মনোজগতের অবকাঠামো বিনির্মাণের মেগা প্রকল্প চাই

তারাপদ রায়ের ‘আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে’ কবিতাটি চোখের সামনে এলো। কবিতার লাইনগুলো পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম, আরে এ-তো আমারই কথা। এই কথাগুলোই তো বলতে চাইছিলাম আমি/আমরা। এই কবিতাটি আসলে কবিতা নয়। এর মাঝে নেই কোনও বাহুল্য অলংকার। একদম ঝরঝরা, নিরেট সোজা কথায় বাঙালির পরিবর্তনের আলাপটি তুলে এনেছেন সেখানে।

তিনি লিখেছেন –

আমরা টের পাইনি
আমাদের ঝরণা কলম কবে ডট্‌ পেন হয়ে গেছে
আমাদের বড়বাবু কবে হেড অ্যসিস্ট্যান্ট হয়ে গেছেন
আমাদের বাবা কবে বাপি হয়ে গেছেন।

এভাবেই আমাদের বাঙালিয়ানা/বাঙালিত্বকে আমরা একে একে বিসর্জন দিয়ে এসেছি। গোড়াকে ভুলে সবসময় বাইরের হাতছানিকে বুকে টেনে নিয়ে আত্মপরিচয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করেছি। তারাপদ রায় একাল সেকাল দুই কালের কবি। তিনি যেন বাঙালির পোশাক পরিবর্তনের পর্বটিকে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে বর্ণনা করতে পেরেছিলেন।

না। তারাপদ রায়ের কাব্য নিয়ে আলোচনার জন্য এই লেখা নয়। অত্যন্ত ভারাক্রান্ত আছি গত কয়টি দিন, আসলে দিন নয়, বছর ধরেই ভারাক্রান্ত আমরা। আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু পেয়েছি। এই সেতুকে কেন্দ্র করে আমাদের আহ্লাদ বা আপ্লুত হওয়ার যে ইতিহাস রচিত হয়েছে সেটিও বাস্তব। কেবল বাংলাদেশ নয়, গোটা বাঙালি জাতি আজ আত্ম-অহংকার খুঁজে পেয়েছে এর মাঝে। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা আজ গর্বিত। কারণ, নিজেদের কষ্টার্জিত আয়ে আমরা আমাদের আগামীকে গড়তে পারছি। কিন্তু এর পাশাপাশি যখন দেখি জাতির মেরুদণ্ড গড়ার কারিগর আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের গলায় ধর্মীয় অনুভূতির নামে জুতার মালা পরায় তারই ছাত্ররা, যখন দেখি ছাত্রের হাতের লাঠির আঘাতে মৃত্যু হয় একজন শিক্ষকের, তখন হতাশা ঘিরে ধরে আমাদের।

এমন তো হবার কথা ছিল না। ১৯৭১ সালে জন্ম নেওয়া দেশটির তো হবার কথা ছিল অসাম্প্রদায়িক। এখানে তো মানুষের কাছে মানুষের পরিচয় হওয়ার কথা ছিল বাঙালি/বাংলাদেশি হিসেবে। কোনও ধর্মীয়, জাত, পাত, লিঙ্গের বিবেচনা তো এখানে আসার কথা ছিল না। তাহলে কেন আজ ঠুনকো ধর্মীয় অনুভূতির নামে এমন সাম্প্রদায়িকতার উৎসব চলছে? কেন একজন মানুষ, যে ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলিম, তার মধ্যে সংখ্যার বিবেচনায় লঘু না গুরু সেই ভাবনা আসবে?

কোথায় সমস্যা? ধর্ম তো কখনও মানুষের মাঝে হানাহানির কথা বলেনি। ধর্ম তো কখনও হত্যা লুণ্ঠনের মাধ্যমে নিজের অবস্থানকে পোক্ত করতে চায়নি। ধর্ম তো বিশ্বাসের কথা বলে। ধর্ম তো যে যার বিশ্বাসকে শ্রদ্ধার কথা বলে। তাহলে তারা কারা যারা আজকে এত অনুভূতিপ্রবণ হয়ে গেলো? তারা কারা যাদের শক্তি রাষ্ট্রের চেয়েও বেশি হয়ে গেলো?

