অনলাইনে আমাদের লেখাপড়া

অনলাইনে পাঠদান এখন একটি বাস্তবতা। অতিমারির বন্দিদশায় অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রমের পর এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট ও ডিভাইস সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি অনলাইনে গুণগত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেশের শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের।

অনলাইন শিক্ষার মূল শর্ত হলো সব শিক্ষার্থীর জন্য ইন্টারনেট এবং অনলাইনে পাঠ্যক্রমের ডকুমেন্ট নিশ্চিত করা। এ সময়ে শিক্ষার্থীদের জন্য কোর্সের ডকুমেন্ট প্রাণবন্ত করা উচিত। এ সিস্টেমে ছাত্রদের টিমওয়ার্ক গঠন করে ব্রেইন স্টর্মিং কঠিন। তারপরও আমাদের সংকটময় পরিস্থিতিতে তা মানিয়ে নিতে হবে এবং অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া উচিত। কর্তৃপক্ষ যদি অনলাইন পাঠদানের বাধ্যতামূলক নির্দেশনা দেয়, তবে অনেক দরিদ্র শিক্ষার্থী ল্যাপটপ, ইন্টারনেটের অভাবে ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। এ ছাড়া গ্রাম ও পার্বত্য অঞ্চলে আধুনিক প্রযুক্তিগত সুবিধার অভাব রয়েছে, যা অনলাইন শিক্ষার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তাছাড়া দুর্বল নেটওয়ার্ক এ ক্ষেত্রে বড় বাধাও বটে। সরকারের বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন ফাইভ-জি সংযোগ যুক্ত করার কথা ভাবছে। অথচ দেশের সব এলাকার গ্রাহক এখনও ফোর-জি নেটওয়ার্কের আওতায় আসেনি।

অনলাইন শিক্ষা-শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য নতুন একটি প্ল্যাটফর্ম। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক সরাসরি সহজেই ক্লাস নিয়ন্ত্রণ এবং একই সঙ্গে সব শিক্ষার্থীর কাজ মূল্যায়ন করতে পারেন। ক্লাসে শিক্ষক কম মনোযোগী শিক্ষার্থীদের শনাক্ত করতে পারেন এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে পারেন। কিন্তু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সরাসরি কথোপকথনের অভাবে অনলাইন ক্লাসকে সফল করা কঠিন বলে মনে হয়।

দেশের অনেক অঞ্চলে বিদ্যুৎ বিঘ্নিত সরবরাহ অনলাইন শিক্ষার জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। এখনও কিছু মানুষ বিদ্যুৎ সংযোগের বাইরে রয়েছে। অস্থিতিশীল বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং দুর্বল বিদ্যুৎ ব্যবস্থা অনলাইন শিক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করে। যেমন, শহরে সবাই বিদ্যুৎ সংযোগ পাচ্ছেন, কিন্তু এখনও কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার্থীরা থাকে, যেখানে বিদ্যুতের সমস্যা রয়েছে। সুতরাং এটি দেশের জন্য সাধারণ একটি চ্যালেঞ্জ।

যে শিশুদের নতুন বইয়ের ঘ্রাণে মেতে থাকার কথা, তাদের হাতে এখন আমরাই তুলে দিয়েছি অ্যানড্রয়েট সেলফোন, ল্যাপটপ ও কম্পিউটারের মতো ডিভাইস। যদিও তা সময়ের দাবি। কিন্তু সেই ডিভাইস শুধু ক্লাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। পড়া সংগ্রহ করা, হোমওয়ার্ক সাবমিট, গ্রুপ স্টাডি এসবের অজুহাতে সারাক্ষণই যেন ইলেকট্রনিকস ডিভাইসের সঙ্গে এরা নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে। তারা যেন এক নতুন ভার্চুয়াল জগতে ভেসে বেড়াচ্ছে।

