পদ্মা সেতু এবং পর্যটন ভাবনা

বেশ কয়েক বছর আগে অ্যাকাডেমিক কাজে বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাওয়া ও আরিচা ঘাট দিয়ে গোপালগঞ্জ জেলায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল কয়েকবার। অসহ্য যানজট, ফেরি এবং লঞ্চে সময় ব্যয় করে যাওয়ার অভিজ্ঞতা তেমন সুখকর ছিল না। দক্ষিণবঙ্গের অধিবাসীদের পদ্মা সেতু উপহার দেওয়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমাদের গর্বের অহংকারের পদ্মা সেতু পরিদর্শনে যাই গত ১ জুলাই, ২০২২ পরিবার এবং বন্ধু পরিজন নিয়ে। রাজধানী ঢাকার বাবুবাজারের পথ ধরে পদ্মা সেতুতে উঠার সময় ঘণ্টাখানেক বসে থেকে টোল দিয়ে পদ্মা সেতুর দিকে এগিয়ে যাই। সেতু কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মোতাবেক আমরা কেউ গাড়ি থেকে নামিনি। সেতুর ওপারে পৌঁছানোর আগে যাত্রী ছাউনি চোখে পড়ে। আমাদের গাড়ির যাত্রীরা গাড়ি থেকে নেমে টয়লেট খোঁজেন। না পেয়ে ফিরে আসেন। যখন ‘ভাঙা’ নামক এলাকার দিকে পৌঁছাই  তখন ঘড়িতে প্রায় ১টা ৩০ মিনিট। গাড়িতে থাকা বয়োবৃদ্ধ এবং নারীরা টয়লেট ব্যবহার করতে চাইলে তখন গাড়ির দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ আমাদের একটি মডেল মসজিদের পেছনের এক মাদ্রাসায় নিয়ে যান। লাইনে দাঁড়িয়ে কমপক্ষে ৫০-এর অধিক নারী টয়লেট ব্যবহার করেন। যাত্রাবিরতির পর যেতে যেতে প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য অবলোকন করে  পৌঁছে যাই বাংলাবাজার ইলিয়াস আহম্মেদ চৌধুরী লঞ্চ ঘাটের সামনে একটি খাবারের দোকানে। সেখানে খাবার সেরে ঘাটে গিয়ে প্রথমেই ধাক্কা খেলাম জনাকীর্ণ ব্যস্ত ঘাট এখন জনমানবশূন্য। ঘাটে ভিড়ে আছে বেশ কয়েকটি লঞ্চ। একটু এগিয়ে গিয়ে লঞ্চে থাকা কয়েকজনের কাছে জানতে চাইলাম, তারা এখন কী করে জীবিকা নির্বাহ করছে? উত্তরে জানায়, কেউ কেউ অন্যান্য জীবিকার দিকে এগিয়েছে, কেউ কেউ বেকার। তাদের কাছে জানা গেলো, এপার-ওপার মিলিয়ে দুই পাড়ে ৮৬টি লঞ্চ এখন বন্ধ। তারা এখন এই লঞ্চগুলোকে অন্য কোনও ঘাটে ভিড়াতে চাইছে। যেসব জাহাজের মেয়াদ নেই, সেগুলো বিক্রি করে দেবে বলে ভাবছে। আমরা জনপ্রতি ৭০ টাকা দিয়ে একটি লঞ্চে করে খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করি পদ্মা সেতু। দূর থেকে দেখি দুর্বার গতিতে পদ্মা সেতুতে পরিবহনের চলাচল।  গোধূলি আলোয় সেই লঞ্চযাত্রাটি ছিল মনে রাখার মতো। ফেরার পথে লঞ্চ থেকে প্রত্যক্ষ করি শরীয়তপুরের  কেওড়াকান্দি ঘাটে বাঁধাই করা রাস্তায় দর্শনার্থীদের ভিড় । ঘাটে ভিড়ানো নৌকা এবং স্পিডবোট।  জনমানুষের চলাচল আমাকে আনন্দিত করে। লঞ্চ থেকে যখন নেমে আসি তখন ঘাটে  দু-একটি চায়ের দোকান খোলা। তাদের জিজ্ঞেস করি, দোকান এখন কেমন চলছে। তারা জানান, দোকান আর তারা চালাবেন না। শত শত খাবারের দোকান বন্ধ। বাস কাউন্টার বন্ধ। পুরো জায়গাটিতে আবর্জনা স্তূপে ভর্তি। শুধু একটি খাবারের দোকান খোলা। যে দোকানে আমরা দুপুরের আহার গ্রহণ করেছিলাম। তাদের দোকানে আবার গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, লোকজন কেমন আসে? তাদের উত্তর, একেবারেই কম। খাবারের দোকানের সামনে মাটিতে কয়টা কাঁচ কলা এবং দুটো কুমড়ো এবং কয়েকটি বোম্বে মরিচ রাখা। বিক্রেতাকে খুঁজে পেলাম না। হয়তো কোনও ক্রেতার আশায় এসেছেন বিক্রি করতে। কৌতূহলবশত  ঘাটের কাছে থাকা  পাবলিক টয়লেট পরিদর্শন করে দেখি বেহাল অবস্থা। বেসিন দুটো ভাঙা। তিনটি টয়লেটের দুটোই ব্যবহারের অযোগ্য। ঘাটে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা হতে থাকে। আমরা সবাই জনমানবশূন্য ঘাটটি ছেড়ে ঢাকায় ফেরার প্রস্তুতি নেই। সন্ধ্যার আগমনে ঘাটটি অন্ধকার হতে যেতে দেখলাম। ফেরার সময় পদ্মা সেতুতে টোলঘরে টোল দেবার জন্য পুনরায় দীর্ঘ  একঘণ্টা বসে থেকে সন্ধ্যার ঝিকিমিকি আলোয় পদ্মা সেতুতে এগিয়ে যাই। গাড়ি থেকে দেখতে পাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সামরিক বাহিনীর সদস্যদের টহল। মাঝে মাঝেই চোখে পড়েছে কেউ কেউ নিয়ম ভঙ্গ করে সেতুতে নেমেছেন। ধীরে ধীরে আলো ঝলকানো পদ্মা সেতুকে পিছনে ফেলে গন্তব্যের উদ্দেশে এগিয়ে যাই।

