‘জাতীয় নেতা’র সংজ্ঞা ও বইমেলায় ‘আদর্শিক’ দ্বন্দ্ব

অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে এ বছর বাংলা একাডেমি যে নীতিমালা ঘোষণা করেছে, তার ১৪.১৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘অশ্লীল, রুচিগর্হিত, জাতীয় নেতৃবৃন্দের প্রতি কটাক্ষমূলক, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয় এমন বা জননিরাপত্তার জন্য বা অন্য যেকোনও কারণে বইমেলার পক্ষে ক্ষতিকর কোনও বই বা পত্রিকা বা অন্য কোনও দ্রব্য অমর একুশে বইমেলায় বিক্রি, প্রচার ও প্রদর্শন করা যাবে না। একাডেমি বা বইমেলা পরিচালনা কমিটি যদি বইমেলায় কোনও বই, ম্যাগাজিন, লিফলেট বা এ জাতীয় অন্য কোনও দ্রব্য বিশেষ কারণে বা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রচার বা প্রদর্শন বা বিক্রি করা বাঞ্ছনীয় বিবেচনা না করে তাহলে কোনও অংশগ্রহণকারী তা প্রদর্শন বা প্রচার বা বিক্রি করতে পারবেন না।’

কিন্তু দেখা গেলো এবার বইমেলা শুরুর আগেই আদর্শ প্রকাশনীর বিরুদ্ধে উপরোক্ত নীতিমালা ভঙ্গের অভিযোগে অমর একুশে বইমেলায় স্টল বরাদ্দ দেয়নি বাংলা একাডেমি। এমনকি যে বইটি নিয়ে একাডেমির আপত্তি, সেই বইটি মেলায় না রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও আদর্শকে স্টল না দেওয়ার সিদ্ধান্তে একাডেমি অনড়। শুধু তাই নয়, ওই বইটি কলকাতা বইমেলায় বিক্রি না করতেও আদর্শ প্রকাশনীকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি (প্রথম আলো, ৩০ জানুয়ারি ২০২৩)।

সঙ্গত কারণেই কয়েকটি প্রশ্ন সামনে আসছে। যেমন:

১. মেলা শুরুর আগেই, অর্থাৎ মেলায় বিক্রি শুরুর আগেই বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ কী করে জানলো যে আদর্শ প্রকাশনীর এক বা একাধিক বই তাদের নীতিমালা পরিপন্থি?

২. যে কনটেন্টের কারণে দৃশ্যত একটি বই (ফাহাম আব্দুস সালামের ‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’) এবং শোনা যাচ্ছে তার সঙ্গে আরও দুটি বই (জিয়া হাসানের ‘উন্নয়ন বিভ্রম’ এবং ফৈয়জ আহমদ তৈয়্যবের ‘অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবনীয় কথামালা’) নিয়ে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের আপত্তি—সেই ধরনের কনটেন্ট বা বিষয়ে এর আগে-পরে কি কোনও বই লিখিত হয়নি? এরকম বিষয়ে কোনও বই কি অন্য কোনও প্রকাশনীর স্টলে আগে ছিল বা এবারও নেই? তাহলে শুধু আদর্শ প্রকাশনী কেন টার্গেট?

৩. নীতিমালায় বলা হয়েছে জাতীয় নেতৃবৃন্দের প্রতি কটাক্ষমূলক কোনও বই মেলায় বিক্রি করা যাবে না। প্রশ্ন হলো, এখানে ‘জাতীয় নেতৃবৃন্দ’ বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে। তারা কারা এবং কোন কোন মানদণ্ডে তারা জাতীয় নেতা।

প্রয়াত এবং জীবিত উভয় শ্রেণির নেতারাই কি এর অন্তর্ভুক্ত? সব দলের বা আদর্শের সিনিয়র নেতারাই কি জাতীয় নেতা? জাতীয় নেতার সংজ্ঞা কী? কোন সময়কাল থেকে জাতীয় নেতাদের হিসাব করা হবে? ১৯৭১ পূর্ববর্তী না পরবর্তী নাকি ১৯৪৭ সাল থেকেই ধরা হবে। সেক্ষেত্রে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, এমনকি ১৯৭১ সালের পরে এ পর্যন্ত যারা দেশ শাসন করেছেন; গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান ছিলেন বা আছেন—তাদের সবাই কি জাতীয় নেতা? প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও কি জাতীয় নেতা এবং তার সমালোচনামূলক যে অসংখ্য বই আছে, সেগুলোও কি মেলায় বিক্রি নিষিদ্ধ? আরেক সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানও কি জাতীয় নেতা ছিলেন না? তার আমলের এবং তার কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে যেসব বই লিখিত হয়েছে, সেসব বইও কি মেলায় বিক্রি নিষিদ্ধ? এই সময়ে যারা ক্ষমতার বাইরে আছেন, সেসব দলের কোনও প্রধান বা সিনিয়র নেতার সমালোচনামূলক কোনও লেখা যদি কোনও বইতে থাকে, তাহলে সেগুলো বিক্রি করা যাবে না? নাকি জাতীয় নেতা বলতে শুধু একটি দলের কিছু নেতাকে বোঝানো হচ্ছে, সেটি একাডেমির নীতিমালায় স্পষ্ট নয়। একাডেমির উচিত ছিল জাতীয় নেতার সংজ্ঞা এবং তার সঙ্গে একটি তালিকা সংযুক্ত করে দেওয়া। না হলে এখন ঠিক বোঝা যাচ্ছে না তারা জাতীয় নেতা বলতে কাদের বোঝাচ্ছেন এবং কার কার সমালোচনা করে লেখা যাবে বা যাবে না।

