আত্মঘাতী সমাজ কেন?

আড্ডার সকল ভেন্যুতে আলোচনার বিষয়- রামপুরায় মায়ের হাতে দুই শিশু হত্যা। সত্যিই মা দুই শিশুকে নিজ হাতে হত্যা করেছেন কিনা, তা এখনও প্রমাণিত হয়নি আদালতে। বৃহস্পতিবার রাতে মায়ের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ তুলে বাবা’র দায়ের করা মামলার আগেই র‌্যাব থেকে দাবি করা হয়েছে, মা মাহফুজা মালেক জেসমিন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন তিনিই নিজ হাতে মেয়ে অরনী ও ছেলে আলভিকে হত্যা করেছেন।
আদালতে হাজির করার আগে যদিও এধরনের স্বীকারমূলক জবানবন্দির আইনগত ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবুও র‌্যাবের পক্ষ থেকে প্রথমে কারণ হিসেবে পরকীয়া যুক্ত থাকলেও পরে তা চ্যুত করা হয়। বলা হয় সন্তানদের শিক্ষা জীবন নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে তিনি মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন দীর্ঘ দিন। নিজেও উচ্চশিক্ষিত, কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। সন্তানরা ভালো স্কুলে পড়তেন, তারপরেও কেন তিনি সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হবেন।
রহস্য আরও দানা বাধে যখন ছেলে-মেয়ের মরদেহ মর্গে রেখেই তারা যানজটের ছুঁতো তুলে দাফনের ব্যবস্থা করতে জামালপুর চলে যান। মা যে কারণেই হত্যা করেন না কেন বাবা কেন তা সহজ-সরলভাবে মেনে নিয়ে মায়ের সহযাত্রী হবেন? হত্যাকাণ্ডের সময় দাদি বাসায় ছিলেন? তার বক্তব্যও আসা উচিত ছিল। হয়তো আসবেও। সেই সঙ্গে বাসায় মায়ের যে খালাত ভাইকে পাওয়া গিয়েছিল তার ভূমিকাও স্পষ্ট হওয়া দরকার। তার আগে এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য সরলভাবে আবিষ্কারের সুযোগ নেই।
আমি কেবল পাঠকের ভাবনায় আনতে চাই- পুলিশ দম্পতিকে খুন করেছিল তাদের মেয়ে ঐশি। এখন দেখা যাচ্ছে মা নিজে খুন করলেন তার দুই সন্তানকে। মা ও বাবার হাতে সন্তান খুনের ঘটনা বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। গত একবছরেই এই সংখ্যা অর্ধশত ছাড়িয়েছে। এই ঘটনা যে কেবল সমাজের অতি নিচুতলায় ঘটছে তা নয়। সকল তলা থেকেই এই দুঃসংবাদ আসছে। পেছনের কারণ অস্বচ্ছলতা এখন অনেকটাই নিচে চাপা পড়ে গেছে। সামনে চলে এসেছে পরিবারের মানুষগুলোর মধ্যকার বিচ্ছিন্নতা।
এই বিচ্ছিন্নতা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। একই পরিবারের মানুষগুলো অবস্থান করে যোজন-যোজন দূরত্বে। এই দূরত্ব তাদের পরিবার  থেকে বহির্মুখী করে তুলে। পরিবারের বাইরে তৈরি সম্পর্কের বিষয়ে তারা সময় ব্যয় করে বেশি। এই কাজটি যখন বাবা এবং মায়ের দ্বারা হয় তখন সন্তানরা বিপন্নতা বোধ করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাইরের সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে বা বহির্মুখী রক্ষায় বাবা এবং মা সন্তানদের ‘বাধা’ মনে করে। সেই বাধা নির্মূল করতেই তারা হত্যার কথা ভাবনায় নিয়ে আসে। এবং কাজটি ঘটিয়ে ফেলে। একই ভাবে মাদকাসক্ত স্বামী, যৌতুকের জন্য নির্যাতিত মা, পারিবারিক আরও নানা কারণে মানসিক চাপে থাকা মা মুক্তি খুঁজতে গিয়ে মনে করে, সন্তানদের সরিয়ে দিলেই তার প্রকৃত মুক্তি ঘটবে। সে চাইলেই যে কোনওভাবে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারবে, এমনকি পরিবার থেকেও। এই মুক্তি খুঁজতে গিয়ে তারা সন্তানকে যেমন হত্যা করে, তেমনি আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়।

বাবাদের দিক থেকেও মুক্তির খোঁজার এমন উপায় দেখা গেছে। আর এই সব কিছুকে উস্কে দিচ্ছে সমাজের ভোগবাদিতার ক্রমশ আস্ফালন, প্রতিযোগিতামূলক বাজারের সক্রিয় ভোক্তা হতে চাওয়ার মানসিকতা। সঙ্গে আছে গণমাধ্যমের দূরশিক্ষণ। গণমাধ্যম বিজ্ঞাপন ও বিনোদন প্যাকেজ দিয়ে আমাদের পরিবার ও সমাজকে সেই ঝকঝকে মোড়কে ঢেকে ফেলতে চাইছে। সেই সেলোফিন কাগজের মোড়ক, কাঁঠাল পাতার মোড়কের মতো প্রাকৃতিক নয় বলেই, আমরা সেখান থেকে মুক্তি খুঁজতে চাই। সেই মুক্তি খোঁজার পথ হিসেবে বেছে নিচ্ছি আত্মহনন।

নিজেকে না হোক, সন্তান হত্যাও তো আত্মহননই নাকি? আমরা এই মুহূর্তে বিচ্ছিন্ন এক আত্মঘাতী পরিবার ও সমাজে বসবাস করছি। এই সত্য কথা নিরন্তর অস্বীকার করেও যাচ্ছি আমরা। যা আমাদের কেবলই সর্বনাশের মাইলফলকের নিকটবর্তী করছে। মুক্তির উপায় একটিই। থেমে পড়তে হবে। একজোট হতে হবে পরিবারকে, সমাজকে। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মানুষগুলোকে দেখাতে হবে পরিবার নামক সত্য সরোবরের ঠিকানা।

লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি