X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

একটি নিরাপদ শহর কি পাবো না?

ড. জেবউননেছা
০৪ মার্চ ২০২৪, ০১:১৭আপডেট : ০৪ মার্চ ২০২৪, ২০:২৯

সমাজের ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা নিয়ে ক’দিন ধরেই মনটা ভীষণ বিষণ্ন। তার মধ্যে রাজধানীর একটি  হাসপাতালে খতনা করতে গিয়ে শিশু আয়ানের মৃত্যু, অ্যান্ডোসকপি করতে গিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাহিবের মৃত্যু। রাহিব আমার সরাসরি শিক্ষার্থী ছিল না, কিন্তু সে তো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্তান ছিল। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত চলে যাওয়া আমাকে কাঁদিয়েছে। এরপর জানতে পারি কোনও এক শিক্ষা সফরে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শিক্ষার্থীর সঙ্গে মদপানের খবর। ওদিকে রাজধানীর নামকরা বিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে নিপীড়নের খবর। ভাষার মাসে বাংলা একাডেমির বইমেলায় মোড়ক উন্মোচন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক।

২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে ক্লান্ত চোখে সামাজিক মাধ্যমে স্ক্রল করতে গিয়ে চোখে পড়ে বেইলি রোডে আগুন লেগেছে। তখন এত দুঃসংবাদ চোখে পড়েনি। সকালে সামাজিক মাধ্যমে স্ক্রল করতে গিয়ে দেখি বুয়েটের দুজন শিক্ষার্থী সেই দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। আঁতকে উঠি। এরপর ধীরে ধীরে দেখতে পাই ইতালির নাগরিকত্ব পাওয়া এক পরিবারের পাঁচ সদস্য, সাংবাদিক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী আরও অনেকে। মোট ৪৬ জন। হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন আরও অনেকে।

না আর কোনও খবর সামাজিক মাধ্যমে চোখে পড়ে না। একটিই খবর, বেইলি রোড। সংবাদ পড়ি আর চোখের জল ঝরাই। নিজেকে অসহায় লাগে। সামাজিক মাধ্যমে শোকের মাতম। যারা চলে গেছেন তারা যেন আত্মার আপনজন। এটা কী হলো!

এরপর ভাবি, আচ্ছা যে ভবনে আমি বাস করি, সে ভবনে জরুরি সিঁড়ি আছে, কিন্তু জরুরি বহির্গমন নেই। এমনকি আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পর্যন্ত আসার জায়গা নেই। কিন্তু কি করে এই ভবন অনুমোদন পেলো? তাহলে তো আমিও একই কাতারেই আছি। শুধু সময়ের অপেক্ষা।

আমার বাসার পাশেই সরকারি একটি অধিদফতরের জায়গা। সেখানে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট ঘর, যেগুলো ভাড়া দেওয়া। কয়দিন আগে কোনও এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পরিদর্শনে আসবেন শুনে সেই ছোট ছোট ঘরগুলো ইট লাগিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল। এরপর যা আগে ছিল, তাই হয়ে গেলো। আর এক পাশের ভবনের ছাদে বেসরকারি টেলিফোন সংস্থার টাওয়ার। পুরো শহরটা যেন একটা মৃত্যুকূপ, যেখানে ভূমিকম্প হলে কিংবা আগুন লাগলে প্রাণহীন হয়ে পড়তে হবে।

এসব দেখার কেউ কি নেই? তাহলে কে দেখবে? কেন দেখবে? কী কারণে দেখবে? মাস শেষে বেতন পাচ্ছে। সংসার চলে যাচ্ছে। যার যা মন চায় করছে। আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের বড় গাড়ি আমার বাসার প্রধান ফটকে আসার সুযোগ নেই। ওদিকে পত্রিকায় কিশোর গ্যাংয়ের খবর, মাদকের  খবর। এদিকে একটা ছোট ডিভাইসে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে টিকটকাররা। তারা সেলিব্রেটি বনে যাচ্ছে। টিকটকার থেকে কেউ হয়ে যাচ্ছে অভিনেতা, অভিনেত্রী। ওদিকে কেউ কেউ পদ পেয়ে সেই পদের অপব্যবহার করে আত্মীয়-স্বজনকে চাকরি দিচ্ছেন। নিয়োগে বাণিজ্যের খবর অহরহ চোখে পড়ছে। হঠাৎ ডিমের দাম হয়ে যায় আকাশচুম্বী। পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায় লাগামহীন। যেন ভেসে যাওয়া সময়ে কচুরিপানার মতো ভেসে আছি আমরা সবাই। কারও কোনও তোয়াক্কা নেই এসবের। প্রতিনিয়ত নিজের আখের গোছানোর জন্য ব্যস্ত যেন আমরা সবাই।

এসব এলোমেলো বিষয় নিয়ে সারা দিন ভাবতে থাকি। দিনশেষে জানা যায়, যে ভবনে আগুন লেগেছিল সেটি অনুমোদনহীন। যদি তাই হয় তাহলে কি করে ভবন নির্মাণ হলো? কে অনুমতি দিলো? কেন অনুমতি দেওয়া হলো? যারা এই অপকর্মটি করলো, তারা কি ফিরিয়ে দিতে পারবে ৪৬ জনের জীবন?