ফিরতে ফিরতে ভাবি, শরীয়তপুরের বাংলাবাজারের ইলিয়াছ আহম্মেদ চৌধুরী ঘাটের লঞ্চগুলোকে যদি হাউজ বোটে পরিণত করা যায়, পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা যায় তাহলে পর্যটকরা আকৃষ্ট হবেন। তারা পদ্মা নদীর রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। প্রাণ হারিয়ে যাওয়া ঘাটটি প্রাণ ফিরে পাবে। ঘাটে থাকা খাবারের দোকানগুলো আধুনিকায়ন করা, ঘাটের সামনে থাকা বিস্তর জায়গায় বিনোদন পার্ক স্থাপন, আধুনিক স্যানিটেশন ব্যবস্থা প্রবর্তন, সেই সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে নিরাপত্তা বিধান করলে এটি হতে পারে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান। বেশ কয়েকটি কারণে পদ্মা পাড়ে পর্যটন এলাকা নির্মাণ করা যুক্তিযুক্ত। যেমন- প্রমত্তা পদ্মা নদীর অপরূপ দৃশ্য, পদ্মার ইলিশ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং আমাদের গর্বের পদ্মা সেতু। এতগুলো উপকরণ যে স্থানে আছে, সে স্থানটিকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নান্দনিক করে তোলা যায়। পদ্মা  সেতুতে থাকা ছয়টি টোলঘরের যদি দুটি টোল ঘরে ব্যক্তিগত গাড়ি, দুটি টোলঘরে বড় বাস এবং ট্রাক, বাকি দুটি টোলঘর দিয়ে মোটরসাইকেল এবং জরুরি যানবাহন চালানোর ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে টোলঘরের সামনে একঘণ্টা বা তার চেয়ে বেশি সময় ধরে বসে থাকার অবসান ঘটবে। তাছাড়া যে পরিবহনের বাসগুলো নিয়মিত চলাচল করে সেগুলো যদি প্রতি মাসে সেতু কর্তৃপক্ষের অ্যাকাউন্টে টোল জমা দেয় তাহলে ম্যানুয়ালি অর্থ গ্রহণ করার সময় ব্যয় কম হবে। এছাড়া অ্যাপসের মাধ্যমে ই-ক্যাশের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করে আমরা সাধারণ যাত্রীদের সেতু পরিদর্শন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে একটি ডিজিটাল প্রবেশ কার্ড দেওয়া যেতে পারে। যা পাঞ্চ করে গাড়ি প্রবেশ করবে। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ এবং জমা প্রদান এবং হিসাব সংরক্ষণেও স্বচ্ছতা থাকবে। সেতুর দুই পাশে যাত্রী ছাউনির সঙ্গে পাবলিক টয়লেট স্থাপন করলে পর্যটক এবং দক্ষিণবঙ্গে যাতায়াতকারী যাত্রীদের শারীরিক স্বাস্থ্যের মঙ্গল হবে।