৪. নীতিমালায় বলা হয়েছে, ‘অশ্লীল ও রুচিগর্হিত’। প্রশ্ন হলো অশ্লীলতা ও রুচিগর্হিতের সংজ্ঞা ও মানদণ্ড কী—সেটিও বাংলা একাডেমি পরিষ্কার করেনি। এই শব্দগুলোর কি সর্বজনীন কোনও অর্থ আছে? কোনও বিষয় রুচিগর্হিত কিনা, সেটি কে বিচার করবেন? একজনের কাছে যেটি রুচিগর্হিত, আরেকজনের  কাছে সেটি গর্হিত মনে নাও হতে পারে। বিশেষ করে বইয়ের কোনও লেখার ক্ষেত্রে এভাবে উপসংহার টানার সুযোগ রয়েছে কিনা? উপন্যাসের সংলাপে যে অনেক সময় স্ল্যাং থাকে, গালি থাকে, স্যাটায়ার থাকে; বিশ্বখ্যাত অনেক চিত্রকর্মে যে নগ্ন নারীদেহ দেখা যায়—সেগুলো কি অশ্লীল ও রুচিগর্হিত? এভাবে সংজ্ঞায়ন করলে পৃথিবীতে শিল্পসাহিত্য হবে?

৫. বাংলা একাডেমির নীতিমালা ভঙ্গ করলে সেই প্রতিষ্ঠানকে স্টল না দেওয়া একাডেমির এখতিয়ারভুক্ত। কিন্তু বিদেশের বইমেলায় ওই বই বিক্রি করা যাবে না- এমন নির্দেশ দেওয়ার এখতিয়ার পুস্তক প্রকাশক সমিতির আছে কিনা? তারা কি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদর্শকে এই চিঠি দিয়েছে, নাকি তাদের ওপরে কোনও রাজনৈতিক চাপ আছে?

৬. যেহেতু জাতীয় নেতাদের সমালোচনা করে এর আগেও অসংখ্য বই লিখিত হয়েছে এবং যে একটি বা তিনটি বইয়ের কারণে এবার আদর্শ প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হলো না, সেগুলো মেলায় বিক্রি শুরুর আগেই ওই প্রকাশনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো কেন? তার মানে একাডেমি কর্তৃপক্ষকে ওই বইগুলো কেউ সরবরাহ করেছেন এবং তারা এই বইগুলো যাতে মেলায় বিক্রি না হয় এবং আদর্শ যাতে স্টল না পায়, সে বিষয়ে একাডেমির ওপরে চাপ দিয়েছেন। তারা কারা? রাজনৈতিক গোষ্ঠী নাকি প্রকাশকদেরই কেউ?

৭. আদর্শ প্রকাশনীর সঙ্গে এক বা একাধিক প্রভাবশালী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব যে আছে, সেটি অনেকেই জানেন এবং তারা আদর্শকে মেলায় স্টল বরাদ্দ না দিতে একাডেমি কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছেন কিনা—সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু মাঝখান দিয়ে বিষয়টা হয়ে গেলো বাংলা একাডেমি বনাম আদর্শ প্রকাশনী। ফলে সমস্যাটা শুধুই একাডেমির নীতিমালা ভঙ্গ নাকি এখানে প্রকাশকদের ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বও আছে—সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার।

৮. বলা হচ্ছে ‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’ বইতে বাঙালি জাতিসত্তা, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, বিচার বিভাগ, বাংলাদেশের সংবিধান, সংসদ সদস্য এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে অশ্লীল, রুচিগর্হিত, কটাক্ষমূলক বক্তব্য রয়েছে—যা বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯(২) অনুচ্ছেদে বর্ণিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ সাপেক্ষে বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের পরিপন্থি। এসব অভিযোগ সত্য হলে এই বইটি বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলার নীতিমালা ভঙ্গের দায়ে ওই প্রকাশনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার কর্তৃপক্ষের আছে। কিন্তু এই বইটি মেলায় প্রদর্শন ও বিক্রি না করার বিষয়ে লিখিত প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরেও কেন আদর্শকে স্টল দেওয়া হলো না? এই এখতিয়ার কি বাংলা একাডেমির আছে? নীতিমালা অনুযায়ী এই এখতিয়ার তাদের থাকলেও এটি কি যৌক্তিক বা গ্রহণযোগ্য?