বিশ্ব মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে বাংলাদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। যেসব দুরন্ত ছেলেমেয়ে তার সহপাঠীদের সঙ্গে মিলেমিশে লেখাপড়া ও মাঠে খেলাধুলা করতো, তারা এরপর থেকেই ঘরবন্দি । দীর্ঘদিন লকডাউনের ফলে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনায় অনেক ক্ষতি হয়েছে। দিনের পর দিন তাদের সহপাঠী ও শিক্ষকদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থা সচল রাখার জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে দেশের প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কোচিং পড়াশোনায় অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়। ভার্চুয়াল এই ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা জুম অ্যাপস, গুগল ক্লাসরুম, গুগল মিট, ওয়েবএক্স, ফেসবুক লাইভ, ইউটিউবের মতো বিভিন্ন সাইট ব্যবহার করে তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে ক্লাস শুরু করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ক’জন শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসের সুফল পেয়েছে? কী বা তারা শিখছে? এতে তারা কতটুকু শিক্ষা গ্রহণ করছে? আর দীর্ঘ সময় অনলাইন ক্লাস তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কী প্রভাব ফেলছে না?

সিদ্ধেশ্বরী এলাকার বসবাসকারী অভিভাবক পরেশ সাহা (৫১) প্রাইভেট একটি ফার্মে চাকরি করেন। সীমিত আয়ের এ ভদ্রলোকের ৩ সন্তান। বড়টি মেয়ে, বাকিরা ছেলে। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া তার ছোট ছেলেটিকেও ঘরবন্দি অবস্থায় অনলাইনে ক্লাস করতে দিয়েছিলেন। কোচিং ক্লাসে যা মাসিক বেতন, অনলাইনেও ২ হাজার টাকা। তিনি জানান, করোনা থেকে তার গোটা পরিবার মুক্ত থাকলেও ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার তেমন উন্নতি হয়নি। বরং অর্থ অপচয় যেমন হয়েছে তেমনি ছেলেমেয়েরা মোবাইল ফোনে আসক্ত হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েরা অনেক রাত করে ঘুমাতে যায়। ছোট ছেলেটি অধিকাংশ সময় ভিডিও গেম খেলে গ্রুপে বন্ধুদের সঙ্গে। ইউটিউবার সে। পরিবারের কেউ  সেলফোনের পর্দা থেকে তাকে সরাতে পারছে না।

অনলাইন বা ভার্চুয়াল ক্লাসের সুবিধা সবাই গ্রহণ করতে পারেনি। বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্লাস করতে পারছে না। কারণ, অনেকেরই অনলাইন ক্লাস করার জন্য স্মার্টফোন, কম্পিউটার অথবা ল্যাপটপ নেই। গ্রাম, চর, হাওর অথবা দুর্গম পাহাড়ি এলাকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ভার্চুয়াল শিক্ষা সম্পর্কে কোনও ধারণা ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। রাজধানী ছাড়া দেশের অন্যান্য জেলা থ্রি-জি/ ফোর-জি নেটওয়ার্ক বা ব্রডব্যান্ড সুবিধা সহজে দেখা মেলে না। ফলে টু-জি দুর্বল নেটওয়ার্ক দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন ক্লাস করার সুবিধা সবাই পায় না।

রাজারবাগ পুলিশ লাইনস স্কুলের শিক্ষিকা ইভি রহমান বলেন, প্রথমেই আমি অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থাকে সাধুবাদ জানাই। কথায় আছে, নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। একেবারে কিছু না শেখার চেয়ে যে ক’জন শিক্ষার্থী লেখাপড়ার সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে পারছে, তাই এখন আমাদের ভালো দিক হিসেবে ধরে নিতে হবে। অনেক শিক্ষক এখন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নানান  প্রযুক্তি অবলম্বন করে ক্লাস নিচ্ছেন। যা শিক্ষার্থীদের বোধগম্য হচ্ছে ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের যোগাযোগ রক্ষা হচ্ছে। অনলাইন ক্লাসের ফলে ছাত্রছাত্রীদের গৃহবন্দি একঘেয়ে জীবনে বৈচিত্র্য আসছে। ছাত্রছাত্রীদের বইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ থাকছে, যা তাদের জীবনে খুব প্রয়োজন। অনলাইন ক্লাস করার জন্য ছাত্রছাত্রীরা ঠিক সময়ে ঘুম থেকে উঠছে এবং নিয়মানুবর্তিতায় দিন কাটাচ্ছে, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

