মাটি মানুষের নেতা আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের গল্প

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লিখিত কর্ণকুন্তি সংবাদ, খেলাফত শাসনব্যবস্থা, ফরাসি বিপ্লব, ভিয়েতনাম যুদ্ধের ইতিহাস, রামায়ণ, মহাভারত, পঞ্চপাণ্ডব, মহাত্মা গান্ধীর গল্প, শেক্সপিয়ার, হোমার, কিটস, ষোড়শ লুই, নেপোলিয়ন বোনাপার্টের সব গল্প পড়তেন একজন মাটি মানুষের নেতা এবং তার সন্তানকে শোনাতেন। এসব গল্প শুনে তাঁর সন্তান জিজ্ঞেস করেছিলেন, পঞ্চপাণ্ডব কেন পড়ছো? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, এখান থেকে চারটি বিষয় শেখা যায়, রাজনীতি, রাজ্য, ধর্ম এবং কূটনীতি। এই সন্তানটি হলেন আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের কনিষ্ঠ সন্তান আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ।

অশ্রুসিক্ত নয়নে, ভারী গলায়, কান্না চেপে বাবার স্মৃতি বয়ান করেন। বাবার কাছ থেকে পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত শোনা নানা গল্প এখনও তিনি বলতে পারেন। বাবাও তাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। রাতে দেরিতে বাসায় গেলে ঘুম থেকে উঠিয়ে ফল খাওয়াতেন। বাবার কাছ থেকে ১৯৬৯-এর গণ আন্দোলনের সময় স্কুলের বেতনের টাকা চেয়েছিলেন। তিনি ছেলেকে না দিয়ে টাকা দিয়েছিলেন রাজনৈতিক কর্মীকে। বাবা চেয়েছিলেন তিনি একজন সামরিক কর্মকর্তা হবেন। এজন্য ভারতে যাওয়ার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতিও শেষ হয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস তিনি আর যেতে পারেননি। বিশাল মনের অসাম্প্রদায়িক এবং সংস্কৃতিমনা এই মানুষটি ১৩২৭ সনের ১৪ চৈত্র বাংলা এবং ১৯২১ সালের ২৮ মার্চ বরিশাল জেলার আগৈলঝড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তারা ছিলেন দুই ভাই, এক বোন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল খালেক সেরনিয়াবাত এবং মাতার নাম বেগম হুরুন্নেছা। তাঁর বাবা ছিলেন গৈলা ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। তিনি ছয় কন্যা এবং তিন পুত্রসন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম আমেনা বেগম হেলেন। যিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেজো বোন। আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বরিশালের গৌরনদীর চাঁদশী হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পাস করেন। বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ থেকে এইচএসসি উত্তীর্ণ হন। উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়েন, থাকতেন বেকার হোস্টেলে। এই কলেজে তরুণ শেখ মুজিবুর রহমানকে সহপাঠী হিসেবে পান। তখন বেকার হোস্টেলের প্রভোস্ট প্রখ্যাত দার্শনিক অধ্যাপক সাইদুর রহমানের সান্নিধ্য তিনি লাভ করেন। কলকাতায় স্নাতক সম্পন্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন শাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। লেখাপড়া শেষ করে তিনি তার নিজ জেলায়  ফিরে যান এবং আইন পেশায় যুক্ত হন।

রবীন্দ্র নজরুলজয়ন্তীতে তার বাড়িতে খ্যাতনামা শিল্পীদের নিয়ে গানের আসর বসাতেন। পাকিস্তানি শাসনামলে যখন বাঙালি সংস্কৃতিকে নিবৃত্ত করতে চাইছিল, সেই ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে ১৯৬৭-এর নভেম্বরে তিনি এবং আরও কয়েকজন মিলে প্রান্তিক সংগীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। যেটি এখনও বরিশালে সংগীত সাধনায় নিয়োজিত আছে। তিনি পুত্র-কন্যাকে নিয়ে প্রভাতফেরিতে যেতেন। আইয়ুব শাহীর কালো দশকে তাঁর কন্যা আরজু সেরনিয়াবাতের সাহসী নেতৃত্ব তারই অনুপ্রেরণার ফল।

