয় এক এমপির সাথেই পারে না; তারা জাতীয় নির্বাচনে সরকার, প্রশাসন, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপিদের সাথে কীভাবে পারবে। বাহারের গোয়ার্তুমি আর শেষ মুহূর্তের উত্তেজনা বাদ দিলে কুমিল্লা সিটি নির্বাচন একটি সুন্দর নির্বাচন হতে পারতো।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