নিমতলি, চুড়িহাট্টা, তাজরিন ফ্যাশনের সঙ্গে বেইলি রোডের দূরত্ব কতটুকু? সবই তো কাছাকাছি। তাহলে দূরে কারা? দূরে অবস্থান করে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা।

বেইলি রোডের এই দুর্ঘটনা আমাদের বুঝিয়ে দিয়ে গেলো, সর্বত্র সর্বস্তরে সজাগ হওয়া জরুরি। কোড মেনে ভবন নির্মাণ জরুরি। অবৈধ দখলদার থেকে নদীর মুক্ত হওয়া জরুরি।

নিয়োগ ব্যবসায়ীদের হাতেনাতে ধরা জরুরি। দ্রব্য মজুতকারীদের চিহ্নিত করা জরুরি। সর্বোপরি সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জবাবদিহি জরুরি।

রাজধানী ঢাকাকে বাঁচানোর জন্য বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি। বিভাগে বিভাগে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা জরুরি।

আমরা যারা ঢাকাবাসী, একটু স্বস্তির নিশ্বাস নিতে যাবো কোথায়? ওই এক চিলতে রেস্তোরাঁই ভরসা। কিন্তু সেই ভরসার স্থল যদি হয় মৃত্যুকূপ, তাহলে আর কিই বা বলার থাকতে পারে। এখনই সময় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা রেস্তোরাঁ চিহ্নিত করা। তাদের শাস্তির আওতায় আনা।

করোনাভাইরাস বিশ্বকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। ২৯ ফেব্রুয়ারির ভয়াবহ রাত চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেলো, আমাদের সতর্ক দৃষ্টি দেওয়া জরুরি।

সমাজটা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। আর তাই তো আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জের বইপ্রেমিক একুশে পদকে ভূষিত হন। কয়েকজন কিশোর মিলে একটি চড়ুই পাখির জীবন রক্ষা করে। কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের পরিশ্রম দিয়ে শিক্ষার্থীদের সুন্দর জীবন গঠনে সাহায্য করছে। আরও কত কী। কিছু জানি, কিছু জানি না।

স্বাধীনতার মাস শুরু হয়েছে। এ মাস থেকেই শুরু হোক সমাজকে রাহুমুক্ত করার অভিযান। আমি এখনও বিশ্বাস করি, সমাজের বেশিরভাগ মানুষ সৎ এবং নির্ভরযোগ্য। গুটি কতক মানুষ তারা অন্ধকারে কালো হাত বাড়িয়ে অপকর্ম করে। আর তার দায় নিতে হয় সাধারণ মানুষের। যেমন করে দায় নিয়েছে ৪৬ জন সাধারণ মানুষ। সমাজের প্রতিটি জায়গায় সবাই যদি যেকোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তাহলে অন্যায়কারীরা পিছনের দরজা দিয়ে অন্ধকারে লুকাবে।

আসুন যেখানে অন্যায় দেখবো, সেখানেই প্রতিবাদ করবো এই প্রতিজ্ঞা করি। প্রতিজ্ঞা করি দেশটাকে ভালোবাসবো। অন্যায়কারীরা সবসময় ভয়ে থাকে। তাদের মেরুদণ্ড দুর্বল থাকে। সুতরাং সমাজে মুখোশধারী মানুষগুলোর মুখোশ উন্মোচন করার জন্য একযোগে কাজ করা সময়ের দাবি।

আমি একটি নির্মল রাজধানীর স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন দেখি মাদকমুক্ত তরুণ সমাজ এবং অনিয়ম এবং নিয়োগ বাণিজ্যমুক্ত প্রতিষ্ঠান। একটি ঝকঝকে তকতকে রাজধানীর স্বপ্ন দেখি। যেখানে ময়লার গাড়িগুলো রাতে চলাফেরা করবে। ভবন কোড মেনে ভবন নির্মাণ হবে। অ্যাম্বুলেন্স চলাফেরার জরুরি লেন থাকবে। বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা থাকবে। প্রশস্ত পার্ক থাকবে। দূষণমুক্ত থাকবে পরিবেশ। এক স্থানে আগুন লাগলে তার ধারাবাহিকতা থাকবে না। এছাড়া রাজধানী ঢাকা হবে একটি পরিচ্ছন্ন এবং নিরাপদ শহর। ছিনতাই, চাঁদাবাজি থাকবে না।

লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