রাজনীতি-নির্বাচন-গণতন্ত্র ও মানুষের দুঃখ-কষ্ট

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ডামাডোল শুরু হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি বলছে, আগামী বছরের শুরুর দিকেই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মেনে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়া-পাওয়ার ভিন্নতা থাকলেও দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মহলের প্রত্যাশা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন।

স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখলে আসন্ন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি। যদিও রাজনৈতিক দেনদরবারে এখন বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি একেবারেই অস্পষ্ট। শেষ পর্যন্ত দলটি নির্বাচনে আসবে কিনা, তা হয়তো সময়ই বলে দেবে।

প্রশ্ন হলো বিএনপি ছাড়া কি ক্ষমতাসীন দলের আর কোনও প্রতিপক্ষ নেই? করোনা শুরুর পর থেকে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশকেও নানা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপদ হয়ে সামনে এসেছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। এর অবসান কবে হবে জানা নেই। কিন্তু সংকট তো হাত গুটিয়ে বসে নেই। ক্যানসারের মতো বিস্তার ঘটছে। রাত পোহালেই সমস্যার মাত্রা বাড়ছে।

তাই আওয়ামী লীগ তথা সরকারের সামনে বিএনপি একমাত্র নির্বাচনের প্রতিপক্ষ তা বলার আর সুযোগ নেই। প্রতিপক্ষ অনেক। ক্ষমতাসীন দলের ভোট নষ্টের বড় দিকগুলো হলো নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। নিজ দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের অত্যাচার, অবিচার করাসহ নানা অভিযোগ। অর্থপাচার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেওয়া। এ আলোচনা দীর্ঘদিন চললেও লাগাম টানা সম্ভব হয়নি। তাই ছোট ছোট ঢেউগুলো এক হয়ে বড় আকার ধারণ করেছে। উঁচু ঢেউ বড় রকমের বিপদের পূর্বাভাস। অথবা বিপদ সংকেত হয়ে অপেক্ষা করছে।

যদি শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে না আসে তাহলে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসতে কোনও বাধা নেই। তবে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আর বিএনপি প্রতিটি আসনেই আওয়ামী লীগের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। নির্বাচনি বৈতরণী পাড়ি দিতে তাহলে কি আওয়ামী লীগের সামনে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার বিকল্প পথ নেই?

যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে গোটা পৃথিবীর অর্থনীতি টালমাটাল। ডলারের দাম বাড়ায় উন্নয়নশীল দেশগুলো সবচেয়ে বেশি বিপাকে। এ কারণে সবকিছুর বাজার চড়া। আমদানিনির্ভর পণ্য একেবারেই বেসামাল। মানছি কিছু বিপদের সুরাহা একেবারেই নেই। আর কিছু বিপদের মোকাবিলা করার জন্য ইচ্ছাশক্তিই বড়।

চাল তো আর শতভাগ আমদানিনির্ভর পণ্য নয়। তাহলে চালের বাজার গত ১৫ বছরে মানুষের স্বস্তির জায়গায় আনা সম্ভব হয়নি কেন? মাছ উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাহলে মাছের বাজারে কেন আগুন লেগেই থাকে। মৌসুমে দেশে উৎপাদিত আলুর দাম না পেয়ে কৃষকরা রাস্তায় ফেলে দেয়। সেই আলুর কেজি এখন ৫০ টাকা। মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে কেজিপ্রতি আলুতে ৩০ টাকা বেড়ে যাবে? দেখার কেউ থাকবে না, তা হতে পারে না। সাবান তো আর আমদানিনির্ভর পণ্য নয়। হয়তো এর কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। তার মানে কি গায়ে মাখার প্রতি সাবানে ১৫ থেকে ২০ টাকা বাড়বে? তেমনি কাপড় কাচার সাবান, ডিটারজেন্টের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। ১৫ টাকার সাবান এখন ২৫ টাকা! আদা, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজের ঝাঁজও দেখা গেলো সাম্প্রতিক সময়ে। অথচ কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হলো না। পণ্য আমদানি করে বাজার পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে। একের পর এক নিত্যপণ্য যখন সিন্ডিকেট করে বাড়ানো হচ্ছে তখন এই তেলেসমাতি কারবার নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্য সাধারণ মানুষকে আরও বেশি হতাশ করেছে। প্রধানমন্ত্রীও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বাজার অপশক্তির শেষ পর্যন্ত লাগাম টানতে পারেননি।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো ৩০ টাকার শেভিং রেজার একলাফে ৪০ টাকা। একই প্রতিষ্ঠানের শেভিং রিফিল ১৫ টাকার স্থলে ১৮ টাকা। ভারতীয় রসুন, দেশি আদা, চিনি, মসলার একেবারেই লাগাম ছাড়া দাম। এগুলো তো বিলাসী কোনও পণ্য নয়। তবু ইচ্ছামতো দাম বাড়বে? আর সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে সাধ্যের বাইরে গিয়ে পণ্য কিনে আনতে হবে, এর কি কোনও প্রতিকারের পথ নেই?