পদ্মা সেতু আমাদের দক্ষিণবঙ্গের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। এই সেতু আমাদের কৃষি অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখবে এ বিষয়ে আমরা সকলে অবগত। তবে তার সাথে সাথে পর্যটকদের জন্য পর্যটন এলাকা নির্মাণ করলে দেশের পর্যটন খাতের নতুন দ্বার উন্মোচন হবে। পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে। সাধারণ মানুষ এখন পরিবারসহ অবসরে বেড়াতে পছন্দ করেন। আর বেড়ানোর জন্য অন্যতম আকর্ষণ এখন পদ্মা সেতু। ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর আমরা লক্ষ করেছি, সেতুর টোলঘর থেকেই আমাদের কোটি কোটি টাকা অর্জিত অর্থের পরিমাণ। শুধু ১ জুলাই, ২০২২ তারিখে পদ্মা সেতুতে সর্বোচ্চ ৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা টোল আদায় করা হয়েছে। এই অর্থ উপার্জন আমাদের অর্থনীতির জন্য খুবই শুভ সংবাদ। সেতুর আশপাশে  বিশেষ করে লঞ্চ এবং ফেরিঘাট এলাকায় সরকারি এবং বেসরকারি অংশীদারিত্বে পর্যটন এলাকা, মোটেল নির্মাণ করা গেলে প্রান্তিক মানুষগুলোর কর্মসংস্থান ঘটবে এবং পর্যটন খাতে বেশ অর্থ উপার্জন হবে বলে সহজেই অনুমেয়।

দেশকে নিয়ে, পদ্মা সেতুকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে রাজধানী ঢাকায় ফিরে আসি। ভাবতে থাকি, আমাদের ঢাকায় এবং বিভাগীয় শহরগুলোতে কোনও একসময় কোনও এক স্থানে পর্যটকদের জন্য আলাদা যানবাহনের ব্যবস্থা থাকবে। বিদেশি পর্যটকরা আসবেন। তারা নিশ্চিন্ত মনে ঘুরবেন। আর সেই বাসের সামনে লেখা থাকবে টুরিস্ট বাস। নেপাল এবং ভারতে এমন বাসে চড়ে বেড়িয়েছি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে পর্যটকদের জন্য আলাদা বাসস্ট্যান্ড রয়েছে এবং বাস রয়েছে।

আসলে একটি দেশে সব ধরনের আধুনিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা যায়। শুধু দরকার প্রবর্তনের সদিচ্ছা এবং জবাবদিহি। উন্নত সেবা, শক্তিশালী পরিবীক্ষণ, যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য স্থানে আসীন করা, দুর্নীতির শিকড় উপড়ে ফেলা এবং আন্তরিক দেশপ্রেমের মাধ্যমেই যেকোনও দেশ উন্নত হতে পারে। কিন্তু পরশ্রীকাতরতা, সমালোচনা এবং বিদ্বেষ মনোভাব দেশকে অনেকটা পেছনে ফেলে দেয়।

