X
সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫
২৩ আষাঢ় ১৪৩২

করের বোঝা ও সুশাসনের প্রতিশ্রুতি

আশফাক সফল
০৭ জুলাই ২০২৫, ১৮:০৯আপডেট : ০৭ জুলাই ২০২৫, ১৮:০৯

স্বপ্নে যেমন রঙ থাকে, বাজেটেও থাকে কিছু আশাবাদ। আবার সেই স্বপ্ন যদি বাস্তবের মেঘে ঢাকা পড়ে, তবে বাজেটের ভাষাও হয়ে ওঠে ভারী। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদন করা হয়েছে। “বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয়” শিরোনামের এই বাজেটে প্রস্তাবনা পর্যায় থেকে যে কাঠামোগত দ্বিধা ও টানাপোড়েন ছিল, শেষ পর্যন্ত টিকে গেছে। টেকসই উন্নয়নের কথা বলা হলেও পাসকৃত বাজেটে করের ভার আরও বেড়েছে; যা গিয়ে পড়েছে মূলত মধ্যবিত্ত ও সাধারণ নাগরিকের ওপর।
 
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ তার বাজেটের অন্যতম লক্ষ্য রেখেছেন আর্থিক শৃঙ্খলার প্রয়োজনীয়তাকে। স্বপ্ন দেখিয়েছেন একটি শৃঙ্খলার কাঠামোর,  যা অতীতের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের ভিত গড়বে। তবে ভাষ্য যতটা পরিণত, নীতি ততটাই বাস্তববিচ্যুত। দীর্ঘদিনের আর্থিক বিশৃঙ্খলা ও ঘাটতির দায় সামাল দিতে গিয়ে অর্থনীতি যেন আরেক প্রকার কাঠামোগত চাপের মুখে পড়েছে।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের পাসকৃত বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা, যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। বলা চলে এটি একটি সংকোচনমূলক বাজেট। বাজেটকে জনবান্ধব করার লক্ষ্যে বিভিন্ন ভাতা বাড়ানো হয়েছে। “সুবিধাভোগীর সংখ্যা” এবং “মাথাপিছু বরাদ্দ”, উভয়ই কিছুটা বাড়ানো হয়েছে সামাজিক বৈষম্য হ্রাস এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে।

একইসঙ্গে বরাদ্দ বেড়েছে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ সংশ্লিষ্ট খাতে শহীদদের পরিবার ও আহতদের জন্য ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদিতে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এ খাতে ব্যয় ছিল ২৩২ কোটি ৬০ লাখ টাকা, যা বাড়িয়ে আগামী অর্থবছরে ৪০৫ কোটি ২০ লাখ টাকা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, এবারের বাজেট বক্তব্যে “জুলাই” বিষয়টি বেশি এসেছে যে সেটি “ফাউন্ডেশন”, “অধিদপ্তর” এবং “জাদুঘর” মিলিয়ে যেন একটি আলাদা বার্তা দিচ্ছে।

কিছু দিন আগেও মূল্যস্ফীতির হার যেখানে ১১ শতাংশের ওপরে ছিল (২০২৪ সালের জুলাই মাসে ১১.৬৬), সাম্প্রতিক সময়ে তা ৯-এর ঘরে এসেছে বলে বাজেটে দাবি করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুরু করে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি। গত জানুয়ারিতে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বলা হয়, পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে না নামা পর্যন্ত এই কড়াকড়ি অব্যাহত থাকবে।
 
এ ঘোষণার যথার্থতা থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মানি মার্কেটে নতুন অর্থের প্রবাহ পুরো প্রক্রিয়াটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। একদিকে সার ও বিদ্যুৎ খাতে বকেয়া বিল মেটাতে সরকার ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করেছে; অন্যদিকে, গত ডিসেম্বরেও পাঁচটি ইসলামি ব্যাংকসহ সাতটি দুর্বল ব্যাংককে ২২ হাজার কোটি টাকা জরুরি তহবিল থেকে ঋণ দেওয়া হয়েছে। এরপরও বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিশ্রুতি-নির্ভর নোটের বিপরীতে তাদের তারল্য সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। এটাই সত্য, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার পিছনে এই ব্যাংকগুলোর ভূমিকা অনেক।

২০২৩ সালে যেখানে হার ছিল ১০.১১ শতাংশ, ২০২৪ সালের শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২০.২০ শতাংশে।

যদিও সরকার শুরুতে বলেছিল, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টাকা ছেপে সহায়তা করা হবে না, বাস্তবে ভিন্ন পথে সেই আর্থিক সহায়তাই চলছে। কিন্তু এই বাস্তবতায় বাজেটে দীর্ঘমেয়াদি কোনও গঠনমূলক পরিকল্পনা উল্লেখযোগ্যভাবে অনুপস্থিত।

এবারের বাজেটেও যথারীতি পরিকল্পনা আছে করের মাধ্যমে রাজস্ব আয় বাড়ানো। করের লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে ৭.৫ শতাংশের বেশি। ব্যক্তি পর্যায়ে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হলেও ৫ শতাংশ করের স্লাব তুলে দেওয়ার ফলে মধ্যবিত্তের ওপর করের চাপ বেড়েছে। ন্যূনতম করের হার সর্বত্র ৫ হাজার টাকা করা হয়েছে, ফলে সিটি করপোরেশনের বাইরের কেউ ৪ লাখ টাকা আয়ে আগে যেখানে ৩ হাজার টাকা কর দিতেন, এখন তাকে দিতে হবে ৫ হাজার টাকা। একইভাবে ৭ লাখ টাকা আয়ের ব্যক্তিকে দিতে হবে প্রায় ৩৭ হাজার টাকা কর, যা আগে ছিল ৩০ হাজারের মতো।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে অনলাইন কেনাকাটায় করের ক্ষেত্রে। ই-কমার্স খাতে বা অনলাইনে পণ্য বিক্রয়ে কমিশনের ওপর ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। স্থূল চোখে দেখলে এখানে শুধু খরচ বাড়বে বলে মনে হয়। কিন্তু বাস্তবতা আরও সূক্ষ্ম। কোভিড পরবর্তী বাস্তবতায় অনলাইন কেনাকাটা আর হোম ডেলিভারি অনেকের জন্য শুধু সুবিধা নয়, বরং জীবিকার নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। একজন ছাত্র তার পড়ার খরচ জোগাড় করছে, একজন বেকার তার আত্মসম্মান ধরে রাখছে—এই বাস্তবতাকে খাটো করে দেখা যাবে না। এই উৎস কর শুধুই মূল্যবৃদ্ধির কারণ নয়, এটি একটি উদীয়মান অর্থনৈতিক খাতের গতিপথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ই-কমার্স খাতের বাজার মূল্য এখন ২ হাজার কোটি টাকার বেশি এবং এতে প্রায় এক কোটিরও বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত।

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ তার দীর্ঘদিনের নীতিনির্ধারণী অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশ ব্যাংকে তার সময়কালে BASEL II বাস্তবায়নের অবদান, এবং সামগ্রিক আর্থিক সুশাসনের পক্ষপাত দিয়ে বাজেট প্রণয়ন করেছেন। তবে বাজেটের নির্যাস নির্ধারিত হয়েছে অনেকাংশে রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনিক চাপের ফলে। তার সময়েই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পুনর্গঠনের সাহসী সিদ্ধান্ত এসেছে—যা হয়তো আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের চাপের ফল, আবার হতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক বিচক্ষণতার ফলাফল।

বাজেটে বৈষম্যহীন অর্থনীতির কথা বলা হলেও বাস্তব কাঠামোতে তা বহুক্ষেত্রে অভাবনীয় বৈষম্যকেই প্রশ্রয় দিয়েছে। কর কাঠামোর কঠোরতা, অনলাইন বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতা, মূল্যস্ফীতির সংজ্ঞায়িত সংকোচন—সব মিলিয়ে সাধারণ নাগরিকের বাস্তবতার সঙ্গে বাজেটের সংযোগ বহু ক্ষেত্রেই আলগা। অবশ্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এবং লিঙ্গবৈষম্য হ্রাসে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখা গেছে, যা সাধুবাদযোগ্য।

এই বাজেট শেষ পর্যন্ত আমাদের সামনে একটি প্রশ্ন রেখেছে—আমরা কি কেবল আয়-ব্যয়ের পরিসংখ্যান তৈরি করছি, নাকি এক মানবিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই অর্থনৈতিক কাঠামোর দিকে এগোচ্ছি?

লেখক: ব্লগার ও আইটি প্রফেশনাল

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জুলাই আন্দোলনে দুই শহীদদের স্মরণে সড়ক ও চত্বর উদ্বোধন
জুলাই আন্দোলনে দুই শহীদদের স্মরণে সড়ক ও চত্বর উদ্বোধন
বাংলাদেশ ও তুরস্ক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়াতে চায়
বাংলাদেশ ও তুরস্ক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়াতে চায়
হবিগঞ্জে ২ পক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহত, ১৪৪ ধারা জারি
হবিগঞ্জে ২ পক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহত, ১৪৪ ধারা জারি
আ.লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ৩ সদস্য গ্রেফতার
আ.লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ৩ সদস্য গ্রেফতার
সর্বশেষসর্বাধিক