আজ মহানবমী, নবমীতেই দেবী বন্দনার সমাপ্তি

আজ মহানবমী। শাস্ত্রমতে, নবমীতেই দেবী বন্দনার সমাপ্তি। নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে নবমী পূজা পালিত হয়। তাই ভক্তরা দেবীর উদ্দেশে যজ্ঞের মাধ্যমে দেবী দুর্গার কাছে প্রার্থনা ক‌রেন। নবমীর আনন্দের পরই বিদায়ের সুর নিয়ে আসে বিজয়া দশমী।

বা‌রোয়া‌রি পূজা
একটা সময় দুর্গাপূজাগু‌লো হ‌তো রাজ-রাজা‌দের প্রাসা‌দে, নাটম‌ন্দি‌রে। ওই রাজবাড়ির পূজাগুলোতে সাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল না। দেখা যায়, দুর্গা-কালী-জগদ্ধাত্রীর মতো মহাপূজাগুলো চাইলেও একা একা করে ফেলা সম্ভব না। কারণ, এই পূজাগুলোর বৈশিষ্ট্য খুব জটিল। মোটেও লক্ষ্মী, সরস্বতী পূজার মতো একা একা আয়োজনের পূজা নয়। এজন্যেই এগুলো মহাপূজা। সে সময়ে একটা পূজা বাড়িতে গোবরজল দিয়ে উঠোন নিকোতে একজন বিধবা মহিলা প্রয়োজন হতো, পদ্মফুল তুলে আনা থেকে শুরু করে কুশ সংগ্রহ, দশকর্মাদি সংগ্রহ, ভোগ রান্নার জন্যে পাঁচক ঠাকুর, প্রদীপ বানানো, কলাগাছ সংগ্রহ, ফুল সংগ্রহ, ১০৮ পদ্ম জোগাড়, গোবর সংগ্রহে গ্রামের লোককেই লাগতো, মুড়কি তৈরি করতে ময়ড়া লাগতো, শাঁখারী প্রয়োজন হতো, মালাকার লাগতো, শামিয়ানা টানানো, তাঁতির দরকার হতো, ঢাকী লাগতো, গ্রামকে গ্রাম ভোজ হতো সেই রান্না; এতসব কিছু শুধু রাজপরিবার হলেই নিজেদের দিয়ে সম্ভবপর ছিল না। অনেক মানু‌ষের স‌ম্মিলন প্রয়োজন হয় পূজা কর‌তে। এগুলোর জন্যে সাধারণ মানুষগুলোর মুখের দিকেই তাকিয়ে থাকা লাগতো রাজপরিবারকে।

দুঃখজনক এই পূজাগুলোয় চাইলেই তথাকথিত নিম্নবর্ণের বা দরিদ্র শ্রেণির প্রজারা তাদের রাজাদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে পূজার আমোদে মেতে উঠতে পারতো না। সমাজের নিচু শ্রেণি বা দরিদ্র সমাজে দুর্গাপূজার আমোদ-প্রমোদ অধরা থেকে যায় যতটা রাজবাড়িতে বা ধনাঢ্যদের ঠাকুরদালানে আয়োজন হতো। কারণ, তথাকথিত উঁচু শ্রেণির লোকজনদের মাঝে (কিছু ব‌্যতিক্রম ছাড়া) শ্রেণিবিভেদটাকেও তারা আভিজাত্যই ভাবতো। এই বিভাজনের আক্ষেপ অনেকটাই ঘুচে যায় ‘বারোয়ারি’ পূজার প্রচলনে।

‘বারোয়ারি’ শব্দটির উৎপত্তি ‘বারো’ ও ‘ইয়ার’ (বন্ধু) শব্দ দুটি থেকে। গ্রামের ১২ জন সদস্য মিলে বন্ধুত্বপূর্ণভাবে এই পূজার প্রচলন করেন বলে এর নাম হয় ‘বারোয়ারি’। বারোয়ারি পূজার প্রচলন সম্পর্কে জানা যায়, সেন আমলে বাংলায় হিন্দু ধর্ম রাজ-পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে ও সমাজে ব্রাহ্মণদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। তৎকালীন সময়ে সেন বংশের ও তাঁদের পরিবারের দুর্গাপূজা রমরমা ও বহুল প্রচলিত ছিল।

