বৈদেশিক বাণিজ্য সম্প্রসারণে ব্রিকস ও আমাদের সমৃদ্ধি

স্বাধীন বাংলাদেশের শুরু থেকেই মার্কিন ডলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বেশ শক্তিশালী। আমদানিনির্ভর দেশে মার্কিন ডলারের মাধ্যমে রফতানিকারক দেশগুলোর মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে আমাদের ওপর বেশ চাপ সৃষ্টি হয়। বৈদেশিক মুদ্রা পরিশোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে এর প্রভাব পড়ে। বৈশ্বিক সংকটে বিভিন্ন দেশেও মূল্যস্ফীতি ঘটেছে। দেশের খাদ্যসহ বেশ কিছু পণ্য অতিরিক্ত দামে মার্কিন ডলারে পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এসব কারণ মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া এবং সংকট।

তাছাড়া রফতানিকারকদের সুবিধা দেওয়া। প্রতি মার্কিন ডলার দেশি মূল্যে বেড়ে তিন অঙ্কের সংখ্যায় (ডিজিট) দাঁড়িয়েছে। সরকারের যুক্তি হলো রফতানিকারকদের প্রেষণা ও উৎসাহ দান। সরকারের কাছে প্রশ্ন– মোট জনগোষ্ঠীর কত শতাংশ রফতানিকারক? রফতানিকারক সবাই কি সত্যিকারের দেশপ্রেমিক? প্রণোদনার অর্থও কি দেশের অভ্যন্তরে থাকে? বিদেশি ব্যাংকে তো বাংলাদেশি ধনী শ্রেণির জনগণের অর্থ এমনি এমনি বৃদ্ধি পায় না? তাছাড়া সেকেন্ড হোমের ধারণা কি দেশপ্রেম? ব্যাংক ঋণপত্রের মাধ্যমে রফতানিকারকদের গর্হিত নানা কর্মকাণ্ডের কথা না হয় নাই বললাম!

মার্কিন ডলারের চাপ সইতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলার সাশ্রয়ে দেশে সেপ্টেম্বর থেকে টাকা-রুপির ডেবিট কার্ড চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কার্ড দিয়ে দেশের ভেতরে টাকা দিয়ে কেনাকাটাসহ বিভিন্ন বিল পরিশোধ করা যাবে এবং পাশাপাশি ভারত ভ্রমণের সময় রুপিতে খরচ করার সুযোগ পাবেন ব্যবহারকারীরা।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দিকে এ জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় এ তথ্য জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। তিনি তখন বলেন, ‘আমরা টাকার একটি পে-কার্ড চালু করছি। এটাকে ভারতের রুপির সঙ্গে সংযুক্ত করে দেবো। এ কার্ড থাকলে গ্রাহকেরা বাংলাদেশে ডেবিট কার্ড হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন। যেকোনও কেনাকাটা করতে পারবেন। আবার যখন ভারতে যাবেন তখনও এ কার্ড দিয়েই ভ্রমণ কোটায় ১২ হাজার ডলার খরচ করতে পারবেন।

ফলে দুইবার ‘মানি চেঞ্জে’ যে লস হচ্ছে, তা আর হবে না। অর্থাৎ ভ্রমণে যেতে হলে প্রথমে টাকা থেকে ডলারে কনভার্ট করতে হয়, পরে ভারতে গিয়ে ডলার রুপিতে স্থানান্তর করতে হয়। টাকার পে-কার্ড নিলে দুইবার ‘মানি চেঞ্জ’ করতে হবে না। এতে কমপক্ষে ৬ শতাংশের মতো খরচ কমবে বলে জানান গভর্নর তখন অভিমত ব্যক্ত করেন।

ভারত থেকে বাংলাদেশের রফতানি আয় আসে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার; এই পরিমাণ বাণিজ্য লেনদেন রুপিতে নিষ্পত্তি করা হবে। ব্রিকসে যুক্ত হওয়ার জন্য অনেক মান অর্জন করতে হবে। অর্থনৈতিক শক্তি, বাজার ক্ষমতা, জনসংখ্যা সক্ষমতা সব কিছুই বিবেচনা করবে।

ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা– এই পাঁচটি দেশ মিলে গঠিত অর্থনৈতিক জোট ব্রিকস আগে সাউথ আফ্রিকা ছিল না। তখন জোটটির নাম ছিল ব্রিক। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা অর্থনৈতিক এই জোটে যুক্ত হয়। ২০০৯ সালে রাশিয়ায় ব্রিকের শুরু।

আগস্টে বাংলাদেশ আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ব্রিকসের  সদস্য পদ লাভ করতে পারে বলে অভিমত দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন।

সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার এক বৈঠকের পর সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ের সময় এ তথ্য দেন তিনি।

তিনি বলেন, ব্রিকস ব্যাংক সম্প্রতি বাংলাদেশকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ব্যাংকে আমাদের সদস্য করেছে। আগামীতে তারা ব্রিকসে বাংলাদেশকে সদস্য করবে, আগস্ট মাসে ওদের সম্মেলন আছে। প্রধানমন্ত্রী সেখানে অংশ নেবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।

উন্নয়নশীল অথবা সদ্য শিল্পোন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেশ ঊর্ধ্বমুখী। সেই সঙ্গে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ঘটনাবলির ওপর তাদের উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। তাই এই জোটকে বেশ প্রভাবশালী বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা।

ব্রিকসে বাংলাদেশ যুক্ত হলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্যের ক্ষেত্রে কোনও ছেদ পড়বে না বলে আমার ধারণা। সমস্যা হওয়ার কথাও নয়। কারণ, ব্রিকসে শক্তিশালী ভারতও আছে, যারা সেখানকার অন্যতম ভূমিকা পালনকারী। বাংলাদেশের কাঠামোগত উন্নয়ন হলে সেটা আমেরিকার জন্যই লাভজনক। সে হিসেবে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়।

ব্রিকসের আমন্ত্রণ পাওয়ার জন্য ফ্রান্সও চেষ্টা করছে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হতে চায় অনেকেই। কারণ, ব্রিকস জি-২০ থেকেও বড় হবে। সেদিক থেকে ব্রিকসের সঙ্গে বাংলাদেশ যুক্ত হতে চাওয়ার বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়। এটি বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্যের ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা করবে না। বরং উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা ব্রিকসের সঙ্গে যুক্ত হতে পারি।

ব্রিকসের সব দেশের সঙ্গেই আমাদের কমবেশি নানা সম্পর্ক রয়েছে। চীন, ভারতের সঙ্গে বেশি আছে। বাকিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ খুব একটা নেই, যেমন– ব্রাজিল, সাউথ আফ্রিকা। এদের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য কম, কিন্তু সম্ভাবনা আছে। সেটা মনে রেখেই সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণ জানালে আমরা সদস্যপদ নিতে পারি। এক্ষেত্রে ভূ-রাজনৈতিক বিষয়গুলো খুব বড় ইস্যু হবে বলে মনে করছি না।

ব্রিকস আসলে কারও একক নেতৃত্বের স্থান নয়। ব্রিকসে চীন, রাশিয়া, ব্রাজিল, ভারত ও সাউথ আফ্রিকা যে বড় ৫টি দেশ, তারা সবাই খুব শক্তিশালী রাষ্ট্র্র। তাদের অর্থনীতি বেশ মজবুত। এদের মধ্যম শক্তিশালী দেশ বলা যেতে পারে, যারা গ্রেট পাওয়ার ছুঁতে যাচ্ছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এ দেশগুলো বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর চেয়েও বেশি সামর্থ্য রাখে। আজকে চীন অর্থনৈতিক শক্তির ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি চলে গেছে এবং তারা রাশিয়ার সমকক্ষ হয়ে গেছে। ব্রিকসের আরও একটি উদ্দেশ্য ডলারের যে আধিপত্য সেটি হ্রাস করা। মার্কিন ডলার ছাড়া তারা চাইছে নিজেদের মধ্যে নিজেদের মুদ্রায় রূপান্তরিত লেনদেন করতে। এটাকে একটি সাফল্যময় বণ্টন হিসেবে দেখতে হবে এ জন্য যে প্রত্যেকের অর্থনীতি বেশ শক্তিশালী। তারা নিজেদের ব্যাংক করেছে, যেখান থেকে ঋণ নেওয়া যাবে, যেটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বিশ্বব্যাংকের সমান্তরালে অবস্থান করে।