সংস্কৃতিমনা এই মানুষটি ৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯ সালে জাতীয় সংহতি দিবসে বরিশালে সাংস্কৃতিক মঞ্চে বন্ধু সুরেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের কন্যাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘তোরা গান গাইবি স্বাধীন বাংলাদেশের রেডিও টিভিতে ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। পাকিস্তানিদের অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার প্রয়োজন নেই– এই কথাগুলো বলে স্মৃতিচারণ করেন মৃদুলা ভট্টাচার্য। তাঁর স্মৃতিতে দেখা যায়, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত তাদের কাছে একটি গান শুনতে চাইতেন সেটি হলো- ‘দিয়ে গেনু বসন্তের এই গান খানি’ গানটি।  বসন্তের পর বসন্ত আসে কিন্তু আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের স্মৃতি পড়ে থাকে বরিশালের দুর্গাসাগরে, যেখানে বসে তিনি মাছ ধরতেন। স্মৃতি জাগানিয়া কত স্মৃতি তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীদের। এই মানুষটির রাজনীতি, সাংবাদিকতায় অবদান জনসম্মুখে তার কাজের কথা প্রতিফলিত হয়েছে খুবই কম। কিন্তু তার সাথে চলা মানুষগুলো তাকে মনের মুকুরে রেখে দিয়েছেন। এখনও তার কথা মনে করে আবেগাপ্লুত হন।

ষাটের দশকে বরিশালে আইনজীবী সমিতিতে যোগ দেন এবং আইন পেশায় নিয়োজিত হন। তিনি বরিশাল জেলা সাংবাদিক সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং বরিশাল প্রেস ক্লাবের শীর্ষস্থানীয় নীতিনির্ধারক সদস্য ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে তিনি দ্য অবজারভার, দৈনিক পাকিস্তান ও সংবাদ সংস্থা ইউপিপির বরিশাল প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে রাজাপুর, বাকেরগঞ্জ, গৌরনদী, উজিরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে কলেরা বসন্ত রোগ মহামারি আকার ধারণের রিপোর্ট প্রকাশ করেন। উক্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে দৈনিক হেরাল্ড পত্রিকায় একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হলে সরকারের টনক নড়ে। ১৯৬৫ সালের পটুয়াখালী, ভোলা এলাকার মহাপ্রলয়ংকরী বন্যার রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে লন্ডন টাইমস, ডেইলি টেলিগ্রাফসহ বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে। দেশ-বিদেশ থেকে আসে সাহায্য-সহযোগিতা। এছাড়া পাকিস্তান আমলে আবু হোসেন সরকারের ভাঙ্গা যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা চলাকালীন দুর্ভিক্ষের রিপোর্ট দুর্ভিক্ষ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক শক্তিরূপে কাজ করেন।

১৯৫০ সালে বরিশাল জেলার বিভিন্ন স্থানে সংগঠিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী স্কোয়াড গঠন করে সাহসিকতার সঙ্গে সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানোর ফলে গৌরনদীতে কোনও দাঙ্গা হয়নি এবং ১৯৬৪ সালেও তিনি একই ভূমিকা পালন করেছিলেন। বেশ কয়েকবার নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৯৫১ থেকে ১৯৫২ সালের মধ্যে বরিশালে ‘আনছার সমিতির’ নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে হাঁস মার্কা প্রতীকে নির্বাচন করেন। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি হলেও তার দলের কাজ কেউ দমিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি চমৎকার লিফলেট ও প্রচারপত্র বিতরণ করেন। বরিশালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন পথিকৃৎ। আইয়ুব খানের সামরিক আইনের বিরোধিতা করে দেশবরেণ্য নয় জন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন। বরিশালে তিনি একটি বিবৃতিতে রাজনৈতিক নেতাদের স্বাক্ষর নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশ করেন।  ১৯৬২, ১৯৬৬ এবং ১৯৬৭ সালে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৬২-এর আন্দোলনে কারাভোগ করেন। ১৯৬৭ সালে বরিশালের স্থানীয় সমস্যা নিয়ে  ‘রেট পেয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন’ বা কর দাতা সমিতি গঠন করেন।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুথানের সময় ‘জাতীয় মুক্তি জোট’ গঠন করে প্রচারপত্র লিখে গ্রামে গ্রামে বিলি করতেন। ১৯৬৬ এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নির্বাচনি এলাকায় নৌকা দিয়ে ঘুরতেন। খেতেন আলু ভর্তা এবং ডাল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিজ এলাকা থেকে জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন।  ১৯৭০ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও শহর শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা গৌরনদীতে তারবার্তার মাধ্যমে তিনিই সর্বপ্রথম লাভ করেন।

