X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ফারিয়ার জন্য অনেক প্রার্থনা

রাজন ভট্টাচার্য
১৪ মার্চ ২০২৩, ১৯:১৩আপডেট : ১৪ মার্চ ২০২৩, ১৯:১৩

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছোট্ট শিশু ফারিয়া চৌধুরী। একটি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা-মাকে হারিয়েছে সে। আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে এনে ভর্তি করা হয়েছে। মাঝে মধ্যেই শিশুটি বাবা-মায়ের কাছে যেতে বলছে। চারপাশ ঘিরে আছে স্বজনরা। ডাক্তাররা সাধ্যমতো তাকে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন। শত চেষ্টার মধ্যেও কেউ একটি সত্য কথা উচ্চারণ করতে পারছেন না। তা হলো ফারিয়ার বাবা-মা আর বেঁচে নেই। না ফেরার দেশে চলে গেছেন তারা। আর কখনও সন্তানকে বুকে জড়িয়ে নিবেন না। ঘরে ‘ফারিয়া’ বলে ডাকার আর কেউ রইলো না অবুঝ শিশুটির জীবনে।

নয় বছরের এই শিশুটির জন্য অনেক প্রার্থনা। ফারিয়া দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুক। আলোকিত মানুষ হোক। কিন্তু জীবনের শুরুতেই যে ধাক্কা খেয়েছে তা কাটিয়ে ওঠা তার প্রতিদিনের চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে সে সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরার পর বাবা-মা কাউকে আর ঘরে পাবে না। তাদের ঠিকানা হয়েছে কবর। এই শোকের যন্ত্রণায় বারবার ফারিয়ার বুকের পাঁজর মড়মড় করে উঠবে। ডুকরে কাঁদবে শিশুটি। এই নিঃসঙ্গতা, আশ্রয়চ্যুত হওয়া মনকে কতটুকু ভেঙে দেবে তা শুধু ফারিয়াই জানে।

অল্প বয়সে সে শোকের নিদারুণ যন্ত্রণার থাবা কীভাবে কাটিয়ে উঠবে? এই ভাবনা তার স্বজনদের পাশাপাশি আমাদের প্রত্যেকের। জীবনের শুরুতে এত বড় রকমের এই আঘাত তার বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে কোনও প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে না এটাই কামনা। আশা করি স্বজনরা শিশুটিকে আগলে রেখে বাবা-মায়ের অভাব কিছুটা হলেও পূরণ করবে। একটি ভালোবাসাময় আন্তরিক পরিবেশ ফারিয়ার জীবনে অল্প হলেও স্বস্তি জোগাবে বিশ্বাস করি।

গত দুই মার্চ বৃহস্পতিবার নেত্রকোনা-মদন সড়কের মাটিকাটা বাগরা এলাকায় ভয়ংকর এই দুর্ঘটনা ঘটে। বাসচাপায় আজহারুল ইসলাম নান্টু ও তার স্ত্রীর মৃত্যু হয়। এ সময় গুরুতর আহত হয় মেয়েটি। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে মোটরসাইকেলে মদন থেকে নেত্রকোনার দিকে যাচ্ছিলেন বাবা। বাগরা এলাকায় পেছন থেকে ছুটে আসা একটি বাস মোটরসাইকেলটিকে চাপা দেয়। এতে আজহারুলসহ তার স্ত্রী ও সন্তান গুরুতর আহত হন। পরে স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা আজহারুল ইসলাম নান্টুকে মৃত ঘোষণা করেন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তার স্ত্রী ও সন্তানকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্ত্রী মারা যান।

কেন এই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে এর কারণ হয়তো জানা যাবে না। তেমনি যে কারণে ঘটেছে এর প্রতিকারও মিলবে না। কারণ, দেশে সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে খুব সাদামাটা তদন্ত হয়। প্রকৌশলগত দিক তদন্তে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কিন্তু এটিই আসল। যদি কারিগরি দিকের দিকে বেশি নজর দেওয়া সম্ভব হতো তাহলে সড়ক দুর্ঘটনার যে ভয়াবহ দুর্যোগ দেশজুড়ে চলছে; তা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হতো।

এসব দুর্ঘটনার দিক থেকে প্রথমে সড়কের কোনও ত্রুটি ছিল কিনা তা দেখা দরকার। তেমনি চালকদের লাইসেন্স, দুটি বাহনের যান্ত্রিক ত্রুটি, ফিটনেস সার্টিফিকেট ছিল কিনা তা বের করতে হবে। তেমনি চালক বেপরোয়া গতিতে চালাচ্ছিলেন কিনা, কানে হেডফোন বা মোবাইল ছিল কিনা, তা তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। মূলত কথা হচ্ছে কেন দুর্ঘটনাটি ঘটেছে তার প্রকৃত কারণ বের করতে হবে।

যেমন উদাহরণ হিসেবে যদি বলি, বাসের ব্রেকটি যথাযথ ছিল না। বা ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়াই বাসটি চলছিল। যে কারণে চালক ইচ্ছা করলেও গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে এরকম সুনির্দিষ্ট কারণ বের করা প্রয়োজন। তাছাড়া সড়ক তদারকির দায়িত্বে সেদিন পুলিশ বা বিআরটিএ কারা ছিল। কাদের দায়িত্বহীনতার অভাবে এরকম দুর্ঘটনা ঘটছে তা চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এখনই।

দুর্ঘটনার পর বাসের চালক ও হেলপার পালিয়েছে। তাদের আটক করা যায়নি। সবার আগে তাদের আটক করতে হবে। তাদের জবানবন্দি সুষ্ঠু তদন্তের জন্য খুবই জরুরি। যেহেতু মোটরসাইকেলটিকে পেছন থেকে বাস ধাক্কা দিয়েছে, এ ক্ষেত্রে একেবারেই চালক নির্দোষ, তা বলার সুযোগ নেই।

তাছাড়া আঞ্চলিক সড়কগুলোতে এখন যানবাহনের চাপ আগের চেয়ে অনেক বেশি। এসব সড়কে অনুমোদনহীন যানবাহনের চাপ কতটা তা বলে বোঝানো যাবে না। নসিমন, করিমন, ব্যাটারি রিকশা, মাহিন্দ্র, ট্রাক্টর থেকে শুরু করে অদ্ভুত সব নামের যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক যান দেদার চলছে। এসব যানবাহনের প্রায় শতভাগ চালকের লাইসেন্স নেই। বেশিরভাগ প্যাডেল চালিত রিকশার চালক এসব গাড়ি চালাচ্ছেন। এর সঙ্গে অনুমোদিত বাহন তো আছেই।

প্রতিরোধে পথে কোনও তদারকি নেই। তাছাড়া মোটরসাইকেল তো গ্রামগঞ্জে এখন পথের রাজা। আইন-কানুন মানার তোয়াক্কা কেউ করেন না। সব মিলিয়ে জেলা ও আঞ্চলিক সড়কগুলো প্রশস্ত করা যেমন জরুরি তেমনি কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়াতে হবে। সবকিছু যদি শৃঙ্খলার বাইরে চলে যায় তাহলে অনেক কষ্টের সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ দিয়ে যানবাহন নিয়মে ফেরানো দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে।

শেষ কথা হলো, প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় বহু মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। নানা সমালোচনার মুখেও পথের প্রাণহানি রোধ সম্ভব হচ্ছে না। যানবাহন যত বাড়ছে তত পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনার সংখ্যাও। গত এক বছর সড়ক দুর্ঘটনার দিক থেকে বাংলাদেশে অবস্থান গোটা বিশ্বের মধ্যে চার ধাপ অবনতি হয়েছে। এটি সুখকর সংবাদ নয়। অর্থাৎ আমরা সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ভালো জায়গায় নেই। সব মিলিয়ে পথ ঝুঁকিমুক্ত করতে হবে।

এজন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বিআরটিএকে সত্যিকার অর্থে শক্তিশালী করা দরকার। তেমনি রাস্তায় বাড়াতে হবে নজরদারি। এক্ষেত্রে সড়ক বিভাগের ভূমিকাও অনেক। এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে মাঠে নামা যায়, তাহলে এই সমস্যা মোকাবিলা জটিল কিছু নয়। অন্যথায় ফারিয়ার মতো শিশুরা এতিম হবে। অনিশ্চিত হবে তাদের ভবিষ্যৎ। আমরা জবাব ছাড়া এসব শিশুর কাছে নিরুত্তর থাকবো। অনুমোদনহীন যান আরও বাড়বে। বাড়বে পথের অরাজকতাও। দিন দিন দীর্ঘ হবে লাশের সারি। সব আঁধার কাটিয়ে যেতে চাই আলোর দিকে। পথের দুর্ঘটনায় আর কান্না চাই না। আর চাই না অবুঝ শিশুর আর্তনাদ।

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক কালবেলা

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