মানি; তবে, যদি, কিন্তু...

সাম্প্রদায়িক শক্তির কৌশলটা অনেক পুরনো। যখনই তাদের যুক্তি ফুরিয়ে যায়, তারা একটু চুপ থাকে, অল্প সময়ের জন্য হলেও গর্তে লুকিয়ে থাকে। তারপর বেরিয়ে আসে নতুন উদ্যমে নানান কুযুক্তি নিয়ে, যুক্তি বা কুযুক্তি কিছুই না পেলে অকথ্য ভাষায় গালাগাল, আর তাতেও না কুলালে চাপাতি তাদের শেষ অবলম্বন।

একাত্তর সালে এই অপশক্তি ধর্মের নামে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে মিলে স্বাধীনতাকামী মানুষদের হত্যা করেছে। কিন্তু বিজয় অর্জনের পর এই অপশক্তি গর্তে লুকিয়ে যায়। স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মকে পুঁজি করে রাজনীতি করার সুবিধা ছিল না। তাই তারা আড়ালে থেকে আত্মরক্ষায় ব্যস্ত ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খন্দকার মুশতাকের নেতৃত্বে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এই সুযোগে হুক্কা-হুয়া দিয়ে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে দেশবিরোধী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। জিয়াউর রহমানের আমলে এই ধারা আরও শক্তিশালী হয়। এমনকি স্বাধীনতাবিরোধীরা প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত হয়ে যান। আর অবাধ রাজনীতি করার সুযোগ পেয়ে মাঠে নেমে পড়ে ধর্মভিত্তিক দলগুলো। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে অন্য দলগুলোর সঙ্গে মাঠে থেকে নিজেদের গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে প্রমাণেরও চেষ্টা চালায়।

তবে স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক শক্তি আবার বিপদে পড়ে ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর। জাতির কলঙ্ক মোচন করতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেন শেখ হাসিনা। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী  লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে অন্যতম অঙ্গীকার ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এই উদ্যোগে সত্যিকারের বিপদে পড়ে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিটি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিপক্ষে অবস্থান নিলে জনরোষে পড়ার ভয়, আর পক্ষে থাকার তো সুযোগই নেই তাদের। তাই তারা প্রথম কিছু দিন চুপ করেছিল। আস্তে আস্তে তারা সরব হলো, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার মানি; তবে, যদি, কিন্তু ইত্যাদি ইত্যাদি নানান অজুহাত। বাংলাদেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা নিয়ে সাধারণভাবে কোনও প্রশ্ন নেই। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্ন আসতেই দাবি উঠলো, এই বিচার আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে। এমনকি যারা কর্নেল তাহেরকে সামরিক আদালতে ১৭ জুলাই রায় দিয়ে ২১ জুলাই কার্যকর করেছিল, তারাও বিচারের আন্তর্জাতিক মানের পক্ষে সরব হয়। আন্তর্জাতিক মানটা কী, সেটার ব্যাখ্যা অবশ্য তারা দেননি। অথচ যুদ্ধাপরাধীরাই বাংলাদেশে আইনের সর্বোচ্চ সুরক্ষা পেয়েছে। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে আপিল, রিভিউ, রাষ্ট্রপতির মার্জনার আবেদন- সব সুযোগই তারা পেয়েছে। কিন্তু তবু যুদ্ধাপরাধীদের সাগরেদরা নানা অজুহাতে বিচার বিঘ্নিত করার ষড়যন্ত্র চালায়। এই ষড়যন্ত্রে তারা আন্তর্জাতিক পক্ষকেও শামিল করে।

এই অপশক্তিটি আবার বিপাকে পড়ে ২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণের পর। কাদের মোল্লার লঘুদণ্ডের প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে সর্বস্তরের জনগণ। এই গণজাগরণের শুরুতেও তারা চুপ করে ছিল। আসলে এই গণজাগরণের কোনও জবাব তাদের কাছে ছিল না। একটু গুছিয়ে আবার তারা মাঠে নামে। এবার তারা মিডিয়ার একটি অংশ, কিছু বুদ্ধিজীবী এবং হেফাজতে ইসলামকে সামনে আনে। আর শাহবাগের অসাধারণ গণজাগরণকে চিত্রিত করার চেষ্টা হয় ‘নাস্তিক ব্লগার’দের আন্দোলন হিসেবে। গণজাগরণে লাখ লাখ লোক সমবেত হয়েছিল। ব্লগাররাই এই আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। সমবেতদের মধ্যে কেউ কেউ নাস্তিক থাকতেও পারেন। তবে বাস্তবে আন্দোলনটি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এক গণজাগরণ। সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে কোনও জবাব না থাকায় তারা একে হেয় করতে চেষ্টা করে, মাঠে নামায় হেফাজতে ইসলামকে। তারা মতিঝিলে অবস্থা নিয়ে তাণ্ডব চালায়।

এটাই তাদের কৌশল, আসলে অপকৌশল। যুক্তিতে না পারলে গালি, গালিতে না পারলে এই তাদের কৌশল। বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবেই অসাম্প্রদায়িক। যুগ যুগ ধরে এ অঞ্চলে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান- সবাই মিলে মিশে ধর্ম পালন করছে। ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ এই স্লোগানের মর্মবাণী না বুঝেই সাম্প্রদায়িক শক্তি ভুল বার্তা ছড়ায় সমাজে। ছেলেবেলা থেকেই আমরা দেখে আসছি সব ধর্মের মানুষ মিলে মিশে উৎসব পালন করছে। ধর্মীয় উৎসবে দুইটা অংশ- একটা ধর্মীয় আচার, আরেকটা উৎসব। ধরুন ঈদের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা, মানে নামাজ বা কোরবানির অংশ মুসলমানদের, কিন্তু ঈদের উৎসবটা সবার। আবার পূজার ধর্মীয় আচারটুকু হিন্দুদের, উৎসবটুকু সবার। ঈদের সেমাই, পূজার নাড়ু সবার ঘরেই পৌঁছে যায়। বৌদ্ধ পূর্ণিমায় আমরা সবাই ফানুস ওড়াই, বড়দিনে সান্তাক্লজের চকলেটের ভাগ সব ধর্মের শিশুরাই পায়। মুসলমানদের ঈদের উৎসবে যেমন সবাই শামিল হয়, আবার হিন্দুদের পূজার আনন্দেও সব ধর্মের মানুষ শামিল হয়। কিন্তু দুর্গাপূজায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় শুভেচ্ছা জানানোর সৌজন্য বহুদিনের। কিন্তু ইদানীং ফেসবুকে দেখছি, শারদীয় শুভেচ্ছার নিচেও অশ্লীল সব গালাগাল। মুসলমান কেউ পূজামণ্ডপে গেলেই এই অপশক্তিটি বলার চেষ্টা করে, হিন্দুরা কি কোরবানিতে আসবে? এই প্রশ্নটি যে কত সাম্প্রদায়িক এবং উসকানিমূলক, সেটা বোঝার মতো সংবেদনশীলতা তাদের নেই। এ ধরনের প্রশ্ন যদি অন্য ধর্মের কেউ তুলতো, তাহলে এই শক্তিটির ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতো এবং তারা ভাঙচুরে নেমে পড়তো। ইদানীং এই অপশক্তির ‘ধর্মীয় অনুভূতি’ও খুব টনটনে। ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে তারা নেমে পড়ে মাঠে। এবার সরকারের কঠোর নজরদারিতে এই শক্তিটি মাঠে নামার সুযোগ পায়নি।