১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ  গৌরনদীতে তার উদ্যোগে গঠিত হয় সংগ্রাম পরিষদ। এই পরিষদের প্রতিরক্ষা প্রধান ছিলেন তিনি। ২৬ মার্চ, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বরিশালে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সচিবালয় গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক সদর গার্লস স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। কিছুদিন পর ভারতে যান। তিনি প্রবাসী সরকারের দক্ষিণাঞ্চলের সমন্বয়কারী ছিলেন। কলকাতার শিয়ালদহে শ্রী নিকেতন হোটেলে ছিল তাঁর দফতর। সেখান থেকে তিনি শরণার্থীদের সাহায্য এবং দেখাশোনা করতেন। মন্ত্রিসভার সদস্য হওয়ার পর মুরুব্বিদের কার্ড দিয়ে আমন্ত্রণ জানান। শপথ গ্রহণের পর ওই দিন রাতে মুরুব্বিদের বাড়ি গিয়ে পায়ের ধুলো নিয়েছেন। তিনি কৃষক লীগ গঠনের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।  ১৯৭২ সালে তিনি ছিলেন ভূমি প্রশাসন এবং ভূমি রাজস্বমন্ত্রী। ১৯৭৩-এ কসবা থেকে সাড়ে পাঁচ মাইল হেঁটে আগৈলঝড়া বাসাইলে মিটিংয়ে গিয়েছেন। ফিরেছেন পায়ে হেঁটে। ১৯৭৩ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের অবিভক্ত গৌরনদী আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালের ৮ জুলাই তিনি বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানিসম্পদ ও বিদ্যুৎমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করেন। ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষের সময় তিনি ইরি চাষের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং পর্যাপ্ত পাওয়ার পাম্পের ব্যবস্থা করেন। তিনি বন্ধকি আইন করেছিলেন। বরিশালের হিজলা, মুলাদীখণ্ড, লড়াইপুর ও খাগড়ায় প্রচুর খাসজমি বিতরণ করেছেন ভূমিহীন কৃষকদের। মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। এই পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত দোতলায় একটি পাবলিক লাইব্রেরি এবং তিনতলায় একটি রেস্ট হাউজ নিয়ে স্মৃতি সংরক্ষণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।

গৌরনদী প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি জহুরুল ইসলাম জহিরের স্মৃতিকথায় দেখা যায়, ‘ভূমিমন্ত্রী থাকাকালে তার উদ্যোগে কৃষকদের ঋণের বোঝা থেকে মুক্ত করার জন্য এসএসএন্ডটি অ্যাক্ট সংশোধন করেন তিনি। নতুন চরকে সরকারি খাস জমি হিসেবে গণ্য করার আইন প্রণয়নে তার ভূমিকা ছিল অনন্য। খাস জমি বণ্টনেও নীতিমালা প্রণয়ন করেন। ভারতের সঙ্গে গঙ্গা নদীর পানিবণ্টনের ২৫ বছর মেয়াদি ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদনেও তার ভূমিকা ছিল। তিনি বরিশালে ধান উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে  ‘বরিশাল সেচ প্রকল্প’ গঠন করেন। বরিশাল নগরীর কাউনিয়া বিসিকে প্রতিষ্ঠিত করেন বরিশাল টেক্সটাইল মিলস। বরিশালের বাবুগঞ্জের মাধবপাশায় দুর্গাসাগর দীঘি পুনঃখননের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বরিশালের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। বরিশালের বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের জন্য বার্জ মাউন্টেড বিদ্যুৎকেন্দ্র সংস্থাপন করেন। সাতলা-বাগদা এলাকায় জলাবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করেন। তিনি গৈলায় হাসপাতাল, গৌরনদীতে বন বিভাগ, ওয়াপদার উপ-বিভাগ স্থাপন করেন। তিনি গৌরনদীর আপৎকালীন একটি জেনারেটর স্থাপন করেন। এমনকি বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রিসভার সব সদস্যকে ঢাকায় ১০ কাঠা করে জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে তিনি কোনও জমি নেননি।

আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সম্পর্কে তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীদের  অনেকের স্মৃতিকথা রয়েছে। তার মধ্যে টেমার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মহেন্দ্র সরকার তাঁর স্মৃতিকথায় বলেন, ১৯৭১-এর সময় আব্দুর রব সেরনিয়াবাত  তাকে দিয়ে গোয়েন্দাগিরি করাতেন। তিনি যখন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তখন তিনি ঢাকা থেকে খবর নিতেন। তখনও গোয়েন্দার কাজ করতেন। আব্দুর রব সেরনিয়াবাতকে তিনি একদিন একটি চিঠি দিয়েছিলেন, তার উত্তরে সেরনিয়াবাত লিখেছিলেন, ‘প্রিয় মহেন্দ্র, তোর চিঠি পেয়েছি। আশা করি কুশলে আছো। কিন্তু যাদের জন্য কিছু করা দরকার তাদের জন্য এখন পর্যন্ত কিছু করতে পারিনি। যাদের জন্য কিছু দরকার না, তাদের ধাক্কাই সামলাতে পারি না। তিনি মন্ত্রী হওয়ার পর যখন তার কাছে ঢাকায় গিয়ে দেখা করি তখন তিনি আমাদের বলেছিলেন, ‘সব এসে শহরে ওঠ? গ্রামে যাও গ্রামে। চাকরির জন্য শহরে আসতে হয় না। বাড়ি বসে পাবা। তখন তিনি আবার বলেন, গ্রামে গিয়ে জঙ্গল ছাপ করো।’ দোয়া করিস, যাদের চোখের জল এখনও ঝরছে তাদের জন্য যেন কিছু করে যেতে পারি। এই চিঠিটি মহেন্দ্র সরকার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সংরক্ষণ করেছেন।

বরিশালের বিশিষ্ট সাংবাদিক সুধীর সেন তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন, ‘১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আমার বাসার সবকিছু লুটপাট হওয়ায় সব খোয়া গিয়েছে। এখন শুধু অবশিষ্ট আছে যুদ্ধকালীন মুজিব নগরে বসে আমাকে তার দেওয়া একখানা প্রশংসাপত্র। আর আছে আমাকে তার দেওয়া হলুদ রঙের একটি শেরওয়ানি কোট। ছিঁড়ে গিয়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে গেলেও আমি তা যত্নে ট্রাঙ্কে রেখে দিয়েছি।’

তিনি ছিলেন একজন নির্ভীক মানুষ। তার বাবার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করায় তৎকালীন এক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি। পরবর্তীকালে মামলার রায়ে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা কারাবাসের রায় হয়। পাকিস্তান আমলে এই ঘটনাটি তার সাহসিকতার অন্যতম দৃষ্টান্ত।

তিনি খুব সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। তাঁর স্ত্রী এক স্মৃতিচারণে বলেন, বড় পানসী নৌকায় করে আমি গোপালগঞ্জ থেকে শ্বশুরবাড়ি আসি। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের এক আদর্শবান মানুষের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। তখন আমার বয়স সতেরো। আমার স্বামী কলকাতা লেখাপড়া করতেন বলে কলকাতায় যেতে হয়। ১৪নং পার্ক স্ট্রিটে বাসা নিই আমরা। কলকাতায় জন্ম হয় আমার মেয়ে শামসুন্নেছা আরজুর।’

আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ছেলে আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর  স্ত্রী শাহানারা আবদুল্লাহ বলেন, কোর্ট থেকে ফিরে খাবারের পর আমাদের নিয়ে বিশ্রামে বসতেন। নজরুল অথবা রবীন্দ্রনাথের কবিতা বের করে দিয়ে পড়তে বলেন। আমরা পড়তাম, তিনি অর্থ বুঝিয়ে দিতেন-সেই সাথে কোন পরিস্থিতিতে  কবিতাটি লেখা হয়েছিল তাও শোনাতেন। শহীদ দিবস এবং গণ অভ্যুত্থানের মিছিলে আমাকে সাথে নিতেন। তিনি অপচয় সহ্য করতে পারতেন না। মিন্টু রোডে মন্ত্রী থাকাকালীন পরিবারের কিছু সদস্য ব্যাডমিন্টন খেলার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি বাসায় ফিরে এগুলো দেখে খুলে ফেলেছিলেন সব লাইটবোর্ড। বলেছিলেন বিদ্যুতের অপচয় করে আনন্দ করার কিছু নেই। অপচয়ের খেসারত দিতে হবে। তা যেদিনই হোক’। কেউ যদি অর্থনৈতিক কারণে লেখাপড়া করতে অসমর্থ হতো, তাকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে লেখাপড়া করায় সাহায্য করতেন। ১৪ আগস্ট, ১৯৭৫ দাদি-শাশুড়ির মৃত্যুবার্ষিকীর মিলাদ পড়ানোর জন্য বরিশালে আয়োজন করা হয়। প্রতিবছর তাই হয়। সব গোছানোও হয়েছিল। কিন্তু ১৩ আগস্ট আমার শ্বশুর এসে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটি দল আসবে। তাকে ঢাকা থাকতে হবে।  সেজন্য আর বরিশাল যাওয়া হয়নি। পরবর্তীকালে জানা গিয়েছিল, এটি ছিল ষড়যন্ত্রের একটি অংশ’।

আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের মেজো মেয়ে হুরুন্নেসা মঞ্জুর স্মৃতিচারণে দেখা যায়, তাঁর বাবা তাকে গান শোনাতেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে’। প্রথম সন্তানের নাম সুজন তাঁর বাবা রেখেছেন। সুজনকে তিনি ভীষণ স্নেহ করতেন। গান গাইতেন, ‘সুজন মাঝিরে কোন ঘাটে লাগাইয়া তোর নাও। নাতিকে সকালে বিকালে বলতেন, হ্যালো সুজন এবং আরও অনেক কথা। শেষ দেখা হয়েছিল বাবার সঙ্গে ১৪ আগস্ট, ১৯৭৫। বাবা তাকে বলেছিলেন, ‘তোমার কি যাওয়া খুব দরকার?’

এটিই ছিল বাবার সাথে শেষ কথা। তাঁর কথা– সেদিন যদি থেকে যেতেন, তাহলে বাবার সাথে চলে যেতে পারতেন। এতটা বছর বাবা এবং স্বজন হারানোর বেদনা সইতে হতো না। তিনি বলেন, গর্বিত আমি আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের মতো একজন সৎ রাজনীতিবিদের সন্তান।

আবদুর রব সেরনিয়াবাতের কন্যা হামিদা সেরনিয়াবাত বিউটি বলেন, আব্বা ছিলেন ভীষণ স্নেহপ্রবণ। কখনও উচ্চস্বরে বকেননি আমাদের। সরাসরি রাজনীতি নিয়ে কখনও কথা বলেননি। অনেক বড় সংসার ছিল আমাদের। বাড়িতে লোকজনের ভিড় লেগেই থাকতো। আব্বার আয়ের বেশিরভাগ অংশ মানুষের সাহায্যের পেছনে চলে যেত। মায়ের সাথে কখনও জোরে কথা বলতে দেখিনি। চোখের সামনেই তাঁর বাবাকে হত্যা করা হয়। একজন আব্বাকে বললেন, আপনি কি রব সেরনিয়াবাত? আব্বা ‘হ্যাঁ’ বলে জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের কমান্ডিং অফিসার কে? তারা কোনও উত্তর না দিয়ে ব্রাশফায়ার শুরু করলো। পেট থেকে  সাতটা গুলি, শরীর থেকে ৪টা বের করা হয়। এখন খুঁড়িয়েই হাঁটেন। একটা পায়ে ভর দিয়ে হাঁটেন। তিনি বলেন, ১৯৭১ এর গ্রামের সেরালের বাড়িটি পুড়িয়ে দিয়েছে। বরিশালের তাদের কালিবাড়িতে রাজাকাররা ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। ১৯৭৫-এর দিকে তাদের বাড়ি আবার লুটতরাজ হয়। তাদের বাড়িটি সিল করে রাখা হয় ১৯৭৯ সালে। তিনি এবং তার পরিবারের আহত সবাই তিন মাস হাসপাতালে থেকে ৩১ অক্টোবর, ১৯৭৫-এর দিকে বঙ্গবন্ধুর ছোট বোন খাদিজা হোসেন লিলির বাসার যান। কিন্তু এখান থেকে চলে যান তার বোন পুরান ঢাকায় হুরুন্নেসা মঞ্জুর বাসায়। সেখান থেকে প্রাণরক্ষায় পালিয়ে যান ভারতে। কারণ, তাদের পাসপোর্ট আটকে রাখা হয়েছিল। তাছাড়া তার শরীরে গুলির আঘাত এত বেশি ছিল যে বাংলাদেশে চিকিৎসা শেষ পর্যায়ে ছিল। তিনি শুকনো কিছু স্পর্শ করতে পারতেন না। মনে হতো আগুন জ্বলে উঠবে। ঘর অন্ধকার করে পানি কাছে নিয়ে রাখতেন। একপর্যায়ে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন তাকে মনোবিজ্ঞানীর কাছে নেওয়া হয়। এখনও তিনি খুঁড়িয়ে হাঁটেন। তাঁর দুই ভাইবোন খোকন আবদুল্লাহ এবং রীনা সেরনিয়াবাতও দুটি করে গুলিতে আক্রান্ত হন। তার সামনে ভাই আরিফ, বোন বেবী ও ভাতিজা সুকান্তকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হাসপাতালে তিন মাস মানুষের দেওয়া পুরনো কাপড় পরিধান করেছেন। পারিবারিক স্মৃতিচিহ্ন বলে কিছুই নেই তাদের। সেই বিভীষিকার কথা মনে পড়লে এখনও তিনি শিউরে ওঠেন।

আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের আরেক কন্যা শিউলী সেরনিয়াবাতকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার কমান্ডার রশিদুল আলমের কাছে পাত্রস্থ করেছিলেন। তিনি তাঁর বাবার মৃত্যুর খবর পান রেডিওতে এবং সংবাদ পেয়ে জ্ঞান হারান।

আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহর (জাতীয় সংসদ সদস্য) কন্যা  আঞ্জুমান আবদুল্লাহ কান্তা তার দাদার স্মৃতি এখনও মনে করতে পারেন। তার দাদা যখন ধানমন্ডি লেকে মাছ ধরতে যেতেন, তিনি বায়না ধরতেন বলে মিন্টো রোডের বাসার উঠোনে ছোট চৌবাচ্চা করে যেন মাছ ছেড়ে দেওয়া হয়। তার দাদা তাকে বলতেন, রাগ হলে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকবে এবং এক গ্লাস পানি পান করবে। এখনও তিনি সেই বিভীষিকা মনে করলে রাতে ঘুমাতে পারেন না এবং  ভয়াল সময়ের কথা মনে করে অশ্রুসিক্ত  হন।

এই মানুষটি এক মালাই নৌকা করে নির্বাচনি প্রচারণা করতেন। ১৯৭০ সালে আন্দোলন সংগ্রামে একত্রিত করতে গিয়ে কলাপাতা ছিঁড়ে তাতে ভাত খেয়েছেন । সবাইকে সঙ্গে নিয়ে মাঝিকে খেতে দিয়েছেন থালায়। ৭/৮ বছরের একটি এতিম শিশু পোটকাকে তার  বাসায় এনেছিলেন, বাসার সদস্যদের বলতেন, পোটকাকে দিয়ে কোনও কাজ করানো যাবে না। সে এখন শিশু,তার খেলার সময়। বাসার কাজের সহকারীরা তাকে বলতো আব্বা। বিদ্যুৎমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর, তিনি দেশের সব গ্রামকে আলোকিত করতে চেয়েছিলেন। সেই মানুষটির জীবনের আলো নিভে যায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। তাঁর সাথে নিভে যায় সন্তান আরজু সেরনিয়াবাত, যে কিনা ভাত মেখে রাখতেন মেয়ে কলেজ থেকে এসে খাবেন তাই। সঙ্গে আদরের ছেলে আরিফ আব্দুল্লাহ সেরনিয়াবাত, মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত এবং নাতি সুকান্ত আবদুল্লাহ এবং তার বাসার কাজের সহকারী লক্ষ্মীর মা, অনাথ পোটকার জীবন। তার হত্যাকাণ্ডের সময় ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সকালে রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে পালিয়ে গিয়ে বাসার হামলার খবর জানান আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ছেলে আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ। যিনি কোনোরকমে পালিয়ে বেঁচেছিলেন। সেই শেখ আনোয়ার হোসেন মিন্টো রোডে এসে দেখেন রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। পরে তিনি আহতদের আশ্বস্ত করেন, আমি আপনাদের বাঁচাবো। থানার দুটি  প্রিজন ভ্যানে করে তিনি আহতদের ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে নিয়ে যান। তার এই সাহসিকতায় বেঁচে যান আহত বেগম আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, বেগম শাহানারা আব্দুল্লাহ,হামিদা সেরনিয়াবাত বিউটি, আবুল খায়ের আবদুল্লাহ, হেনা সেরনিয়াবাত, রফিকুল ইসলাম, খ.ম. জিল্লুর রহমান, ললিত দাস ও সৈয়দ মাহমুদ। তিনি তাদের বাঁচিয়েছিলেন বলে তাকে প্রথমে ডাকা হয়, এরপর মানিকগঞ্জে বদলি করা হয় এবং নানা ধরনের অসুবিধায় তাকে পড়তে হয়। গৌরনদী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি কালিয়া দমন গুহের স্মৃতিকথায় দেখা যায়, ১৯৭০-এর নির্বাচনে বাগদার একটি গ্রামে তার নৌকা ভিড়লে এক বৃদ্ধ তাকে বাবা বলে জড়িয়ে ধরেন এবং তার বাড়িতে খাবারের ব্যবস্থা করেন। পকেটে টাকা না থাকায় সেই বৃদ্ধই একশো টাকা হাতে দিয়ে দেন। এই হলো আব্দুর রব সেরনিয়াবাত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, জাতি হারিয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে, হারিয়েছে বঙ্গবন্ধুর সহপাঠী কৃষক নেতা আব্দুর রব সেরনিয়াবাতকে। এরকম জ্ঞানী গুণী রাজনীতিবিদ মানুষ এই পৃথিবীতে একবার আসেন। যাদের ধ্যান-ধারণায় থাকে দেশ। বঙ্গবন্ধুও প্রচুর বই পড়তেন। আব্দুর রব সেরনিয়াবাতও তাই। তিনি ছিলেন মিতব্যয়ী, মিতভাষী, অধ্যবসায়ী, পরিশ্রমী, সৎ এবং দেশপ্রেমিক।

প্রখ্যাত রাজনীতিবিদদের জীবনীতে দেখা যায়, পৃথিবীতে যারা রাজনীতি করে বিখ্যাত হয়েছেন, তারা প্রত্যেকে প্রচুর লেখাপড়া করতেন। বই থেকে গ্রহণ করতেন রাজনৈতিক নির্যাস। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের গান ‘মহাবিশ্বের মহাকাশে মহাকাল - মাঝে, আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে’ গানটি ছিল যার প্রিয়। যার ছিল সাজানো গোছানো পরিপাটি একটি ফুলের মতো সংসার। সেই সংসারে সন্তান-সন্ততি নিয়ে ছিল সুখের রাজ্য। সে রাজ্যের রানি পানসী নৌকায় চড়ে বাইগার নদী থেকে ভাসতে ভাসতে কীর্তনখোলায়, সেখান থেকে ভাসতে ভাসতে বুড়িগঙ্গা নদীতে এসে তাঁর জীবনের নোঙ্গর ফেলেন। সে নদীতে সাদা বকপাখির মতো তাঁর ছানাদের নিয়ে সুখের ডানা ঝাঁপটাতে চেয়েছিলেন, সে রানি এক পলকে তাঁর স্বামী, ভাই, সন্তান, নাতিকে হারিয়ে হয়ে যান এক অসহায় পাখি। বেঁচে থাকেন বুকে বুলেটের ক্ষত নিয়ে। আর জীবদ্দশায় বিস্মিত হতেন, এত ক্ষত নিয়ে কি করে বেঁচে আছেন। তাই তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘কখনোই ভাবিনি তাঁর মৃত্যুর পর আমি এতদিন বেঁচে থাকবো। তাকে ছাড়া কি করে বেঁচে আছি ভাবলে অবাক হই, নিজেকে নিষ্ঠুর মনে হয়।’ জীবদ্দশায় তার এই হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাসই ছিল সম্বল। এ যেন মহাপ্রলয়ংকরী জলোচ্ছা¦স। এক নিমিষে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন । ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে জীবন। সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কতটুকু পেরেছেন। রোগেশোকে কাতর হয়ে একপর্যায়ে তিনি পারকিনসনসে আক্রান্ত হন। ছোট ছেলে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহর বাসা ঢাকার ধানমন্ডিতে  ২৪ মার্চ ,২০০৫ সালে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের স্ত্রী দুনিয়ার মায়া ছেড়ে চলে যান। আপনজনদের সাথে বনানী গোরস্থানে তিনি এখন শুয়ে আছেন। শেষ হয় জীবনের একটি অধ্যায়।

আব্দুর রব সেরনিয়াবাতকে বরিশালবাসী বিভিন্ন স্থাপনায় তার নাম যুক্ত করে তাকে সম্মানিত করেছেন। কিন্তু প্রথিতযশা মহৎ এই নেতাকে জাতীয়ভাবে তুলে আনা সময়ের দাবি। পরবর্তী প্রজন্ম যেন শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে এজন্য তার জীবনকর্ম সবার সামনে তুলে আনা প্রয়োজন। আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বরিশালের দুর্গাসাগরে মাচায় বসে ছিপ ফেলে মাছ শিকার করতেন। সেখানটায় এখন তিনি যান না। যান অন্য কেউ কিন্তু তার নাম রয়ে গিয়েছে। আব্দুর রব সেরনিয়াবাত গেট এই নামে। আব্দুর রব সেরনিয়াবাত মন্ত্রী হিসেবে একটি নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয় পরিচালনা করার জন্য দায়িত্ব পেয়েছিলেন। তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন, কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি।  তার সন্তানদের তিনি যা বলে গিয়েছেন,সেটিই পালন করে গিয়েছেন জীবদ্দশায়। সন্তানেরা তাঁর একটি উক্তি এখনও মনে রেখেছেন  - ‘যদি কোনও ব্যক্তির চরিত্র দেখতে চাও,তাকে ক্ষমতা দিয়ে দেখ’। আজ ১৫ আগস্টে, স্মরণ করছি সাদামাটা মানুষ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতকে।

লেখক: অধ্যাপক, লোক-প্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

 

তথ্যসূত্র

১.   মাসিক আনন্দলিখন (১৯৯৭)  ২য় বর্ষ: ২য় সংখ্যা,এপ্রিল, বরিশাল বাংলাদেশ

২.   মাসিক আনন্দলিখন (২০১৪) সৈয়দ দুলাল সম্পাদিত,আগস্ট, সিয়াম প্রেস: বরিশাল।

৩.   আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের কন্যা,হুরুন্নেছা, হেনা সেরনিয়াবাত এবং হামিদা সেরনিয়াবাতের সাক্ষাৎকার।

৪.   বঙ্গবন্ধুর বড় বোনের মেয়ে  শেখ রেবা রহমানের সাক্ষাৎকার।

৫.   আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের পুত্র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকনের সাক্ষাৎকার।

৬.   সাংবাদিক আনিসুর রহমান স্বপনের তথ্য প্রদানকারী ।

৭.   ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সেরনিয়াতের বাড়িতে আহত খ. ম. জিল্লুর রহমানের সাক্ষাৎকার।

৮. রমনা থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ আনোয়ার হোসেনের সন্তান শেখ নুরুল হাসানের সাক্ষাৎকার।

৯.   ‘আমাদের বাড়িতে যেভাবে হত্যাকান্ড চালানো হলো’, হামিদা সেরনিয়াবাত, দৈনিক ভোরের কাগজ, ১৫, ১৬, ১৮ আগস্ট, ১৯৯৪ ইং

১০. আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের নাতনি আঞ্জুমান আব্দুল্লাহ কান্তার সাক্ষাৎকার।

১১. আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের রাজনৈতিক সেক্রেটারি সোবহান মাসুদের ছেলে হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার।

১২. আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ভাইয়ের মেয়ে হাসিনা বেগম লিয়ার সাক্ষাৎকার।

১৩. মহিউদ্দিন আহমেদ মানিক,বীর প্রতীকের সাক্ষাৎকার