এর বাইরে যদি বলি, অন্য সব জিনিসের দামও বাড়তি। কোনও কিছুই তো সাধ্যের মধ্যে আনা যাচ্ছে না। সরকার সামাজিক সুরক্ষা নানা কর্মসূচি চালু করেছে। অনেকই এর আওতায় এসেছেন। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ চান নিজের স্বল্প আয় দিয়েই চলতে। সব কিছু সাধ্যের মধ্যে থাকলে অল্প আয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে চলা সম্ভব। সে পরিবেশ না থাকায় কারও পণ্যের দামে স্বস্তি প্রকাশের সুযোগ নেই।

দলের নেতাকর্মীরাও তো একবাক্যে বাজার নিয়ে অস্বস্তির কথা স্বীকার করবেন। তাই বিষয়টিকে দলীয়ভাবে দেখার সুযোগ নেই।

দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা কী সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না? অবশ্যই পড়ে। কিন্তু কেন সবকিছু ইচ্ছেমতো চলছে; এর জবাব হয়তো নীতিনির্ধারকদের কাছেই আছে। দেশে ব্যবসায়ীর চেয়ে সাধারণ মানুষ বেশি। তাহলে কিছু মানুষকে খুশি করে বিরাট অংশকে বাদ দিয়ে তো গণতন্ত্রের চর্চা ও রক্ষা কোনোটাই হবে না। যদি সত্যিকারের ভোটের রাজনীতি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখি, তাহলে সাধারণ মানুষেই রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি। তাদের ভোটের মাধ্যমে সরকার নির্বাচিত হয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। তাই তাদের শান্তি ও স্বস্তি দেওয়ার পাশাপাশি মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব।

সেই মানুষগুলো যখন ভালো থাকে না, অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন, শোষণ আর বঞ্চনার শিকার হন, তখন তারা তো বিকল্প চিন্তা করবেন এটাই স্বাভাবিক। অন্যথায় তারা আর ভোটকেন্দ্রমুখী হবেন না। তাহলে গণতন্ত্র হবে প্রশ্নবিদ্ধ।

মানছি গত ১৫ বছরে দেশের অর্জন অনেক। চলমান উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। বিশ্বে সুনাম বেড়েছে। ব্যক্তি শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে না থাকলে অনেক কিছুই সম্ভব হতো না, এটা আরও মহা সত্যি। আওয়ামী লীগে তো নেতাকর্মী কম নয়। কর্মীর সংখ্যা কোটি কোটি। সময়ের কারণে নেতাকর্মীর জোয়ার আরও বাড়ছে।

ক্ষমতাসীনদের হাতে ব্যবসা বাণিজ্যের বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রণ থাকবে স্বাভাবিক। নেতৃত্ব থেকে শুরু করে তারা সমাজের সবকিছুতে এগিয়ে থাকবে স্বাভাবিক। তাদের কেন দেশপ্রেমের চেতনার উদ্বুদ্ধ করা যায়নি? তাদের সততা, দেশপ্রেম, মানুষকে ভালোবাসা নিয়ে কেন প্রশ্ন উঠবে। যদি এমন প্রশ্ন জন্ম না হতো তাহলে আজ পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে হয়তো ঠেকতো না।

এজন্যই হয়তো অনেকে বলেন, শেখ হাসিনার মতো একজন মানবিক মানুষ আছেন বলেই আওয়ামী লীগ টিকে আছে। সবচেয়ে বড় বিপদ হলো আওয়ামী লীগে তৃতীয় প্রজন্মের ভরসা করার মতো এখনও বলার মতো নেতৃত্ব তৈরি হয়নি।

ব্যবসা, ব্যাংক, থেকে শুরু করে অর্থনীতির সবকিছুতেই ক্ষমতাসীনদের আধিপত্য। তারা থাকতে উল্টো পথে হাঁটছে সবকিছু। যার ফলাফল, মানুষ ভালো নেই। কষ্টে আছে। বাম্পার বোরো ফলনের পরও হয়তো চালের দাম হাতের নাগালে আসেনি। তাই সামনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মূল প্রতিপক্ষ হলো নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে কষ্টে থাকা ভোটাররা। হাতে এখনও প্রায় পাঁচ মাস সময় আছে। কাজ শুরু করতে হবে আজ থেকেই। আপসের চিন্তা বাদ দিয়ে দলের অপকর্মকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। শেয়ার বাজারকে আস্থার জায়গায় ফিরিয়ে আনা জরুরি। পাচার হওয়া অর্থ যেকোনও মূল্যে ফেরত এনে অপকর্মকারীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি পরিস্থিতিকে রাতারাতি পাল্টে দিতে পারে। অনেকের মতো আমিও বিশ্বাস করি শেখ হাসিনা চাইলে তা পারেন।

মনে থাকার কথা, ক্যাসিনো হোতাদের ধরার সময় মানুষ কতটা খুশি হয়েছিল। অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযানের সময় সবাই বাহবা দিয়েছিল। পরিস্থিতি এমন সৃষ্টি করা উচিত, দুর্নীতিবাজরা যেন ভয়ে থাকে। রাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করে। অবৈধ সম্পদ সরকারের হাতে তুলে দেয়। নিত্যপণ্যের সব রকম সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। যে দেশের মানুষ সব দিক থেকে সুখে, শান্তিতে থাকবে সে দেশের উন্নয়ন আর অগ্রগতি কোনও অবস্থাতেই দাবিয়ে রাখা যাবে না। আমরা সেই ধারায় যেতে চাই। আমলা নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের হাতে কঠোর বার্তার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা তুলে দিতে হবে। কোনও অবস্থাতেই নেতাদের থেকে চোখের নজর সরানো যাবে না। নেতারা ঠিক থাকলে কর্মীরা সঠিক পথে চলতে বাধ্য। আশা করি আওয়ামী লীগ আগামী জাতীয় নির্বাচন মাথায় রেখে সব সংকট কাটিয়ে উঠবে। ভোটারদের পদচারণায় আবারও সরব হবে প্রতিটি কেন্দ্র। বিশ্ববাসী দেখুক বাংলাদেশের মানুষ আবারও ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনি উৎসবে মেতেছে। সবাই প্রশ্নহীন গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে পছন্দের সরকার বেছে নিয়েছে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

rajan0192@gmail.com