সম্প্রতি বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় দেশজুড়ে উৎসবের জোয়ার বয়ে যায়। দেশের ফেরার পর তাদের ছাদখোলা বাসে নজিরবিহীন সংবর্ধনা দেওয়া হয়। প্রথম দুদিন এই অপশক্তিটি চুপ করে ছিল। তারপর তারা আস্তে আস্তে বলতে শুরু করে ইসলাম ধর্মে খেলাধুলা হারাম, নারীদের ফুটবল খেলার পোশাক ধর্মসম্মত নয় ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ যে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের নারীরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, সেই প্রতিযোগিতায় পাকিস্তানও ছিল। তাছাড়া ইরান, এমনকি সৌদি আরবের নারীরাও ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। কোথাও হিজাব বা বোরকা পরে ফুটবল খেলা হয় না। তারপর তারা বলতে শুরু করলো, এর আগেও তো আন্তর্জাতিক হিফজ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের অনেকে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, তাদের কেন ছাদখোলা বাসে সংবর্ধনা দেওয়া হলো না। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন মুখস্থ করার প্রতিযোগিতা আর ফুটবল খেলাকে যে এক পাল্লায় মাপা যায় না, মাপলে যে পবিত্র কোরআন শরিফকেই অবমাননা করা হয়, এটা ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে বোঝানো মুশকিল। এই গোষ্ঠীটি নগদে একটা সুযোগ পেয়ে যায়। নারীদের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার চারদিনের মাথায় সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক হিফজ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের শিশু সালেহ আহমেদ তাকরিম একটি ক্যাটাগরিতে তৃতীয় হয়েছে। প্রথমে গোষ্ঠীটি প্রচার করলো, ১১১টি দেশের ১৫৩ প্রতিযোগীর মধ্যে তাকরিম তৃতীয় হয়েছে। বাস্তবে প্রতিযোগিতায় চারটি ক্যাটাগরির মধ্যে চতুর্থ ক্যাটাগরিতে তৃতীয় হয়েছে তাকরিম।

যেকোনও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের যে কারও সাফল্য আমাকে গর্বিত করে। তাই আমিও তাকরিমকে অভিনন্দন জানিয়েছি। কিন্তু ধর্মান্ধ গোষ্ঠীটি শিশু তাকরিমের সাফল্যকে নারীদের সাফ জয়ের চেয়ে বড় করে দেখার চেষ্টায় মেতে ওঠে। চতুর্থ ক্যাটাগরিতে তৃতীয় হওয়া একটি শিশুকে দাবার ঘুঁটি করে তারা নারীদের অর্জনকে হেয় করার চেষ্টা করে। এতে যে তাকরিমকেই অপমান করা হয়, সেটা বোঝার মতো জ্ঞান তাদের নেই।

সম্প্রতি ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে ছাত্রলীগের এক নেত্রী কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে সেখানকার শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক অনৈতিক কাজে বাধ্য করার অভিযোগ আনেন। অভিযোগটি গুরুতর সন্দেহ নেই। এটি নিছক রাজনৈতিক অভিযোগ নয়। তাই সাংগঠনিক ব্যবস্থায় এটি নিষ্পত্তির সুযোগ নেই। এই অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার। অভিযোগ মিথ্যা হলে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে, সত্য হলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু ইডেন কলেজের এই অভিযোগকে পুঁজি করে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীটি নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে তাদের পুরনো অবস্থান নিয়ে সরব হয়। একই সঙ্গে ইডেন কলেজের এই অনির্দিষ্ট অভিযোগকে ঘিরে তারা বছরের পর বছর মাদ্রাসায় নির্যাতন আর যৌন নির্যাতনকে জায়েজ করার চেষ্টা করে। কিন্তু একটা অপরাধ কখনও আরেকটি অপরাধকে বৈধতা দেয় না। ইডেন কলেজের ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে যেমন ব্যবস্থা নিতে হবে, বন্ধ করতে হবে মাদ্রাসায় যৌন নির্যাতনও।

আগেই বলেছি, বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। এখানে সব ধর্মের মানুষের ধর্ম পালন করার অধিকার আছে। সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণের অধিকার আছে। তাই কোনও ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি যেন আমাদের সম্প্রীতির পরিবেশ নষ্ট করতে না পারে, সে ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। একটি উদার, মুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, যুক্তিবান্ধব সমাজ গঠনের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। অপশক্তিটি ‘যদি, কিন্তু, তবে’ নিয়ে মাঠে নামলেই তাদের জবাব দিতে হবে।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