আমাদের গর্বের পদ্মা সেতু উন্মোচনের পর আমরা বেশ কয়েকটি ঘটনা লক্ষ করেছি, যেসব ঘটনায় প্রতীয়মান হয়েছে আমরা দিনে দিনে প্রযুক্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি এটি যেমন ঠিক, তেমনি মানসিক দিক থেকে কেউ কেউ আদিম যুগে ফিরে গিয়েছেন। নইলে পদ্মা সেতুর মতো আমাদের আবেগের জায়গায় মূত্র ত্যাগ করা, সেতুর হ্যান্ডেলের নাট খুলে ফেলার দুঃসাহসিকতা, সেতুতে গাড়ি থামিয়ে মস্তিষ্ক বিকৃতির মানুষদের টিকটক করা, তাছাড়া সেতুতে দুর্ঘটনা, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো এসব আমাদের মর্মাহত করেছে। সামনের দিকে রাজধানী ঢাকায় মেট্রোরেল উদ্বোধন হবে। এরকম সংকীর্ণ মানসিকতা বিরাজ করলে হাজার হাজার কোটি টাকার স্থাপনাগুলো অবহেলা এবং পরশ্রীকাতরতায় নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সকলের মধ্যে দেশপ্রেম এবং ভালোবাসায় এগিয়ে যায় দেশ। তার আগে সাধারণ জনগণের মাঝে মাঝে পৌঁছাতে হবে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতিসাধন করলে এর শাস্তি কী।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫ সালে জাতীয় সংসদে এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমাদের আত্মসমালোচনার প্রয়োজন, আমাদের আত্মসংযমের প্রয়োজন, আমাদের আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন।’ সামনের দিকে আমরা ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছি । আর এ সময়টিতে আমাদের আত্মসমালোচনা, আত্মসংযমী এবং আত্মশুদ্ধির মতো গুণ অর্জন করতে হবে।

অবারিত সম্ভাবনার এই বাংলাদেশে পর্যটনে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তাহলেই ইলিয়াছ আহম্মেদ চৌধুরী ঘাটের মতো পড়ে থাকা ঘাটগুলো জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে থাকবে না। বেকার মানুষগুলো মানবসম্পদে পরিণত হবে। শুধু দরকার সঠিক পরিকল্পনা এবং এর নির্মোহ বাস্তবায়ন। তাহলেই আমাদের দেশ হবে স্বপ্নের সোনার বাংলা। স্বপ্নযাত্রার অংশীদার পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে শক্তিশালী করুক এই প্রার্থনা। আসুন, রাষ্ট্রীয় সম্পদকে ভালোবাসি এবং বিদেশে নয়, দেশে বিনিয়োগ করি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যতম পর্যটন শিল্পের দেশ হিসেবে তুলে ধরি। যে যে স্থানে আছি, সবাই ভাবি লাল সবুজের পতাকার বাংলাদেশকে কীভাবে বিশ্বের বুকে তুলে ধরা যায়। আমাদের অর্থে আমাদের চেষ্টায় সাহসিকতায় যদি আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারি, তাহলে আমরা ভবিষ্যতেও পারবো এই বাংলাদেশে আরও অসম্ভবকে সম্ভব করতে। যে জাতি নয় মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে পারে, নিজ অর্থে বৃহৎ বাজেটের পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারে, সে জাতি একদিন বিশ্বের বুকে অর্থনীতি, মেধায় এবং শৃঙ্খলায় বিশ্বসেরা জাতি হবে বলে আমি মনে করি। শেষ করবো ক্ষণজন্মা কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের  ‘পূর্বাভাস’ কাব্যগ্রন্থের ‘দুর্মর’ কবিতার কয়েকটি চরণ দিয়ে, ‘এবার লোকের ঘরে ঘরে যাবে/ সোনালী নয়কো, রক্তে রঙ্গিন দান/দেখবে সকলে সেখানে জ্বলছে/দাউ দাউ করে বাংলাদেশের প্রাণ’।

লেখক: অধ্যাপক, লোক-প্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়