শিক্ষক জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বলেই জেনে এসেছি। একজন শিক্ষক কখনোই তার শিক্ষার্থীদের মাঝে ধর্মের বিভেদ টানেন না। তার কাছে মুখ্য থাকে সন্তানসম ছাত্রদের উন্নতিকে নিশ্চিত করা। অথচ আমরা এখন দেখছি সেই শিক্ষকদেরই ধর্মের নামে হেনস্তা করা হচ্ছে। একজন হৃদয় মণ্ডলের মতো বিজ্ঞান শিক্ষককে কেবল হিন্দু হবার কারণে শ্রেণিকক্ষে নাজেহাল করা হয়। পুলিশ কাস্টডিতে নিতে হয়। কী অপরাধ করেছিল নড়াইলের শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাস? কেন তাকে এভাবে পুলিশ পাহারায় জুতার মালা পরানো হলো? হিন্দু বলেই কী? জানা গেছে, স্বপন কুমারের কলেজের কোন শিক্ষার্থী ভারতের বিতর্কিত বিজেপি মুখপাত্র নুপূর শর্মার পক্ষে কোন একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছে। স্বপন কুমারের অপরাধ, তিনি বিষয়টিকে আইনের পথে সুরাহা করতে চেয়েছেন। ছাত্ররা ধরে নিয়েছে এই শিক্ষক সেই ছাত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, তাই তাকে হেনস্তা করা জায়েজ। সম্ভবত আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী পুলিশ বাহিনীও একই মতের অনুসারী। না হয় আইনের লোক হয়ে কেমন করে একজন শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরানোকে সমর্থন করতে পারে?

প্রশ্ন হচ্ছে, একজন ছাত্রের কাছে শিক্ষক হচ্ছে মহামানব। এমনটাই শিখেছিলাম ছোটবেলায়। শুনেছি শিক্ষকের বেত যে জায়গায় পড়বে সেই জায়গা নাকি স্বর্গে যাবে। এমনি মিথ ছিল শিক্ষকদের মহাত্মকে বোঝাতে। বাদশাহ আলমগীরের কবিতা মুখস্থ করেছি সবাই। পরীক্ষার খাতায় শিক্ষকের মর্যাদা বিষয়ক প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছি। কোথায় সেসব শিক্ষা আজকে? ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে কথা বলায় লাঠির আঘাতে হত্যা করা হয়েছে শিক্ষক উৎপল কুমারকে।

এমন প্রতিদিনই কিছু না কিছু ঘটে চলেছে। ফেসবুকেও আপনি সেসব ঘটনার সমালোচনা করতে পারবেন না। তাহলেও আপনার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার ধোয়া তুলে সৃষ্টি করা হবে গণ্ডগোল।

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। প্রায় সকল ক্ষেত্রেই দেশের অগ্রগতি প্রশংসনীয়। রফতানি খাতেও প্রবৃদ্ধি এসেছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন এখন দৃশ্যমান। কিন্তু মানুষের মনোজগতের অবকাঠামোটি যে ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ছে সেদিকটি আমরা কি আর অবহেলা করতে পারি? সরকারের আপসকামী মনোভাব, শিক্ষাক্ষেত্রের পশ্চাৎপদ সিলেবাস, সারা দেশে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের ভঙ্গুর অবস্থা আমাদের ঠেলে দিচ্ছে এক ভয়াবহ সাংস্কৃতিক শূন্যতার দিকে।

আজকে একটি বিশাল প্রজন্ম না শিখছে ধর্মের সঠিক চর্চা, না শিখছে সংস্কৃতি। তারা না বাঙালি না মুসলিম। কেবল শিখেছে নিজের ধর্মই সেরা, আর সেই শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারে আজ তারা অন্ধ। তারা ভুলে যাচ্ছে যে সব ধর্মের মানুষের কাছেই তার নিজ ধর্ম শ্রেষ্ঠ, কিন্তু তাই বলে এই শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে মানুষকে বিচার করা যায় না। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক দেশ নয়। এ দেশে কেবল একটি ধর্মের লোকই বাস করে না। আছে আরও নানা জাত ও ধর্মের মানুষ। তাদেরও অধিকার আছে এ দেশের সবকিছু ওপর। একজন ভিন্ন ধর্মের মানুষের তৈরি ফেসবুকে মত প্রকাশের অধিকার সবার সমান। এটা না হলে তো ফেসবুকের উদ্ভাবনকারী একজন খ্রিষ্টান হয়ে মুসলিমদের এই অধিকার দিতো না।

দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি এই মুহূর্তে জরুরি হচ্ছে মানসিক অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের ডিজাইন করা। বড় বড় প্রকল্প কেবল আর্থিক উন্নতি নিশ্চিত করছে, কিন্তু মানসিক উন্নতিকে নিশ্চিত করতে পারে কেবল শিক্ষা ও শিল্প সংস্কৃতির প্রকল্প প্রণয়ন।

লেখক: কলামিস্ট