বস্তুত এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলা একাডেমি এবং কার্যত সরকারের বিষয়ে দেশের ভেতরে এবং বাইরেও একটা ভুল বার্তা চলে গেছে। যেহেতু বিষয়টা নিয়ে বিদেশি গণমাধ্যমেও সংবাদ হয়েছে এবং সোশাল মিডিয়ায় সমালোচনার কারণে এটি বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ জেনে গেছেন, ফলে তাদের মধ্যে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে যে বাংলাদেশে ভিন্নমতের কোনও নিরাপত্তা নেই।

উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে ‘নবী মোহাম্মদের ২৩ বছর’ নামের একটি বইতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে রোদেলা প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দিয়েছিল বইমেলা পরিচালনা কমিটি। এর পরের বছর ২০১৬ সালে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ দিতে পারে এমন আশঙ্কায় অমর একুশে বইমেলায় ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দেয় পুলিশ। এ ঘটনায় লেখকসহ পাঁচ জনকে আটকও করা হয়। তার মানে কনটেন্ট পছন্দ না হলে সেই প্রকাশনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম নয়।

এটা ঠিক যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানে যা খুশি তা-ই বলা বা লেখা নয়। কিন্তু প্রশ্নটা অন্যখানে। সেটি হলো, উল্লিখিত বইতে যে এই ধরনের আপত্তিকর লেখা আছে, সেটি তো এই বই যারা পড়েননি বা ভবিষ্যতে যারা পড়বেন না, তারা কোনোদিনই জানতে পারতেন না। বরং এখন বাংলা একাডেমি নিজেই বিষয়টি জাতিকে জানালো। ফলে যারা বইগুলো পড়েননি বা পড়ার ইচ্ছে ছিল না, তারাও এখন কৌতূহলবশত এগুলো কিনছেন, কিনব্নে।

বই শুধু মেলাতেই বিক্রি হয় না। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র আছে। সারা দেশে বইয়ের দোকান আছে। অনলাইনে সারা বছরই বই বিক্রি হয়। সুতরাং এক মাস বইমেলায় এগুলো বিক্রি হলো কিনা, তাতে আসলে কিছু যায় আসে না। বরং এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে পুরো এক মাসে মেলায় বইগুলো যে কয় কপি বিক্রি হতো, সম্ভবত গত কয়েক দিনে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি এরইমধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে।

এর আগে হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’ এবং তসলিমা নাসরিনের ‘ক’ বইটিও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তাতে কি ওই বইগুলোর বিক্রি কমেছে? বরং নিষিদ্ধ ঘোষণার পরে বইগুলোর বিক্রি বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। সালমান রুশদির ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ও নিষিদ্ধ হয়েছিল এবং রুশদিকে হত্যার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছিল ইরান সরকার। তাতে ওই  বইয়ের বিক্রি হু হু করে বেড়ে যায়। বই পড়তে ভালোবাসেন এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে যার ঘরে ‘স্যাটানিক ভার্সেস’, ‘নারী’ ও ‘ক’ নেই। এখন তাদের ঘরে আদর্শ প্রকাশনীর ওই বই তিনটিও থাকবে। তাহলে লাভ হলো কার?

পরিশেষে, বই একটি সৃষ্টিশীল মাধ্যম। এই মাধ্যমে যদি আপত্তিকর কিছু থাকে, সেটির জবাব আরেকটি বই লিখেই দেওয়া যায়। তাছাড়া সব লেখকের সব লেখাই যে বাংলা একাডেমি কিংবা সরকারের অথবা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের মনঃপূত হবে—এমন কথা নেই। ভিন্ন মতের অনুসারীরা এমনকি সরকারে কট্টর সমালোচকরাও কড়া ভাষায় সরকারের সমালোচনা করবেন—এই অধিকারও গণতন্ত্রে স্বীকৃত। পাঠক বিচার করবেন ওই লেখাটি বা ওই বইটি তারা গ্রহণ করবেন কি করবেন না। নীতিমালার দোহাই, মাস্তানি কিংবা পুলিশিং দিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা আটকানো যায় না। বরং আটকানোর চেষ্টা করলে সেটি হিতে বিপরীত হয়।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।