আনুমানিক ১১৬৬ সালে সেন রাজবাড়িতে বেশ জাঁকজমকের সাথে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়। সেখানকার প্রজাগণ দুপুরবেলা সন্তান-সন্ততিদের সঙ্গে নিয়ে সেনবাড়ির সদর দরজায় উপস্থিত হন প্রতিমা দর্শনের জন্য। কিন্তু দ্বাররক্ষীরা তাদের প্রবেশে নিষেধ করেন। বহু প্রচেষ্টার পরও তাদের প্রতিমা দর্শনের জন্য অনুমতি না মিলায় অপমানিত বোধ করে তারা বাড়ি ফিরে আসেন এবং সকলকে এ কথা জানান। এক রকমের বিবাদের জেরেই ১২টি গ্রামের যুবকেরা মিলে এই পূজা আয়োজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

যুদ্ধে ও  বিপ্ল‌বে দুর্গা
কলকাতায় ১৯২৯ সাল থেকে ‘সিমলা ব্যায়াম সমিতি’র পূজায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশসহ বিপ্লবী ও সেই সময়ের রাজনৈতিক নেতারা যুক্ত ছিলেন। তবে সবাইকে ছাপিয়ে যান নেতাজি সুভাষ বোস। নেতাজি ছিলেন ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। যার রেশ ধরে পূজাটি ‘নেতাজির পূজা’ নামে খ্যাত হয়। এককালের সভাপতি নেতাজি সুভাষ চন্দ্রের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে এখনও পূজায় কোনও থিম বা আধুনিক অতিশায্য তেমন প্রাধান্য পায় না। মূলত পূজাটি ছিল বিপ্লবীদের আখড়া।

১৯৭১ সা‌লের সর্বজনীন পূজায় বাংলা‌দে‌শের মুক্তিযু‌দ্ধ ও বঙ্গবন্ধুও বাদ প‌ড়েন‌নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রের পঞ্চদশ খণ্ডে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি এ আর মল্লিকের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সা‌লে ভার‌তে দুর্গাপূজার মণ্ডপে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি টানানো হয়েছিল। তার বর্ণনা মতে, ‘সে সময় ভারতে বাংলাদেশের সমর্থনে এমন একটি জোয়ার এসেছিল যে সব জায়গায়, এমনকি দুর্গাপূজা মণ্ডপের প্রবেশদ্বারেও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি টানানো দেখেছি’।

মুহাম্মদ নূরুল কাদির তার লেখা ‘দুশো ছেষট্টি দিনে স্বাধীনতা’ বইয়ে লিখেছেন, ‘একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে বহু পূজামণ্ডপে বঙ্গবন্ধুর ছবি ফুল দিয়ে সাজিয়ে ঠাকুরের পাশে সম্মানের সাথে রাখা হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই বিশ্বাস করতেন, বিষ্ণু বা নারায়ণ নরদেহ ধারণ করে ‘অবতার’ হিসেবে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন সাত কোটি বাঙালিকে রক্ষা করার জন্য। সেই কারণেই একাত্তরে পশ্চিমবঙ্গে বহু হিন্দু বঙ্গবন্ধুকে দেবদূত ও পূজ্য হিসেবে মান্য করতেন।’

সর্বভূতা দেবীর বিরাজ সর্বত্রই। যেখানে ধর্ম-বর্ণ কোনও মানদণ্ড নয়। দশভুজা দশদিক যেমন আলো করছেন তেমনি দশদিকের সকল রূপকেই নিজের ভিতর টেনে নিচ্ছেন। ঘুচিয়ে দিচ্ছেন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা কিংবা মহারাষ্ট্র-দুবাই-ইউরোপ-আফ্রিকা বা আমেরিকার সীমানার বেড়াজাল।

আমরা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, হে দেবী তুমি প্রসন্ন হলেই আমাদের মুক্তিলাভ হবে, সবাই মঙ্গল লাভ কর‌বে।

লেখক: গণমাধ‌্যম ও সংস্কৃ‌তিকর্মী
palashchow.news@gmail.com