কয়েকজন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে কিছু মজার মজার বিষয় জানতে পেরেছি। টানা ৫-৬ ঘণ্টা ক্লাস করার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একঘেয়ে মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সব সুবিধা থাকার পরেও তারা ক্লাস করতে অনীহা প্রকাশ করছে। তারা প্রায় সময়ই সুযোগ পেলেই দুয়েকটা ক্লাস মিস দিয়ে দিচ্ছে। ক্লাসের ফাঁকে শ্রেণিকক্ষে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলার জন্য ছোটবেলা আমরা যেমন অস্থির হতাম, ঠিক তেমনি শিক্ষার্থীরাও শিক্ষকের অগোচরে বন্ধুদের সঙ্গে বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে চ্যাটিং করে। ফলে তাদের শিক্ষকদের লেকচার পুরোপুরি বোধগম্য হয় না। কেউ কেউ স্প্লিট স্ক্রিন সুবিধা গ্রহণ করে একই সঙ্গে ক্লাসে থাকছে এবং এর পাশাপাশি অন্য অ্যাপস ব্যবহার করে বন্ধুদের সঙ্গে ক্লাস চলাকালে যোগাযোগ রাখছে, কিন্তু তা তাদের শিক্ষকেরা বুঝতেই পারছেন না। অনেকেই বাড়ির কাজ বা শ্রেণি পরীক্ষায় প্রশ্নের উত্তর বন্ধুদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে উত্তর দিয়ে দেয়। সম্পূর্ণ প্রশ্ন না পড়ে একেক বন্ধু একেকটার উত্তর পড়ে এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে উত্তর পাঠিয়ে দেয়। মানে, তারা সবাই ১০০-তে ১০০ নম্বর পায়।

অনলাইনে ক্লাস করতে শিক্ষার্থীদের অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবে অনেক শিক্ষক ক্যামেরা–ভীতিতে ভুগছেন। তারা সুন্দর, সাবলীল, বোধগম্য ও আকর্ষণীয় লেকচার দিতে পারছেন না। অনলাইনে গণিত ও পরিসংখ্যান বিষয় অধিকাংশ শিক্ষার্থী বুঝে না। ফলে শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েছে। অনলাইনে ক্লাস করে শিক্ষার্থীরা তাদের সব পড়া সঠিকভাবে বুঝতে পারছে না, আর না বুঝলে শিক্ষকদের কাছে আবার প্রশ্ন করে বুঝে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। তাই অনলাইনে অনেক বিষয়ে পড়াশোনায় ঘাটতি রয়েই যাচ্ছে।

২০২২ সালের বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এই তিন পর্যায়ে ২৩ হাজার ৮৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২০২১ সালে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৯ লাখ ১৩ হাজার ৯৪৮ জন। যার বেশিরভাগই গ্রামের শিক্ষার্থী। বর্তমান বাস্তবতায় এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসে যুক্ত করা একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। অনেকে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত। নামেমাত্র মূল্যে ইন্টারনেট সেবা দ্রুতগতির সংযোগ, ঘরে ঘরে বিরতিহীন বিদ্যুৎ এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণই পারে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে ডিজিটাল বাংলাদেশের সত্যিকার বাস্তবায়ন করতে। আর তা হলে অনলাইনে শিক্ষা গ্রহণের পদ্ধতি গণমুখী হবে। অনলাইন ক্লাস শিক্ষার্থী ও শিক্ষকবান্ধব হবে।  

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও সাহিত্যিক

reporterpranab@gmail.com