ভাষার জন্য

তসলিমা নাসরিন১.

১৯৯১-১৯৯২ সালে বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি বইমেলা থেকে আমার বই উঠিয়ে নিয়েছিল, আমার জন্য মেলায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিল। কেন? কারণ কয়েকটি বখাটে নারীবিদ্বেষী ছেলেপিলে আমার লেখা পছন্দ করতো না,  আমাকে সহ্য করতে পারতো না, তাই। বর্বরতার ওই শুরু। কেউ কি প্রতিবাদ করেছিল? না। সবাই বলেছিল, 'ও তসলিমার ব্যক্তিগত ব্যাপার'। তার মানে আমি যা লিখি , তার দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে, আমার ওপর হামলা হলে তা আমাকেই সামলাতে হবে। আর, বুঝে শুনে না লিখলে ভোগান্তি তো হবেই। আমাদের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবিই আমার ওপর বাংলা একাডেমির পরিচালকদের, মৌলবাদীদের, নারীবিদ্বেষীদের, এবং সরকারের বর্বর হামলাকে একরকম সায় দিয়েছিলেন। তারপর তো ঘটেই চলেছে বাক স্বাধীনতাবিরোধী কীর্তিকলাপ।
বাংলা একাডেমি কোথায় লেখকদের মত প্রকাশের পক্ষে দাঁড়াবে, তা নয়, বিপক্ষে তো দাঁড়ায়ই, আচার-আচরণ ধর্মীয় মৌলবাদীদের মতোই করে। গত বছর রোদেলা প্রকাশনীর বিরুদ্ধে যা নয় তা করলো। এতগুলো লেখক-ব্লগার যে খুন হলো -  তার প্রতিবাদে এ বছর কিছুই করলো না। শুনেছি মেলা থেকে আমার বই-টই সরিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করছে। তালেবানরা যেরকম গুহায় বসে মানবাধিকার বিরোধী চক্রান্তে লিপ্ত হয়, বাংলা একাডেমির লোকরাও একাডেমিতে বসে মুক্তচিন্তার বিপক্ষে, প্রগতিশীলতার বিপক্ষে ঠিক তা-ই করে। ব-দ্বীপ নামে একটি প্রকাশনীর স্টলকে বইমেলায় এর মধ্যেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ব-দ্বীপের প্রকাশককে শুনেছি পুলিশ গ্রেফতার করেছে। ওই সেই পুরোনো এলেবেলে ছুতো, কার নাকি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের বিরুদ্ধে, বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে একটি বোধহীন বোবা বিকট দৈত্যকে দাঁড় করানো হচ্ছে অনেককাল। 

২.

একুশের বইমেলায় ব-দ্বীপ প্রকাশনীর যে স্টল ছিল, সেটিকে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ বন্ধ তো করেছে। বইটির লেখক-প্রকাশককে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রগতিশীল লেখক হিসেবে খ্যাত মুহম্মদ জাফর ইকবালবলেছেন, 'যে বইটির কারণে স্টলটি বন্ধ করা হয়েছেসেটির কয়েকটি লাইন আমাদের বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান আমাকে পড়ে শুনিয়েছেন। আমি কয়েক লাইন শোনার পর আর সহ্য করতে পারি নি। এত অশ্লীল আর অশালীন লেখা। এই স্টলটিকে আর অন্য দশটি সাধারণ স্টলের সঙ্গে তুলনা করলে চলবে না। তিনি বলেনআমি মনে করে লেখালেখির সময় কিছুটা সতর্ক থাকতে হবে। যাতে কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না আসে। আর যে বইটির বিষয়ে কথা হচ্ছেআমার অনুরোধ কেউ যেন এই বইটি না পড়ে।

কী সাংঘাতিক কথা! কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত যেন না আসে, লেখার সময়, নিজে লেখক হয়ে অন্য  লেখকদের বলেছেন সতর্ক থাকতে! মানুষের মত প্রকাশের অধিকারের চেয়ে ধর্মীয় অনুভূতির মূল্য তিনি বেশি দিচ্ছেন! ধর্মীয় মৌলবাদীরা, যারা নিজেদের ছাড়া অন্য কারও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, ঠিক এরকম কথা বলে। অবাক হলাম শুনে যে বইয়ের কয়েক লাইন শুনেই জাফর ইকবাল রায় দিয়ে দিয়েছেন, লেখাটি অশ্লীল আর অশালীন!

কোন লেখা শ্লীল আর কোনটা অশ্লীল তা বিচার করবে কে শুনি! কোনও লেখা কারও কাছে অশ্লীল ঠেকে, কারও কাছে ঠেকে না। যে লেখে তার কাছে তার লেখা শ্লীল মনে হয় বলেই সম্ভবত লেখে। ধরা যাক, কোনও লেখকের কোনও লেখা সবার কাছে অশ্লীল আর অশালীন বলে মনে হচ্ছে, তাহলে কি লেখককে শাস্তি দিতে হবে? তার স্টল বন্ধ করে দিতে হবে? অশ্লীল লেখা লেখার অধিকার কি লেখকদের নেই? প্রকাশকদের কি অধিকার নেই অশ্লীল লেখা ছাপানোর? তাদের কি অধিকার নেই বইমেলায় স্টল দেওয়ার? পাঠকের কি অধিকার নেই অশ্লীল বই কেনার? অশালীন বই পড়ার? 

কে বলেছে বই লিখলে শ্লীল বই লিখতে হবে? মানুষের জীবন যাপন অশ্লীল, মানুষের চিন্তাভাবনা অশ্লীল , মানুষের বর্বরতা অশ্লীল, মানুষের লোক ঠকানো, অপহরণ, ধর্ষণ, খুন সব অশ্লীল। অশ্লীল মানুষ নিয়ে লেখকরা অশ্লীল বই লিখতে পারবে না!

একটা অশ্লীল বই লেখার জন্য আমার হাত নিশপিশ করছে।

.

আমরা ভাষা দিবস বলতাম না কখনও। বলতাম একুশে ফেব্রুয়ারি। এখনও একুশে ফেব্রুয়ারিই বলি। দিনটা এলে কেমন ঈদ ঈদ লাগতো। সারাদিন সাদা শাড়ি পরে রাস্তায় খালি পায়ে হেঁটে, শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে, গান গেয়ে, কবিতা পড়ে সময় কেটে যেতো।

যে ভাষার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম, সে ভাষায় আজ আমি কথা বলি, সে ভাষায় লিখি। ভাষা আমার স্বাধীনতার আরেক নাম।

ভাষার জন্য আমরা যুদ্ধ করেছি। মানুষ টাকা পয়সার জন্য, ধর্মের জন্য, ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য, ভূমি দখলের জন্য যুদ্ধ করে। ভাষার জন্য যুদ্ধ করা সাধারণ মানুষের কাজ নয়। আমরা অসাধারণ সব কাজ করেছি।

এখন অবশ্য সবাই মিলে নষ্ট হয়ে গেছি। তারপরও ভালো যে আলপনাটা আঁকি। এখনও কিছু ফুল দিই পাদদেশে। হঠাৎ একদিন যদি শুনি একুশে ফেব্রয়ারিতে শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া নিষেধ, গান গাওয়া নিষেধ, বই বেরোনো নিষেধ ---অবাক হবো না। আমি আজকাল কোনও দুঃসংবাদে আর অবাক হই না। দুঃখ পেতে পেতে পাথর হয়ে গেছি।

 লেখক: কলামিস্ট