আগামীতে বাংলাদেশ, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইন্দোনেশিয়াসহ প্রায় আটটি দেশ এই জোটের সদস্য হিসেবে যুক্ত হতে পারে বলে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আভাস দিয়েছেন।

সব মিলিয়ে আরও ১৯টি দেশ ব্রিকস জোটে যোগ দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে ব্রিকস বিষয়ক বিশেষ দূত অনিল সুকলালের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে মার্কিন একটি সংবাদ মাধ্যম।

ব্রিকস আরও সম্প্রসারিত হলে অর্থনীতির নতুন দিগন্ত উন্মোচন হবে।

২০১৪ সালের হিসাবে, ব্রিকসের পাঁচটি সদস্য দেশে প্রায় ৩২০ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ। পাঁচটি দেশ পৃথিবীর ২৫ শতাংশ এলাকাজুড়ে রয়েছে এবং বৈশ্বিক জিডিপি’র প্রায় ২৫ শতাংশও এ দেশগুলোর। এমনকি বর্তমানে ব্রিকস সম্মিলিতভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ৪৩ শতাংশ (৮ ট্রিলিয়ন ডলার) নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্বের যত পণ্যসেবা উৎপাদন হয় তার ২১ শতাংশ আসে এই পাঁচটি দেশ থেকে।

ব্রিকস সদস্য দেশগুলো ২০১৫ সালে তাদের নিজস্ব অর্থশক্তিতে নিজেদের ব্যাংক চালু করে। পরে অবশ্য এর নাম পাল্টে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক রাখা হয়। যা ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সমকক্ষ হতে পারে।

অর্থনীতির বিশ্লেষক হিসেবে মনে করি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে এক দেশের মুদ্রা অন্য দেশে মূল্য পরিশোধ বাস্তবায়নে  চুক্তি হওয়া জরুরি। উদার অভিবাসনের মতো অবাধ বাণিজ্য মানেই একে অপরের বন্ধুত্বপূর্ণ সৌহার্দ্য। উন্নয়নের জন্য আমরা চাই সব দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক। নির্দিষ্ট কয়েক দেশের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে চলবে না, উন্নত দেশের পথে অগ্রসরমান বাংলাদেশের ফি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো মোকাবিলায় অর্থনীতির সংকট উত্তরণে নিজ নিজ দেশের মুদ্রার ব্যবহার জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য বাড়াতে হবে। দেশের স্বার্থরক্ষায় তাই বিভিন্ন অর্থনৈতিক জোটে যুক্ত হওয়া সময়ের দাবি। ব্রিকসে আমরা যুক্ত হলে আমাদেরও স্বার্থ কার্যকর হবে। একাধিক সহযোগী দেশ থাকলে দরকষাকষির সুযোগ থাকে। তখন শর্তগুলো শিথিল হয়। একচেটিয়া কারবার (মনোপলি ব্যবসায়) তাতে খর্ব হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং ব্রিকসের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি) সবার সঙ্গেই আমরা পথ চলবো। বৈদেশিক বাণিজ্যে কোনও একটি মুদ্রার ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে নিজেদের স্বার্থে। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। তাই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধিতে ডলার, পাউন্ড, রুবেল, আরএমবি, রুপি, ইউরো, রিয়েল, দিনার, পেসো, ক্রোন, ক্রোনা, ইয়েন, রিয়ালসহ সব মুদ্রার সঙ্গে সহজ বিনিময় প্রত্যাশী। দেশ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী এবং বড় বড় আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক জোটের সঙ্গে যুক্ত হলে তখন উন্নত দেশ আমাদের দেশকে বন্ধুই ভাববে। আমরা তেমনটাই প্রত্যাশা করি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশ্ববাণিজ্যকে শক্তিশালী করার বিকল্প নেই। বাণিজ্য সম্প্রসারণে বহুমুখীকরণ যেমন সময়ের দাবি তেমনি আন্তর্জাতিক একটি মুদ্রার বিনিময়ের ওপর নির্ভরতা কমানো জরুরি। দফায় দফায় মার্কিন ডলারের মূল্য বৃদ্ধি আমদানিনির্ভর দেশের অভ্যন্তরে মূল্যস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণও বটে। মূল্যস্ফীতি মানেই সাধারণ জনগণের নাভিশ্বাস!

লেখক: কথাসাহিত্যিক, কবি ও অর্থকাগজ সম্পাদক