লেখক, লেখনী, স্বাধীনতা

মাহমুদুর রহমানইতালির লেখক রবার্টো কাবানিও মুক্তচিন্তার মূল্য হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছেন। মাফিয়ার কৃতকর্ম প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক পরিচিতি পেয়েছেন ঠিকই। হারিয়েছেন মনের শান্তি, রাতের নিদ্রা। ব্যক্তিগত দেহরক্ষী ছাড়াও, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বলয় এবং দুদিন অন্তর পরিবর্তনশীল বাসস্থানে জীবনযাপন করেন।
তিনি যে সত্য তুলে ধরেছেন তার মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়া চালু হলেও স্বয়ং সেদেশের প্রধানমন্ত্রীর তিরস্কারের শিকার হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, তার লেখনী ইতালির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। কাবানিও পিছপা হন নি। তার সাম্প্রতিক বইয়ের বিষয় হলো মাদক ব্যবসায়ীদের কুকর্ম নিয়ে।
অবৈধ ব্যবসার কাছে রাষ্ট্র কত অসহায়, কারবানিওর উদাহরণ তাই প্রমাণ করে। ভাবমূর্তি বড় না জনগণের কল্যাণ বড় তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। দেশের প্রকাশকরা হা-পিত্তেশ করছেন ভাব সমৃদ্ধ কবিতার অভাবে। তারা বলতে চাইছেন যে নব্বই দশকের স্বৈরাচারবিরোধী উত্তাল দিনগুলোতে লেখা কবিতার মতো সৃষ্টি তারা পাচ্ছেন না। কথাটি একপেশে সন্দেহ নেই। সমাজের অন্তর্নিহিত বিড়ম্বনা প্রকাশে অক্ষম অথবা অপারগ সংবাদমাধ্যম যা করতে পারেনি কবি-সাহিত্যকরা তাই করেছেন।
দেশাত্ববোধ আর গণতন্ত্রকামী মানুষের মুখপাত্র হয়ে তারা সৃষ্টি করেছিলেন। একথা যেমন ঠিক, সমাজদর্পণ, চলমান জীবনের নানা জটিলতা নিতেও লেখা পাঠক সমাদর পেয়েছে। তা না হলে আন্দোলনবিহীন সময়ে কোনও সাহিত্য রচনা হতো না।
সামাজিক অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরা প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের প্রথম দিককার লেখা প্রকাশকরা গ্রহণ করতেই চাননি কারণ তার অসাধারণ কাজ ছিল সময়ের চাইতে আগের। ড. আহমদ শরীফের সুপারিশের জোরেই তিনি প্রকাশিত হয়েছিলেন। তাছাড়া রবি ঠাকুরের সেই একটি পঙক্তি ‘শরৎ বাংলা জানে’ না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগদান শরৎচন্দ্রের আদৌ হত কিনা কে জানে।
দুইটি সত্যের সামনে আজ লেখক। পরিবর্তনশীল পাঠক পছন্দ আর চিন্তাশীল প্রয়াস। রাতারাতি লেখক হওয়া যায় না তবে লেখকের গড়ে তুলতে পরিবেশের প্রয়োজন। স্বনামধন্য লেখকদের সহচর্যে এসে বহু লেখক উপকৃত হয়েছেন। নিজেদের মধ্যে কথোপকথনের মাঝে গুণী রচয়িতরা তাদের সৃষ্টিকে ঘষে-মেজে শাণিত করেছেন। প্রকাশকরা তাদের লেখার সম্পাদনায় ছিলেন যত্নবান। কিন্তু আজ যেন সব কিছুতেই এক ধরনের ঢিলে-ঢালা ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নতুন পাঠাভ্যাস নিয়ে গবেষণা, লেখনির গভীরতা আর লেখার সীমারেখা নিয়ে কোনও গঠনমূলক ব্যবস্থা বা আয়োজন দেখা যাচ্ছে না। সর্বোপরি, মাত্রাধিক পুরস্কারের সাথে লেখক কর্মশালার প্রয়োজন অনেক বেশি।

রবার্টো কাবানিওর মুক্তচিন্তা ছিল সত্য উদঘাটনের মধ্য দিয়ে। তাতেই সে প্রাণ ভয়ে স্বেচ্ছায় সমাজত্যাগী। মতামত প্রকাশকের স্বাগত জানাতেই হবে তবে কটাক্ষ নয়, বিদ্রুপ নয়। সহনশীলতা এক পেশে হয় না।

লেখক: কমিউনিকেশন বিশেষজ্ঞ